পাক-ভারত অশান্তি বনাম কাশ্মীর
ড. ইশা মোহাম্মদ
🕐 ৮:২৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৯, ২০১৯
পাক-ভারত অশান্তি বেড়েছে এবং অনলবর্ষী হয়ে উঠেছে। একটু গড়বড় হলে যে কোনো মুহূর্তে অসংখ্য মানুষের প্রাণ যেতে পারে। কেন হঠাৎ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? প্রকৃত কারণ কেউই জানে না, এমন ভাবভঙ্গিতে সবাই কথা বলছে। তাদের প্রত্যেকেরই কথার সারৎসার থেকে বোঝা যায়, হয়তো তারা সবাই প্রকৃত কারণটা জানে তবে যে সব সন্দেহ দৃশ্যমান হয়েছে, তার মধ্যে শ্রেণি ষড়যন্ত্রই প্রাধান্য আছে। মোদি ক্ষমতায় থাকতে চায় কিন্তু থাকতে পারবে না। তার ব্যক্তিগত আর্থিক কেলেঙ্কারি সারা ভারতেই আলোচিত। ভারতের সাধারণ মানুষ মূলত ধর্ম বিশ্বাসী কিন্তু হিংস্র নয়। সেখানকার মৌলবাদীরাই হিংস্র।
বাংলাদেশেও তেমনই। সাধারণ মানুষ ধর্মপ্রাণ কিন্তু হিংস্র নয়, কেবলমাত্র মৌলবাদীরাই হিংস্র। বাংলাদেশ ও ভারতের কথা একত্রে আনলাম এজন্য যে, ভারতের বিশালসংখ্যক মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশের মুসলমানদের দরদ আছে। সেখানে মুসলমানরা সামাজিকভাবে হেনস্তা হলে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ে। যেমন অতীতে কলকাতায় রায়ট হওয়ার সঙ্গে নোয়াখালীর রায়টের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কলকাতার রায়টের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তব কারণ ছিল। কিন্তু নোয়াখালীতে কোনো বাস্তব কারণ ছিল না। কলকাতার বাতাস নোয়াখালীতে লেগেছিল।
বর্তমানে পাক-ভারত অশান্তির কারণে ভারতের কাশ্মীরের সাধারণ মুসলমানরাই নয়, অনেক স্থানের নিরীহ মুসলমানও নিগৃহীত হবে। আপনাদের তো মনে আছে, রামমন্দির ও গুজরাটের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কারসাজির কথা। মোদি কালো তালিকা থেকে কীভাবে মুক্তি পেলেন এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন, তা সাধারণ মানুষ এখনো জানে না। সন্দেহ করা হচ্ছে, এ সরকার পাক-ভারত অশান্তির কারণে সাধারণ মুসলিমরা ‘শিকার’ হবে এবং ধর্মীয় উন্মাদনার সুযোগ নিয়ে মোদিগোষ্ঠী আবারও ক্ষমতায় যাবে। মোদি ক্ষমতায় গিয়ে আবার শান্তির কথা বলবে কিন্তু ততদিনে যে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাবে তার কী হবে?
ভারতের বোদ্ধা রাজনৈতিক নেতারা কী এই নোংরা পথ পরিহার করতে পারে না? মোদির চেয়েও বড় রাজনীতিবিদ ভারতে আছে। তারা করছেনটা কী? কংগ্রেস কেন ‘তলা’ কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে? তাদেরই তো রাজনৈতিক ক্ষমতায় যাওয়ার কথা। ক্ষমতা নিচ্ছে না কেন? একমাত্র কংগ্রেসই পারবে ভারতে সামাজিক শান্তি রক্ষা করতে। একটা সময় কংগ্রেসই ছিল রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যম। কংগ্রেসের ব্যর্থতা অনেকগুলো আঞ্চলিক শক্তিশালী দল তৈরি করেছে। এরা এতই শক্তিশালী হয়েছে যে, বিশাল কংগ্রেসকেই তাদের পায়ে ধরতে হচ্ছে। তাতে অবশ্যই লজ্জার কিছুই নেই। হাতে-পায়ে ধরে হলেও মৌলবাদীদের ঠেকিয়ে দেওয়া উচিত।
ভারতবর্ষ তো জানেই তাদের উন্নয়ন সেক্যুলার পথে হয়েছে, ধর্মীয় পথে নয়। আর সেই সেক্যুলারিজমের গণতান্ত্রিক চর্চা করেছে কংগ্রেসই। প্রশ্ন হলো, পাক-ভারত অশান্তির সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক কী? যদি মনে করা হয়, কাশ্মীর সমস্যা পাক-ভারতের অশান্তির কারণ, তা হলে ভুল হবে।
