ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

একুশের চেতনা ও প্রাসঙ্গিক কথা

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান
🕐 ১০:০৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯

বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় ও গৌরবময় নিঃসন্দেহে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন। আর এই অর্জনের পেছনে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জিকে ঘুরেফিরে স্মরণ করতে হয়, সে সবের মধ্যে ৫২’র মহান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম অন্যতম। বাঙালির ইতিহাসে বায়ান্ন এসেছিল বলেই একাত্তর এসেছিল। ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের সেই অর্জন শুধু আমাদের মাতৃভাষার প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ক্রমেই একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার দানা বেঁধেছিল।

যার ধারাবাহিকতায় আজ আমরা স্বাধীন জাতির স্বীকৃতি পেয়েছি, পৃথিবীর বুকে আঁকতে পেরেছি একটি লাল সবুজ পতাকা খচিত মানচিত্র। আমরা হতে পেরেছি স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। আমরা আজ স্বাধীন দেশের আলো বাতাসে বেঁচে আছি, হাসছি, কাঁদছি। আর এ কারণেই আমাদের জাতীয় জীবনে ৫২’এর একুশ ফেব্রুয়ারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। অন্য কথায় ফেব্রুয়ারি আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তি, সাম্য, গণতন্ত্র তথা আধুনিক বাঙালির সব শুভ চেতনার মাস। আর একুশে ফেব্রুয়ারি হলো বাঙালি জাতির পরিচয়চিহ্ন।

আমাদের রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রামের ৬৭ বছরপূর্তি হলো এবার। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামের চেতনা ধরে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের চার যুগপূর্তি হচ্ছে এবং ২০২১ সালেই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করব। ভাষা আন্দোলনের পর এ সুদীর্ঘ সময়ে বাংলার চার কোটি পরিবারের মানুষ এখন প্রায় সতেরো কোটিতে উন্নীত হয়েছে। আজকে আমাদের কাছে প্রশ্ন, এতদিনে আমরা কি পেরেছি মাতৃভাষার প্রতি, ভাষা শহীদদের প্রতি এবং সর্বোপরি একুশের চেতনার প্রতি সুবিচার করতে?

একটি জাতিসত্তার মূল বিষয় হচ্ছে তার ভাষা। ভাষাকে মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও গৌরবের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পারস্পরিক মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। আহমদ শরীফ ভাষাকে জীবনানুভূতির বাহন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার ভাষায়, ‘ভাষা হচ্ছে জীবনানুভূতির বাহন, বেশি করে বললে বলতে হয়, ভাষাই জীবন।’ প্রত্যেক জাতির কাছে তার মাতৃভাষা পরম আদরের ধন। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানবশিশু প্রথম চিন্তা করতে এবং সে চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে শিখে। তাই মৌলিক চিন্তার বিকাশ স্বাভাবিকভাবে মাতৃভাষার মাধ্যমেই হয়।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় সাত হাজার ভাষা প্রচলিত আছে। এসব ভাষার মধ্যে অন্যতম বাংলা ভাষা- বিশ্বে আজ একটি সুপরিচিত ভাষা। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্যগুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়। বর্তমানে বাংলা ভাষা বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে। বিশ্বের প্রায় ২৭ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের জাতীয় ও সরকারি ভাষা বাংলা। কিন্তু এ মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার আসনে অভিসিক্ত করাটা আমাদের জন্য মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। এর জন্য আমাদের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। দিতে হয়েছে আত্মবলিদান। আর এভাবেই নিজের ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি জাতি সৃষ্টি করেছে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

