বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী
দেওনাই নদীর ইতিকথা
ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:৪০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
বাংলাদেশে যে নদীগুলো আছে তার উৎস বিচিত্র। কোনো কোনো নদীর উৎস পাহাড়ি ঢলে। নদীর শাখা হিসেবেও সৃষ্টি হয়েছে কোনো কোনো নদীর। সমতলের নিচু ভূমি থেকে, বৃষ্টির পানিপ্রবাহ থেকেও নদীর উৎপত্তি হয়েছে। এসব উৎস হচ্ছে প্রাকৃতিক। এই প্রাকৃতিক নিয়মেই দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদীটিরও উৎপত্তি। দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদীটি দেওনাই নদীর শাখা নদী।
নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার ডোমার ইউনিয়নে দেওনাই নদীর সঙ্গে শালকি নামের একটি নদী মিলিত হয়েছে। শালকি নদী আরও খানিকটা উজানে বোড়াগাড়ী ইউনিয়নের পশ্চিম বোড়াগাড়ী গ্রামে চেকাডারা নদীকে উপনদী হিসেবে গ্রহণ করেছে। চেকাডারা নদীর পানি নিয়েই শালকি নদী দেওনাই নদীতে মিলিত হয়েছে। ফলে দেওনাই নদীর প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় শাখা নদীর সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় প্রবীণরাও জানেন না কত বছর আগে এ নদীর শাখা তৈরি হয়েছে। এতটাই পুরনো এ নদীর অতীত।
দেওনাই নদী উল্লিখিত দুটি নদীর পানি নিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর ডোমার ইউনিয়নে শালকি-দেওনাইর মিলনস্থল থেকে তিন-চার কিলোমিটার ভাটিতে হরিণচড়া ইউনিয়নের ধরধরার পাড় নামক স্থানে দেওনাইর শাখা সৃষ্টি হয়েছে। পুরনো দলিলে শাখা নদীটি দেওনাই নামেই উল্লেখ আছে। দেওনাই নদীর শাখা নদীটিকে এখানে চেনা এবং বোঝার সুবিধার্থে দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নামে উল্লেখ করা হলো। আমার লেখা ‘রংপুর অঞ্চলের নদ-নদী’ শীর্ষক গ্রন্থেও এমনটি উল্লেখ করেছি। নদীটি হরিণচড়া এবং লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি নীলফামারী উপজেলা সদর এবং ডোমার উপজেলাকে অনেক স্থানে আলাদা করেছে। যে স্থান দিয়ে নদীটি প্রবেশ করেছে সেই স্থানেই সরকারি উদ্যোগে একটি স্লুইস গেটও করা হয়েছিল।
২০১৭ সালে পানির ক্ষিপ্র বেগে স্লুইস গেটটি ভেঙে নদী খানিকটা পাশ দিয়ে বর্তমানে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র মতে, এ নদীটি ৮.২ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে বুড়িখোড়া নদীতে। বুড়িখোড়া নদী উজানে কলমদার নদী নামে পরিচিত। বুড়িখোড়া নদী ভাটিতে গিয়ে আবারও মূল দেওনাই নদীতে মিলিত হয়েছে।
বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে এ নদীটির কোনো স্থানে শুকিয়ে যায় কোনো স্থানে বারো মাস পানি থাকে। অতীতে অনেক স্থানে অত্যন্ত গভীর ছিল। শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে অনেকেই ধান চাষ করেন। যারা ধান চাষ করেন তারা নদীটিকে নিজেদের বলে দাবি করেন। দেশের অনেক নদীর মতোই এ নদীর অবস্থা। নদীর জমির মালিকানা ব্যক্তির হয় কীভাবে?