কাশ্মীরিরা পাকিস্তানের সঙ্গে যেতে চায় না। তারা স্বাধীনতা চায়। ভারত দমন-পীড়ন করছে বটে, তবে সামাজিক অশান্তি প্রবল নয়। কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী উসকানি দিয়ে কাশ্মীরে অশান্তি জিইয়ে রেখেছে। যে অশান্তির কারণে কাশ্মীরের উন্নয়ন প্রতিরুদ্ধ হয়েছে। বহুদিন থেকেই কাশ্মীরের কোনো উন্নয়ন উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে ভারতের কোনো মাথা ব্যথাও নেই। এটিও কাশ্মীরের অশান্তির একটি কারণ। উন্নয়ন হলে অশান্তি কমে যেত।
কংগ্রেস যতদিন ক্ষমতায় ছিল, ততদিন কাশ্মীরের ‘অশান্তি’ প্রবল হয়নি। এখনো হবে না, যদি কংগ্রেস ক্ষমতায় যায়। কিন্তু কংগ্রেস কি ক্ষমতায় যেতে পারবে? কংগ্রেস একজন ভালো নেতা পাচ্ছে না। কংগ্রেসে বড়মাপের নেতা নেই বিধায় মোদি ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১০-১৫ বছর ধরেই কংগ্রেস নেতৃত্ব সন্ধান করছে। কিন্তু বারবার ভুল করেছে। তারা রাহুলকে বড় নেতা বানানোর চেষ্টা করছে কিন্তু রাহুল বড় নেতা হওয়ার গুণাগুণ ধারণ করেন না। তাছাড়া ভারতের সাধারণ মানুষ আধুনিক নয়। তারা গণতান্ত্রিক বড় নেতা চিনতে পারে না। প্রকৃত অর্থে ‘সনাতন’ থেকে তারা নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। আগামী কয়েক দশকেও পারবে না। আপনারা হয়তো মেনে নেবেন না যে, ভারত শাক্তিশালী দেশ, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ’ কিন্তু উন্নত দেশ নয়। সাধারণ মানুষ বৈরি সনাতনের বৃত্তে আবদ্ধ। এদের ভোটেই কিন্তু জাতীয় সরকার তৈরি হয়। কংগ্রেসকে ক্ষমতায় যেতে হলে এদের ভোটই নিতে হবে। কিন্তু নেবে কী করে?
সনাতনের নেতৃত্ব ক্যারিশমাটিক নেতাদের কাছেই থাকে। রাহুল পারেনি তার একমাত্র কারণ তিনি ক্যারিশমাটিক নেতা হতে পারেননি। আমার মনে হয় তিনি কোনো দিনই পারবেন না। বিকল্প হিসেবে প্রিয়াঙ্কা ক্যারিশমাটিক ‘নেতৃত্ব’ হিসেবে বিকশিত হতে পারেন। অনেক আগে থেকেই এ কথা বলাবলি হচ্ছে যে, ইন্দিরা গান্ধীর ছাঁচ আছে প্রিয়াঙ্কার মুখে। কিন্তু তিনি তার দাদীর মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান নন। কিন্তু তারপরও প্রিয়াঙ্কার মাধ্যমেই কংগ্রেস ক্ষমতায় যেতে পারবে।
কেননা প্রিয়াঙ্কাই পারবে সনাতনদের সম্পূর্ণ রাখতে। ক্যারিশমাটিক নেতারা রাজনীতি দিয়ে নয়, ব্যক্তিগত আকর্ষণে সনাতনদের মনমুগ্ধ করে। তা ছাড়া রাজনৈতিক প্রচারণায় অনেক কৌশল নিতে হয়। সেই সব কৌশলের মধ্যে মূল্যবোধের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধাকেও কাজে লাগানো হয়। যদি প্রচার করে দেওয়া যায় যে, প্রিয়াঙ্কার মধ্যে ভারত লক্ষ্মী ভর করেছে তবে সনাতনরা অন্ধ হয়ে যাবে। তবে ওই কাজে মধ্যবিত্তদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো যাবে না।
বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে রাহুলকে। রাহুল যদি নেতৃত্ব ছেড়ে সাধারণ কর্মী হন তবে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করবে, প্রিয়াঙ্কা নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু যতক্ষণ না রাহুল পদ ছাড়ছেন, ততক্ষণ প্রিয়াঙ্কা পাত্তা পাবেন না। সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিতে হবে যে, প্রিয়াঙ্কাই নেতৃত্বে এবং এককভাবে। এমন কী তার মা সোনিয়াও নেই। সোনিয়ার কোনো প্রভাবও নেই। কংগ্রেসের জন্য এটা বিশাল ঝুঁকির এবং বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপার। এত বড় ঝুঁকি তারা নেবেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তবে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকারের উদাহরণ ভারতবর্ষে আছে। বিশ্ববাসীর জন্য ভারতবর্ষ একটি উদাহরণ হতে পারে।