বাঙালির জাতীয় জীবনে একুশ এক অনন্য মহিমায় ভাস্বর গৌরবের দিন। প্রতি বছর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাস আসে। আর ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা একুশের চেতনায় উৎফুল্ল ও উদ্বেলিত হয়ে উঠি। একুশ আসলেই যেন আমাদের চকিতে মনে পড়ে যায়- আমরা বাঙালি। আমাদের পোশাকে বাঙালিয়ানার প্রকাশ ঘটাতে তৎপর হয়ে উঠি। দল বেঁধে শহীদ মিনারে যাই, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। ভাষার মাস নিয়ে, একুশের চেতনা নিয়ে সারা দেশে আলোচনা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বুদ্ধিজীবী ও লেখকগণ পত্র-পত্রিকায় নানা ধরনের ও নানা মাত্রিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন। আর তারপর সব শেষ, সারা বছর এর রেশ থাকে না বললেই চলে। তাই একুশের মহিমা ও চেতনার বিষয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির জায়গাটিকে আরও নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

ভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের প্রাপ্তি নিছক কম নয়। তবে তা রাজনৈতিকভাবে যতটা বেশি, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগতভাবে ততটা নয়। রাজনৈতিকভাবে একুশ আমাদের একতাবদ্ধ করেছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের আলাদা একটি সত্তা দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু আমাদের শহীদ দিবসই নয়, তা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা পৃথিবীতে পালিত হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের একটি অর্জন। তবে এসব অর্জনের পাশাপাশি একুশের চেতনার অপ্রাপ্তি এমনকি অনেক স্বপ্নভঙ্গের বিষয়টিও আমাদের মনে রাখতে হবে এবং এ থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধান করতে হবে। এটি এখন সময়েরই দাবি।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। আজ এ কথা ভেবে দেখার দিন, এ দাবির কতটা পূরণ হয়েছে? বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রচলন আজও ঘটেনি; আমাদের সমাজে ইংরেজির প্রাধান্য ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন হয় বাংলায়, কিন্তু উচ্চ আদালতে এ আইনের প্রয়োগ ও বিচার কাজ চলে ইংরেজি ভাষায়। ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা ভাষার জায়গা নেই বললেই চলে। এনজিও খাতও চলছে মূলত ইংরেজি ভাষায়। তাদের সেমিনার, সিম্পোজিয়ামগুলোর ভাষা প্রধানত ইংরেজি; তাদের প্রতিবেদন ও অন্যান্য লেখালেখির ভাষাও তা-ই।

আমাদের দেশের নব্য পুঁজিপতি এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা দানের প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা গ্রহণকে ভাবা হচ্ছে সামাজিক সম্মান বৃদ্ধির উপায় হিসেবে। ইংরেজি ভাষায় লিখতে কথা, বলতে না পারাকেও অনেক ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হচ্ছে অগৌরবের ও অসম্মানের বিষয় হিসেবে। আর এ কারণেই সন্তানদের ব্যয়বহুল ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা দান করতে গিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিচ্ছেন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনেরও।

আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার অনেক সীমিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা ও গবেষণা যৎকিঞ্চিত থাকলেও দেশের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে এর ব্যবহার একেবারেই নেই। এমনকি দেশের কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্যবহার করলে তাদের শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। চিকিৎসা ও প্রকৌশল শিক্ষায়ও বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহার নেই।

জ্ঞানচর্চার জন্য মাতৃভাষাই সর্বোত্তম- এতে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। কেননা এতে মেধা ও মননের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা চর্চার যে আধিক্য, তা আশঙ্কার বিষয়। আমাদের দেশে অনেকই দাবি করেন যে, উচ্চশিক্ষাকে বিশ্বমানের করতে হলে তা ইংরেজি ভাষায়ই হতে হবে। কারণ উচ্চশিক্ষার জ্ঞানভাণ্ডর এখনো ইংরেজি ভাষারই নিয়ন্ত্রণে। তাই দেশের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাটা যদি ইংরেজিতে হয় তাহলে একই সঙ্গে যেমন আমরা পারব বাইরের দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে, অন্যদিকে আমাদের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়াটাও সুগম হবে। এ যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা একেবারে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে একে একমাত্র যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করারও কারণ নেই। একবার জার্মান, ফরাসি কিংবা রুশ দেশে পড়াশোনার কথা কী আমরা ভাবতে পারি না। ঐসব দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে বিদেশিরাও যদি তাদের ভাষা রপ্ত করতে পারে, তবে আমাদের ক্ষেত্রে কেন তা হবে না?

