বেকারের সংখ্যা বাড়ছেই
ওসমান গনি
🕐 ৯:০৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯
বর্তমানে বেকার সমস্যা মনে হয় বাংলাদেশে জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ সমস্যার কারইে একদিকে যেমন হচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, অপরদিকে বাড়ছে মাদকের অবাধ অপব্যবহার। যতই দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বেকারত্বের কারণে দেশের তরুণরা ঝুঁকে পড়ছে আত্মহননের দিকে। হতাশায় জীবন কাটাচ্ছে লাখ লাখ যুবক। কেউ কেউ নেমে পড়ছে অবৈধ পথে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় প্রতিবছর আট লাখ নতুন বেকার তৈরি হচ্ছে। প্রবৃদ্ধির সুবিধা সমানভাবে বিতরণ না হওয়ায় দেশে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে।
গত ১০ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘প্রবৃদ্ধি ও অগ্রাধিকার’ বিষয়ক সংলাপে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হলেও কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈষম্যের চিত্র উদ্বেগ বাড়িয়েছে। প্রতিবছর দুই লাখ মানুষ শ্রমবাজারে ঢুকছে, বিপরীতে চাকরি তৈরি হচ্ছে এক লাখ ৩০ হাজার। সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর আট লাখ মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে।
বেকারত্বের কশাঘাতে দেশ আজ বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শিক্ষিত বেকাররা কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে দিন দিন হতাশার সমুদ্রে ভাসছে। তারা নেশাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষিত বেকারের দিক দিয়ে দ্বিতীয়। দেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার মাত্র সাত বছরে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছে, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশ। ১০ দশমিক ৭ শতাংশ বেকার নিয়ে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে (যুগান্তর, ২০ জানুয়ারি ২০১৯)।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবৃদ্ধি হতো ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। অথচ বিগত পাঁচ বছরে সাড়ে ছয় শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ছে মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রেও এই প্রবৃদ্ধি সহায়ক নয়। গত এক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্য বিমোচন কমেছে (এনটিভি, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯)।
বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে, লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। ছোটবেলায় এ ছড়াটি শোনেনি এমন শিশু পাওয়া কঠিন। লেখাপড়া করে চাকরি পাবে, ভালো রোজগার করে উন্নত জীবনযাপন করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষরাই বেশি বেকার। তারা নিজেদের পছন্দমতো কাজ পান না। অন্যদিকে যারা কখনো স্কুলে যায়নি, শিক্ষার সুযোগ পায়নি তাদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে যত লোক বেকার, তাদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে দুজন উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। পড়াশোনা করে একটু ভালো কাজের সন্ধানে থাকেন তারা। কিন্তু মনমতো চাকরি পাচ্ছেন না।
অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষকদের মতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে ৫ লাখের বেশি উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই চাকরি পাচ্ছেন না। অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের মতে, সরকারি চাকরিতে শূন্য পদের বিপরীতে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই শিক্ষিতদের বেশ বড় একটি অংশ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। একই সঙ্গে সরকারি শূন্যপদগুলোও নিয়মিতভাবে পূরণ হয় না। আর বেসরকারি খাতে বর্তমানে বিশেষজ্ঞ, কারিগরি ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিতদের চাহিদা বেশি। এ কারণে প্রচলিত ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের বেসরকারি খাতে চাকরি পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।
একদিকে চাকরি না পাওয়ায় এসব শিক্ষিত জনবলকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে চাকরি না পাওয়ার হতাশা থেকে বেকারদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে নানা সামাজিক অপরাধে। আর চাকরি না পাওয়ার আশঙ্কা ও হতাশা থেকে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের একটি অংশ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ফলে তাদের মেধা ও সেবা দেশের কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
অনলাইনে চাকরির বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বিডিজবস’ থেকে জানা যায়, চাকরিপ্রার্থীরা প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ জীবনবৃত্তান্ত তাদের প্রতিষ্ঠানে রেজিস্ট্রেশন করেন। গত এক মাসে ৬-৭ হাজার সিভি জমা পড়েছে।
তিনি বলেন, একটি চাকরির বিজ্ঞাপন দিলেই প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার সিভি জমা পড়ে, যাদের বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ব্যাংকের চাকরিতে। একটি ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে অন্তত দেড়লাখ সিভি আসে।
আমাদের জিডিপি, অতিধনী-ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি বা উন্নয়নের গল্পে দেশের মুষ্টিমেয় লোক তুষ্ট হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের এতে কিছু আসে যায় না। একদিকে কিছু মানুষ তাড়াতাড়ি বড় রকমের টাকার মালিক হচ্ছেন, অন্যদিকে ব্যাপক জনগোষ্ঠী থেকে যাচ্ছে বেকার, হয়ে পড়ছে হতদরিদ্র।
ওসমান গনি : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]