প্রতিষ্ঠানে নয়, লেখাপড়া নিজের কাছে
রিয়াজুল হক
🕐 ৯:৪৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০১৯
জহির খুলনার হ্যানে রেলওয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায়। না, এটা তথাকথিত কোনো নামকরা স্কুল ছিল না। ওই বছর একমাত্র জহির সেখান থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। জহিরের বাসার খুব কাছে ছিল খুলনা কলেজ। এখানে ভর্তি হওয়ার জন্য অভিভাবক কিংবা শিক্ষার্থীদের লাইন লেগে থাকে না। অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানে যারা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না, তারা এখানে ভর্তি হয়। কলেজ বাসার কাছে হলে ক্লাস করতে সুবিধা হবে, সময় নষ্ট হবে না, শিক্ষকদের সঙ্গে জহিরের আব্বা সহজেই যোগাযোগ রাখতে পারবেন, এসব চিন্তা করেই জহিরের খুলনা কলেজে ভর্তি হওয়া।
যাই হোক, জহির এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পায়। তার সঙ্গে অন্য একজন সেই বছর কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। বুঝতেই পারছেন, ওপরের দুটি স্কুল-কলেজের ৭০ কিংবা ৮০ ভাগ শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পায় না। প্রতিবছর দু’একজন করে সেখান থেকে জিপিএ-৫ পায়। কোনো কোনো বছর হয়তো কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়ও না। আমরা সবাই জানি, কোনো শিক্ষার্থী যদি পঞ্চম শ্রেণিতে স্কলারশিপ পায়, অষ্টম শ্রেণিতে স্কলারশিপ পায়, এসএসসি/এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পায়, এরপর যদি ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে না পারে, তবে তার আগের সব ভালো লেখাপড়ার ইতিহাস অনেকাংশে ব্যর্থ হয়ে যায়।
জিপিএ-৫-এর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে যদি প্রতিষ্ঠানের নামধাম নির্ধারণ করা হয়, সেই অর্থে ওপরের দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিশ্চয়ই নামধামওয়ালা হবে না। তবে সেখানে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে কেউ নম্বর কম পায় না, কোনো শিক্ষার্থী একটু ভালো করলে শিক্ষকরা আরেকটু চেষ্টা করে যাতে সেই শিক্ষার্থী আরও ভালো করে, কোনো শিক্ষার্থী খারাপ করলে শিক্ষকরা নিজেরা তাদের বাসায় চলে যায় এবং অভিভাবকদের বিষয়টা সম্পর্কে অবহিত করেন। যাই হোক, জহিরের খুব ইচ্ছা ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ার। আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ দেশের অত্যন্ত নামকরা প্রোগ্রাম, এটা অনেকেই জানেন।
এইচএসসি পাস করার পর সে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েই সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএতে চান্স পায়। এখন আপনারাই বলেন, নার্সারি/প্লেতে আপনার সন্তান কয়টি বই পড়ত, কোন প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি/এইচএসসি পাস করেছে, এটা কি কোনো গুরুত্ব বহন করে? মূল বিষয় হচ্ছে, লেখাপড়া করা। সেটা আপনি যেখান থেকেই করেন না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না।
বর্তমানের অভিভাবকরা অনেক শিক্ষিত। তারা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন। নচিকেতার একটা গানের কথা মনে পড়ে গেল, ‘বাচ্চা হবেই শুনে চারিদিকে খোঁজ খোঁজ/কয়টা ভালো স্কুল আছে আলোচনা রোজ রোজ।’ বাচ্চা হওয়ার দিন থেকেই উদ্বিগ্নতা শুরু। এই উদ্বিগ্নতা দূর করার জন্য সারা দিন বাচ্চাকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে দৌড়ে বেড়াবে কিন্তু নিজে সারা দিনের মধ্যে ৩০ মিনিট অবুঝ বাচ্চাকে পড়াবে না। আপনি বিএ, এমএ পাস করেছেন। অথচ আপনার সন্তানকে পড়াচ্ছেন ইন্টারমিডিয়েট পাস করা কারও কাছে।
আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। অথচ আপনি যে কোচিং সেন্টারে সন্তানকে পড়াচ্ছেন, সেই শিক্ষক হয়তো লেখাপড়ায় আপনার ধারের কাছেও ছিল না। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে। আপনি আপনার শিক্ষা, মেধা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করছেন কিন্তু নিজের সন্তানের জন্য ব্যয় করছেন। শুধু টাকা খরচ করলেই সব হয় না। দিনের মধ্যে কি বাবা-মায়েরা ৩০ মিনিট করে ১টা ঘণ্টা সন্তানের জন্য ব্যয় করতে পারেন না? যদি পড়াতে সময় না পান, আপনার সন্তানের হাত ধরে রাস্তায় এক ঘণ্টা করে ঘুরে বেড়ান। তাতেও আপনার অবুঝ শিশুটি তার সব সমস্যা আপনাকে বলতে সাহস পাবে।
বাবা-মায়েরা তৈরি জিনিস চায়। শিক্ষকরা তাদের সন্তানদের ভালো ছাত্রছাত্রী বানিয়ে দেবে, এটাই এখন সব অভিভাবকদের প্রত্যাশা। এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা। প্রাইভেট না পড়লে যদি ছাত্রছাত্রীরা নম্বর কম পায়, তবে অনেকেই বাসায় পড়ার চেয়ে প্রাইভেট পড়ার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠে। এতে করে লেখাপড়ার প্রতি এক ধরনের ভয় তৈরি হয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়ায় যদি ভয়ভীতি ঢুকে যায়, তবে সেটা ভালোভাবে বুঝেশুনে সম্পূর্ণ করা অনেক কঠিন হয়ে যায়।
প্রায়ই শোনা যায়, ছোট ছোট শিশুরা স্কুলে যেতে চায় না। চাইবে কেন বলেন? ৭-৮ বছরের বাচ্চার পাঠ্যবই দেওয়া হচ্ছে ১১ কিংবা ১২টি। কোনো নিয়মকানুন আছে? আমাদের অভিভাবকদের আবার সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোর প্রতি আবার ভীষণ এলার্জি। সেখানে লেখাপড়া হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক সমস্যা। এত ছোট বয়সে বেশি লেখাপড়া দিয়ে কি হবে? অল্প অল্প করে শিখুক। আপনি বাসায় শেখান। লেখাপড়ার প্রতি বাচ্চাদের কেন ভয় ধরিয়ে দিচ্ছেন?
