চলে গেলেন সোনালি কাবিনের কবি
শফিক হাসান
🕐 ৯:৩২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৯
চিরবিদায় নিলেন বাংলা কবিতার জীবন্ত কিংবদন্তি আল মাহমুদ। জীবনে ও সৃজনে বহু বন্ধুর পথ পেরিয়ে অবশেষে চিরবিরাম লাভ করলেন এই প্রতিভাধর কবি-কথাসাহিত্যিক।
১১ জুলাই, ১৯৩৬-এ জন্মগ্রহণকারী এ কবির জীবন সরলরেখায় আবর্তিত হয়নি। পদে পদে হোঁচট খেতে হয়েছে; নানা রকম চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ঋদ্ধ হয়েছে তার শিল্পী-মানস। আসলে বহমান জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতউ একজন মানুষকে সত্যিকারের শিল্পীতে পরিণত করে। অনবদ্য ভূমিকা রাখে শিল্পীর সৃজন ও নির্মিতিতে।
শামসুর রাহমানের জীবদ্দশায় বাংলা কবিতার প্রসঙ্গে এলেই উচ্চারিত হতো দুটি নাম- শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। বাংলাদেশের কবিতাসাম্রাজ্যের অবিসংবাদিত দুই অধিপতি। যদিও শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের রাজনৈতিক দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীতমুখী। সেটা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও ব্যক্তিজীবনে কিঞ্চিৎ চিড় ধরালেও সাহিত্যসৃজনে পারেনি। দুজন এগিয়েছেন সমান্তরালে। কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও আল মাহমুদ প্রায় সব ধরনের রচনাতেই পারঙ্গম ছিলেন- গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিংবা গদ্যে। ছড়াকার হিসেবেও ছিল তার নামডাক। তিতাসপুত্র সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘদিন, জেলও খেটেছেন সে সূত্রে। প্রগতিশীল দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ সম্পাদনাকালে জেল খেটেছেন সত্তরের দশকে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ছাড়া পান।
পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় ১৯৭৫-এ আল মাহমুদ শিল্পকলা একাডেমিতে যোগদেন এবং ১৯৯৩-এ পরিচালক হিসেবে অবসর নেন। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- লোকলোকান্তর, কালের কলস, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, সোনালি কাবিন। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে’ কাব্যগ্রন্থটিও সমধিক পঠিত। সবকিছু ছাপিয়ে আল মাহমুদ সোনালি কাবিনের কবিই হয়ে আছেন। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে চার দশকেরও বেশি সময় আগে। রচনাকাল ছিল ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বইটি সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয়। এখনো বহুলপঠিত বইয়ের তালিকায় রয়েছে। অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। ‘সোনালি কাবিন’ আক্ষরিক অর্থেই বাংলা কবিতার সোনালি শস্য। সোনাঝরা প্রান্তরের পথপ্রদর্শক।
কবিতা নিয়ে রয়েছে নানামুখী প্রশ্ন ও ধোঁয়াশা। কবিতা কী- দীর্ঘকাল গবেষণার পরও সঠিক মীমাংসায় পৌঁছানো যায়নি। একেকজন একেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন কবিতাকে। আল মাহমুদ ‘কবিতা এমন’ শীর্ষক কবিতায় চমৎকারভাবে বিধৃত করেছেন বিমূর্ত এ ধারণাকে- ...কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস/ ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর/ গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর/ কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।
আল মাহমুদের কবিতায় চিরন্তন সত্য, অমীমাংসিত বিষয় এভাবে উঠে আসে অনায়াসসাধ্য প্রচেষ্টায়। তার কবিতায় রয়েছে গ্রামীণ আবহের বর্ণচ্ছটা, লোকজ উপাদান ব্যবহার করে চমৎকার বয়ন-কৌশল; ইসলামি মিথ এবং পুরাণের ব্যবহারও করেছেন নিপুণভাবে। ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে ধ্রুবসত্য। শহুরে জীবনের ফাঁদে পড়ে কীভাবে মানুষ নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে, হয়ে যায় শেকড়চ্যুত তার অকপট আখ্যান- সোনালি খড়ের স্তূপে বসতে গিয়ে প্রত্যাগত পুরুষ সে-জন/ কী মুস্কিল দেখলো যে নগরের নিভাঁজ পোশাক/ খামচে ধরেছে হাঁটু। উরতের পেশী থেকে সোজা/ অতদূর কোমর অবধি/ সম্পূর্ণ যুবক যেনো বন্দি হয়ে আছে এক নির্মম সেলাইয়ে।
‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের নামকবিতায় ‘ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি’- কাব্য-পঙ্ক্তি রূপ নিয়েছে প্রবাদে। মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় পঙ্ক্তিটি। এখানেই কবিতার শক্তি, কবির শ্রেষ্ঠত্ব। এ কবিতা পাঠে সামনে এগোলে পাওয়া যায়- ‘পূর্বপুরুষরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস/ বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়,/ সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।/ মুখ ঢাকে আলাওল- রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।/ এর চেয়ে ভালো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল?’
কবিতার পাশাপাশি গল্পেও আল মাহমুদ অতুল। তার গল্পে পাওয়া যায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজের নিখুঁত বর্ণনা। এমন সব চমক দেন যার জন্য পাঠক আদৌ প্রস্তুত থাকে না। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পগ্রন্থটি আজও বাংলা গল্পসাহিত্যের উজ্জ্বল প্রতিনিধিত্বকারী। উপন্যাসেও সমান প্রভাববিস্তারী আল মাহমুদ। কয়েকজন তরুণীর সমকাম, এক তরুণকে নিয়ে তাদের যে টানাপড়েন ও দ্ব›দ্ব বাক্সময় ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে ‘পুরুষ সুন্দর’ শীর্ষক নাতিদীর্ঘ উপন্যাসে। মুক্তিযোদ্ধা আল মাহমুদের অনন্যসাধারণ উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’। বৃহৎ ক্যানভাসের এ উপন্যাসে তিনি ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশিদের সংগ্রাম, টানাপড়েন, হাহাকার এবং উদ্বাস্তু জীবনের কথকতা। সর্বাবস্থায় সবকিছুর মধ্যেও বিরাজ করে প্রেম। ‘উপমহাদেশ’ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, এটা যেমন সত্য এটা যে প্রেমের উপন্যাস তাও সত্য। একজন মহৎ শিল্পী জানেন মিথস্ক্রিয়ার রসায়ন। একের ভেতরে বহুর সন্ধান দিতে তারা পারঙ্গম।
আল মাহমুদের সৃষ্টিসম্ভার বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। অনাগত কালেও বাংলা কাব্যে-সাহিত্যে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে তার জীবৎকালে তাকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে জিজ্ঞাসার অসংখ্য বুদবুদ। বিশেষ করে তার জামায়াতে ইসলামী কানেকশনে বিব্রত হয়েছেন অনেকেই, এবং এখনো হচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আল মাহমুদ শ্রদ্ধার আসনে আসীন ছিলেন।
আজ তিনি মরজগতের সব স্তূতি-নিন্দার সীমা পেরিয়ে চলে গেছেন অমরালোকে। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার অবিনশ্বর সোনালি পঙ্ক্তিমালা, যা দীপ্তি ছড়াবে পাঠকহৃদয়ে, কাল থেকে কালান্তরে।
শফিক হাসান : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]