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেওনাই-চারালকাটা-যমুনেশ্বরী নামেই নদীর আলোচনা করেছে। আমরা ভাটিতে যে যমুনেশ^রী নদী পাই এই নদীর পানিতে মিশে আছে দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদীর পানি। যমুনেশ্বরী নদীর পানি ভাটিতে করতোয়া-বাঙ্গালী হয়ে সমুদ্র অভিমুখী হয়েছে। অর্থাৎ যে দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদীর কথা বলছি সেই নদীর পানিও এই প্রবাহেই প্রবাহিত হয়।
বাংলাদেশে অসংখ্য নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু দেওনাই নদীর উৎস এবং পতিত হওয়ার প্রবাহ ঠিক থাকার কারণে এখনো এ নদীর পানি সমুদ্র পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। ২০১৭ সালে নদীটিতে স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি মাছ ছেড়ে দিয়ে সর্বসাধারণদের মাছ ধরা বন্ধ করেছিল। এতে করে নদী-তীরবর্তী অনেক জেলে পরিবার বিপদেই পড়েছিল। স্থানীয় সাধারণ ব্যক্তিরা এর বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল। যারা মাছ ছেড়ে দিয়ে নদীটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল তারাও নদীর আইন-কানুন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত নন। হরিণচড়ার শেওটগাড়ী গ্রামে গিয়ে দলিলেও দেওনাই নদীর উল্লেখ লক্ষ করেছি। যারা দখলে নিতে চেয়েছে তারা জানে না, একটি শাখা নদীর পানি যে পথ ধরে প্রবাহিত হয়ে আবারও একটি নদীতে মিলিত হচ্ছে এই প্রবাহ সম্পূর্ণটাই নদী।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারংবার বলছেন নদীর প্রবাহ কোথাও বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। নদীর জমি কখনোই জলমহাল ঘোষণা করার সুযোগ নেই। যারা মাছ চাষের জন্য নদীর দখল নিচ্ছিল তারা হয়তো মনে করেছে, আমরা তো নদীকে বাধাগ্রস্ত করছি না। শুধু বাঁশের বেড়া দিচ্ছি। মূলত বাঁশের বেড়া দেওয়াটাই হচ্ছে এসব নদী ধ্বংসের প্রথম এবং অন্যতম কারণ। নদী মেরে ফেলার প্রচেষ্টা হিসেবে প্রথমত একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়। যে স্থানে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়, সেখানে মাটি জমে জমে ভরাট হতে থাকে। ধীরে ধীরে দুদিক বেঁধে নদীকে সঙ্কুচিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় এক সময় নদীটিকে মেরে ফেলা হয়। সে কারণে নদীর পানি যেভাবে প্রবাহিত হয় এই প্রবাহকে কোথাও বাধাগ্রস্ত করার কোনো সুযোগ নেই।
যে সব মানুষ মৎস্য চাষি সমিতি গঠন করে নদীতে মাছ ধরতে উদ্যোগী হয়েছে কিংবা দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদীকে জলমহাল ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে তারা জানে না, নদী যদি কখনো ভাঙতে ভাঙতে মূল নদী ছেড়ে অনেক দূরে যায় তাহলে মূল নদী থেকে শুরু করে বর্তমান নদী পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকাটাই নদীর হয়ে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিরা অজ্ঞতাবশত মনে করে যাদের জমির কাগজ আছে তারাই হবে নদীর মালিক। বাস্তবতা তা নয়। নদীর প্রবাহ পথের জমির কাগজ যারই হোক না কেন মালিকানা সরকারের। আর একবার যে পথে নদী প্রবাহিত হয় সেই প্রবাহিত পথ ব্যক্তি মালিকানায় আর দেওয়ারও সুযোগ নেই। ফলে দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদীর পানি যে পথে প্রবাহিত হচ্ছে তার মালিকানা সরকারের।
যে নদীর পানি সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে সেই নদীটির পরিচর্যা এখন জরুরি। এ নদীর ওপর ছোট এবং মাঝারি মিলে ছয়টি সেতু-কালভার্ট আছে, এসবের মধ্যে কোনো কোনোটি প্রয়োজনের তুলনায় খুব ছোট। সেগুলোরও সংস্কার করতে হবে। নদীর যে অংশে যেরকম প্রবাহ আছে তা বজায় রাখা না গেলে এ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। ওই এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা নদীর ঐতিহ্য সম্পর্কে গল্প করেন। একজন বলছিলেন ধরধর করে (শব্দ করে) প্রবাহিত বলেই উৎসমুখের এলাকার নামই হয়েছে ধরধরার পাড়। হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের সর্বসাধারণের উন্নয়নের জন্যই নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
সম্প্রতি নীলফামারীর বাংলাদেশ পানি উন্নয় বোর্ডের প্রকৌশলী এ নদীটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সরজমিনে মেপেছে। সেই মাপ অনেকটাই নিখুঁতভাবেই করা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সমস্ত মন্ত্রণালয়, বিভাগ নদী রক্ষায় সহায়তা দেওয়ার জন্য তৎপর রয়েছে।
নদীটি বর্তমানে মুক্ত আছে। এ নদীটি মুক্ত করার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। এটি একটি দৃষ্টান্ত। রিভারাইন পিপলের উদ্যোগে দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) সুরক্ষা কমিটি করা হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এ নদী রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, সার্বক্ষণিক সদস্য মো. আলাউদ্দিন নদীটি রক্ষায় সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডও সার্বিক সহায়তা দিয়েছে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে যে একটি নদী উদ্ধার করা যায়, এটি তার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। এই নদী উদ্ধার করার প্রক্রিয়া থেকে দেশের যে কোনো অঞ্চলের মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। তারাও নদী রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশে দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ) নদী উদ্ধার করা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
ড. তুহিন ওয়াদুদ
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]