সেক্যুলার ভারতবর্ষ ধর্মীয় উন্মদনা ত্যাগ করলে এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোও উদাহরণ হিসেবে এটা গ্রহণ করবে। আমরা স্বীকার করি বা না করি এশিয়ার অনেক দেশই ধর্মীয় নির্দেশনায় অন্ধভাবে চলে। ওই সব দেশে জাতপাতের বিচার আছে। ফলে সাধারণ মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে। সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তখনই সম্ভব হয়, যখন ধর্মীয় বিধান রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে না। ইহজাগতিক বাস্তবতার নিরিখে প্রণীত আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হলেই সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয়। তেমন পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না।
ভারতের মুসলমানরা সর্ব ক্ষেত্রেই সমান অধিকার ভোগ করতে পারলে মৌলবাদী উসকানিতে কোনো কাজ হবে না। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ হলে শ্রেণি রাজনীতিই নিয়ামক হবে। সেই দ্বন্দ্বেই সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। কম্যুনিস্ট এবং কংগ্রেস ছাড়া অন্যরা হয় সংকীর্ণ আঞ্চলিক নয়তো ধর্মাশ্রয়ী। আঞ্চলিকতা ভারতের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ধর্মাশ্রয়ীতাও ক্ষতিকর। এই বিবেচনায় কংগ্রেসকেই ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে হবে। কিন্তু যেতে চাইলেই তো আর যেতে পারবে না। প্রিয়াঙ্কা যদি নেতৃত্ব নেয় তবে কংগ্রেস এবার ক্ষমতায় যেতে পারে। ভারতের সাধারণ মানুষ কংগ্রেসের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা আছে। প্রেম-ভালোবাসাও আছে বলা যায়। বামদের প্রতিও কারও কারও ভক্তিশ্রদ্ধা আছে।
কংগ্রেস এককভাবে হয়তো সবার কাছে এই মুহূর্তে পাত্তা পাবে না। সে জন্য বাম ও প্রগতিশীলদের সঙ্গে জোট করতে হবে। কেন্দ্র থেকে ব্যক্তি সংসদ সদস্যকে মনোয়ন দিতে হবে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে উদারতা দেখাতে হবে। যেখানে যে যোগ্য সেখানে তাকেই মনোনয়ন দিতে হবে।
তাতে যদি কংগ্রেসের সংখ্যালঘিষ্ট হওয়ার ভয় থাকে তবুও। তবে প্রচার করতে হবে যে, ওই ব্যক্তিকে প্রিয়াঙ্কা পছন্দ করে দেশও জাতির স্বার্থে মনোনয়ন দিয়েছে। এভাবে প্রচারণা চালিয়ে কংগ্রেস সরকার গঠনের মতো সাংসদ পেয়ে যাবে। এমন কী আলঙ্কারিক দু-এক জন ছাড়া শতভাগ সাংসদই কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট থেকেই আসতে পারে। গোপন সাম্প্রদায়িকতা অশান্তির রাজনীতি এবং ইহুদিবাদী কৌশল এবার ভারতে খুব একটা কাজ দেবে না, কংগ্রেসের উচিত হবে এ সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানো। যেহেতু মোদি বিতর্কিত এবং তার ভাবমূর্তি মলিন হয়েছে, সেহেতু বুঝতেই হবে সর্ব ভারতীয় নেতা আর কেউ নেই। প্রিয়াঙ্কাই পারবে ওই শূন্যস্থান পূরণ করতে। আমরা ভারতবর্ষের শান্তির আশায় প্রিয়াঙ্কার দিকে তাকিয়ে আছি।
ড. ইশা মোহাম্মদ : অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]