এশিয়ার চীন, জাপান আমাদের তুলনায় জ্ঞান-বিজ্ঞান বা অর্থনীতিতে অনেক অগ্রগামী। তারা ইংরেজি বাছ-বিচারহীনভাবে ব্যবহার করে এমন উন্নতি করেছেন অথবা মাতৃভাষা বাদ দিয়ে তারা এ সবকাজে সফল হয়েছেন, এমনটা কিন্তু নয়। ২০১৮ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও তুরস্কের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গমনের। সেখানকার অনেক উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়েও মাতৃভাষায় শিক্ষা চালু রয়েছে। বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ জনসংখ্যার মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও কেন মাতৃভাষা উচ্চশিক্ষার ভাষা হতে পারছে না? এর একটি অন্যতম কারণ আমাদের পরনির্ভরশীলতা। এই পরনির্ভরশীলতা কেবল অর্থনৈতিক ও অবস্থানগত নয়, বরং মানসিক এবং এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘকালের উপনিবেশিক চিন্তা-চেতনাপ্রসূত মানসিক দৈন্যতা। আসলে আমাদের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিটা বড়ই দুর্বল। তদুপরি এ ব্যাপারে আমাদের কোনো সঠিক কর্মপরিকল্পনা নেই, পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য নেই আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় সংকল্প। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় রচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল্যবান বিষয়কে উপেক্ষা করা যাবে না। তাই ওই জ্ঞানভাণ্ডারকে আমাদের মাতৃভাষায় রূপান্তরের প্রচেষ্টা নেওয়া প্রয়োজন। মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে অবশ্যই সমন্বয় ঘটাতে হবে। নইলে আমাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হবে না।

বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা ধরনের বিচ্যুতি, বিকৃতি ও বিভ্রাট। ভাষা বহতা নদীর মতো এবং এতে পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে সে পরিবর্তনটা মার্জিত না হলেই ঘটে বিপত্তি। আমাদের দেশে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এখন ঘটছে এক অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা যায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার। কিন্তু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলতে-ফিরতে আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও ব্যবহার দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত বোধ করি। আমাদের গণমাধ্যম বিশেষ করে বেসরকারি রেডিও টেলিভিশনে প্রচারিত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষার বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। এসব মাধ্যমে ভাষার প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা, ইংরেজি স্টাইলে বাংলা উচ্চারণ, অশুদ্ধ উচ্চারণ, অজস্র বানান ভুলের প্রবণতা সত্যিই দুঃখজনক।

বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধের জন্য শুধু সরকার নয়, সব ভাষাপ্রেমীদের এক হয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যখন বাংলা ভাষায় কথা বলব তখন যেন শুদ্ধ উচ্চারণে সুন্দরভাবে বলতে পারি সেদিকে নজর রাখব। এ কাজটি আমরা পরিবার থেকেই করতে পারি। কোমলমতি শিশুরা যখন কথা বলে, কথা শুনতে চায় তখন পরিবারের সদস্যরা তাদের সঙ্গে শুদ্ধ উচ্চারণে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলবেন। যথাসম্ভব আঞ্চলিকতা পরিহার করে প্রমিত চলিত রীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করতে হবে। বাংলা ভাষায় প্রচুর সাহিত্য রচনা এবং এ ভাষার সমৃদ্ধির জন্য গবেষণা বৃদ্ধি করতে হবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত একটি বানান ও উচ্চারণরীতি তৈরি করা দরকার। আর এসব কাজ শুধু সরকারি চেষ্টা ও আইন দিয়ে হবে না। এ ব্যাপারে আমাদের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, সরকার সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। সর্বোপরি আমাদের ইচ্ছা শক্তি ও চেতনারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

