স্মৃতির মণিকোঠায় ধীরেন্দ্রনাথ
বলাই চন্দ্র দত্ত
🕐 ৯:৫৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯
কোনো পরাধীন জাতির ভাষাসংগ্রামের সাধনা যখন সফল হয়, তখন তা জাতীয় চেতনার মর্মমূলে নিরন্তর প্রবহমান থাকে। অনাগতকাল প্রেরণার উৎস হয়ে বিরাজ করে অন্তরে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রে ১৯৪৭-এ প্রতিষ্ঠিত ‘পাকিস্তান’ নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের শৃঙ্খলে পূর্ব-বাংলা আবদ্ধ ছিল।
পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ববাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি অস্তিত্বের সংকট উপলব্ধি করে। পূর্ববাংলা পরিণত হলো আধা-ঔপনিবেশিক সামন্তবাদী অঞ্চলে। মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এবং পরিণামে সংঘটিত হলো গৌরবোজ্জ্বল ভাষা আন্দোলন।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শীর্ষক গ্রন্থের সম্পাদকের ভ‚মিকায় লেখা হয়েছে-‘একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে।’ যুগান্তকারী মহান একুশ বিশ্ব-ইতিহাসের বিস্ময়কর ঘটনা। বাস্তিল দিবসে ফরাসি জাতি শত দুঃখের গ্লানি মুছে যেমন নবজন্ম লাভ করেছিল, তেমনি ‘একুশে’র চেতনায় বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল আত্মপরিচয়ের নতুন ঠিকানা।
এক দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) বাঙালির এ আত্মপরিচয়ে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম যথাযোগ্য মর্যাদাদানের দাবি পাকিস্তান গণপরিষদে উত্থাপন করেছিলেন। আবার মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী মহান শহীদদের মধ্যেও তিনি অগ্রগণ্য। ভারত বিভাগকালে মাতৃভূমি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে পাকিস্তান ছেড়ে যাননি তিনি। পদে পদে হানাদার বাহিনীর নজিরবিহীন বর্বরতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু নীতি ও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি বৈষম্য, হিংসা ও হানাহানিমুক্ত বিশ্বসমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
গতকাল ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি। বাঙালির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ও স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। ১৯৪৮ সালের এ দিনের ঐতিহাসিকতায় বাঙালির পরিচিত মুখ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামের কৃতীসন্তান তিনি। পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপক। প্রস্তাবটি ছিল-‘That is the sub-rule (1) of rule 29, after the word ÔEnglish’ line 2, the words Ôor Bengali’ be inserted.’
তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতো উর্দু বা ইংরেজিতে। গণপরিষদ পরিচালনা সংক্রান্ত বিধিমালায় এ ভাষা দুটির বাধ্যবাধকতা স্বীকৃত ছিল। গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উক্ত প্রস্তাবে সংশোধনী আনার জন্য প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। তার সংশোধনী প্রস্তাবে ছিল-‘সংশ্লিষ্ট বিধিটিতে উর্দু ও ইংরেজির পাশে ‘অথবা বাংলা’ (or Bengali) শব্দটি যুক্ত করা হোক। গণপরিষদ এ প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে বাঙালি জাতিকে চরমভাবে অপমানিত করে। মাত্র ছয় মাস বয়সী পাকিস্তান নামক নবরাষ্ট্রটির অভ্যন্তরে যে তোলপাড় শুরু হয়েছিল তার চেয়েও বেশি প্রতিবাদের তোলপাড় শুরু হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। এ প্রস্তাবটি হঠাৎ বা কোনো হঠকারিতার বশে তিনি করেননি। প্রস্তাবটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটের এক অতি মূল্যবান দলিল। আর ওই প্রস্তাবের রোষেই পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল-তা আমরা সহজেই লক্ষ্য করতে পারি। তা বোঝার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে-
‘Out of six crores and ninety lakhs of people inhabiting this state, 4 crores and 40 lakhs of people speak the Bengalee language. So, sir, what should be the state language of the state? The state language of the state should be the language which is used by the majority of the people of the state, and for that, Sir, I consider that Bengalee language is a lingua franca of our state.’
উক্ত ভাষণের প্রতিক্রিয়া এতই ক্রিয়াশীল ছিল যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনসহ ক্ষমতাসীন দলীয় নেতারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তারা যেন ‘পাকিস্তান ভাঙার অশনিসংকেত’ এবং পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আলামত দেখতে পান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল অবাঙালি আমলারা। ফলে, ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করে ‘তমুদ্দুন মজলিস’। তাই বলা যেতে পারে, তমুদ্দুন মজলিস নামক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানই ভাষা আন্দোলনের সূচনাকার যার চূড়ান্তরূপ ৫২’র ভাষা আন্দোলন।
শৈশব থেকেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তীব্র প্রতিবাদী ছিলেন। ১৯০১ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে আদেশকৃত শোকসূচক ‘কালো ফিতা’ ধারণে তিনি দ্বিধা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন ‘কালো ফিতা’ ধারণে পরাধীনতার বেদনা উদয় হয় (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা)। এতে অনুমান করা যায়, তার প্রস্তাব বাঙালি জাতীয় জীবনে কত গুরুত্ববহ এবং তা বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমান, পরবর্তী ও অনাগতদের জন্য এটি একটি মাইলফলক। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করে।
পাকিস্তানের প্রতি মানুষের যে মোহ ছিল তা দূর হতে থাকে এবং নিজ ভাষা, জাতি, দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষের আস্থা জন্মে। বাঙালি হিসেবে আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে সবাই। ভাষাকেন্দ্রিক এ ঐক্যই জাতীয়তাবাদের মূল ভিত রচনা করে, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমানে বাংলাকে ইংরেজি স্টাইলে উচ্চারণের একটা হিড়িক পড়ে গেছে। বিশেষ করে মোবাইলের ফেসবুক পেজে এ হিড়িকের তোড়জোড় বেশি। যারা এরূপ উচ্চারণ করে লেখে তারা নিজেদের অত্যাধুনিক মনে করে। পক্ষান্তরে তারা ভাষার কলঙ্ক বহন করছে। কেননা, যে ভাষাই ব্যবহার করা হোক তার সঠিক শুদ্ধ ব্যবহার করতে হবে। তাই বাঙালি জাতি হিসেবে সবার রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি পরে চাই ইংরেজি ভাষার পত্তন’ গ্রহণ করা উচিত। সবশেষে আমাদের প্রত্যাশা-মর্যাদাপূর্ণ বাংলা ভাষার উচ্চারণে, ব্যবহারে ও প্রয়োগে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বলাই চন্দ্র দত্ত : এমফিল গবেষক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়