আমরা বাস করছি এখন আকাশ সংস্কৃতির যুগে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও আজ নানা সংকটের মুখে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম আজ বাংলা সাহিত্য, সংগীতের প্রতি আগ্রহী নয়। পাশ্চাত্য এমনকি ভারতীয় সংস্কৃতির অনুসঙ্গ দ্বারা তারা মারাত্মভাবে প্রভাবিত হয়ে হচ্ছে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তাদের কথনে, পোশাকে এমনকি খাদ্যাভ্যাসেও। এটিও আমাদের একুশের চেতনা সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এ বিষয়েও আমাদের নজর দিতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তাদের শেকড়মুখী করার পরিকল্পনা নিতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি যেন পালিত হয়, পরিশীলিত রুচি ও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির স্মারক দিবস হিসেবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আরও একটি প্রবণতা লক্ষ করছি। আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে একুশের চেতনা একটি বিশেষ দিনের উৎসবে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তরুণদের রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের ফ্যাশন হাউসগুলো তাদের বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। একুশের চেতনার বহিঃপ্রকাশ সংবলিত পোশাক পরিধান করে দলবেঁধে যেসব তরুণ-তরুণী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নামে উৎসবের মিছিলে শরিক হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকেই জানে না বায়ান্নর একুশের ঘটনা কী, কেন ঘটেছিল। এ লেখাটা শুরু আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেখছিলাম তাদের অনেকেই জানে না বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা কতটি। ২১ ফেব্রুয়ারি কত সালে কত সালের ঘটনা এবং এর উদ্দেশ্যই বা কী ছিল। এটি আমাদের কাছে কেবল বেদানাময় নয়, হতাশারও। আসলে আমাদের সমাজের সব পর্যায়ে বৈপরীত্য জেঁকে বসেছে। এরও প্রতিবিধান জরুরি। এ প্রজন্মকে বোঝাতে হবে একুশ মানে শুধু একটি দিন নয়। মায়ের ভাষায় কথা বলার, নিজস্ব সাংস্কৃতি ঐতিহ্য লালন করার প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের কাছে একুশ। তাই প্রতিদিনই এর চেতনাকে লালন করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এগোতে হবে। আর এজন্য অবশ্যই ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষা জানতে হবে। তার মানে এই নয়, আমরা নিজেদের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করব, নিজেদের স্বকীয়তা ভুলে যাব। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং আমাদের ভাষাকেই সামনে রেখে আমাদের বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

একুশের অর্জনকে, এর চেতনাকে একদিন বা একটি মাসের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে একে ছড়িয়ে দিতে হবে প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মাস ও দিবসে। আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শুদ্ধ শব্দ উচ্চারণে পরম মমতায় বাংলা ভাষার চর্চা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষা আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল গভীর আত্মচেতনা ও স্বাজাত্য অহংবোধের গভীর থেকে উৎসারিত আত্মদর্শন। কিন্তু আমাদের বিপরীত, বিসদৃশ, আত্ম-অবমাননাকর অর্বাচীনতা দিয়ে আমরা একুশের আত্মদর্শন, মূল্যবোধ ও চেতনাকে প্রতিদিন কুলষিত করছি।

এখন ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ এলেই অনেক বড় বড় বক্তৃতার ফুলঝুরি না ছড়িয়ে আমাদের কথায় কাজে মিল রেখে মহান ভাষা শহীদদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে আত্ম-আবিষ্কারে সক্রিয় থাকতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে একুশের চেতনা কেবল শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নয়, সাদা-কালো পোশাক পরে উৎসবে মেতে ওঠা নয়। একুশ আমাদের আত্মউপলব্ধি দিন। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের হাত থেকের রক্ষার দীপ্ত শপথের দিন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার এবং অন্যায়-অবিচারও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মাথা তুলে রুখে দাঁড়াবার দিন। নতুন প্রজন্ম এ সত্য উপলব্ধি করতে পারলেই আমাদের ভাষা শহীদদের প্রতি প্রকৃত সম্মান জানানো হবে। অর্জিত হবে একুশের সত্যিকারের চেতনা।

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান
অধ্যাপক, ঢাবি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ
[email protected]

 
Electronic Paper