কিছু বিষয়ের প্রতি অভিভাবকদের মনোযোগী হওয়া উচিত-
১. নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পেছনে ছুটে বেড়ানোর প্রয়োজন নেই। যেসব শিক্ষিত বাবা-মা আছেন, তাদের উচিত লেখাপড়ার জন্য সন্তানদের সময় দেওয়া। নিজেদের সন্তানদের নিজেরাই পড়ান। প্রয়োজনে শিক্ষক রেখে পড়ান।
২. ক্লাস ওয়ান, টুয়ের বাচ্চাদের কাছে প্রত্যাশার চাপ রাখবেন না। তোমাকে অঙ্কে ১০০ পেতে হবে, আরেকটু পারলে ইংরেজিতে ৯৫ নম্বর হয়ে যেতে কিংবা ক্লাসে প্রথম হতেই হবে, এ ধরনের কথা থেকে বিরত থাকেন। সন্তান ক্লাস টেস্টের কোনো পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে অনেক বাবা-মা তো দিনরাত কান্নাকাটি করেন। এর থেকে যদি বাবা-মা অশিক্ষিত হতো, তবে সন্তানরা চাপ ছাড়া পড়ালেখা করতে পারত।
৩. প্রাথমিক পর্যায়ে বাড়ির পাশের স্কুলে ভর্তি করান। এতে করে কোমলমতি বাচ্চাটার যাতায়াতের ধকল পোহাতে হবে না। আপনিও সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখতে পারবেন।
৪. অনেক অভিভাবক এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে অবজ্ঞা করেন। এটা ঠিক না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বইয়ের সংখ্যা কম, বাচ্চাদের উপযোগী করেই বইগুলো তৈরি করা হয়, অতিরিক্ত বইয়ের চাপও থাকে না। তা ছাড়া প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা সরকারি বইগুলোর ওপর হয়। অনেক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ১১-১২টা বই পড়ানো হয়। এত বইয়ের চাপ অবুঝ বাচ্চাগুলোকে দিয়ে লাভ কি? অভিভাবকদের একটু চিন্তা করা প্রয়োজন।
৫. সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখুন। স্কুলে, কোচিংয়ে যে আপনার সন্তান কোনো ধরনের শারীরিক, মানসিক নিপীড়নের স্বীকার হলে জানার চেষ্টা করুন। বাবা-মাকে যদি সন্তান বলতে না পারে, তবে তাদের মধ্যে ভয় কাজ করবে, লেখাপড়ায় কখনো মনোযোগী হতে পারবে না। বেশি সমস্যা মনে হলে অবশ্যই সন্তানকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসুন। ওমুক স্কুলে না পড়লে আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
একটা অভিযোগ শোনা যায়, টাকা-পয়সা দিয়ে নাকি কিছু স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হয়। এটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলবে। কোনো জায়গায় চাকরি না পেয়ে যদি কেউ শিক্ষকতা পেশায় আসে, তবে তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আমাদের এক ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন শরাফাত স্যার।
স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক। সম্ভবত, ১৯৬২ সালের দিকে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। আমি ছিলাম তার অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর আগের ব্যাচের শিক্ষার্থী। ইংরেজির শিক্ষক হলেও বাংলা ব্যাকরণে তার ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য। তিনি সরকারি চাকরি পাওয়ার পরেও সেখানে যোগদান না করে স্কুলে চাকরি করেছিলেন। ছাত্রদের ভালো রেজাল্টের মধ্যেই তিনি সব সুখ খুঁজে পেতেন।
আমার স্কুল জীবনের একটা ছোট ঘটনা দিয়েই আজকের লেখা শেষ করব। একবার আমাদের ক্লাসের এক ছেলে নকল করার জন্য ধরা পড়ে গেল। প্রধান শিক্ষক তাকে পরীক্ষা শেষে তার রুমে ডেকে নিলেন।
তাকে একটু রাগ করেই বললেন, তোর আব্বা তোকে মানুষ করার জন্য দিনরাত রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে ফেরি করে সামান্য কিছু আয় করে। তোকে প্রাইভেটও পড়াচ্ছে। আর তুই নকল করলি? তোর আব্বা শুনলে কত কষ্ট পাবে, ভেবে দেখছিস? ওই ছেলে প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, যদি একটা লাইনও পরীক্ষার খাতায় লিখতে না পারি, তবু আর কখনো নকল করব না।
আমাদের সন্তানরা অনেক সংবেদনশীল। তাদের পিটিয়ে নয়, সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারলে, প্রত্যেকেই এভারেস্ট জয় করে ফেলতে পারবে। যখন স্কুলে পড়তাম, তখন প্রায়ই শুনতাম লেখাপড়া নিজের কাছে। প্রতিষ্ঠান কখনো কাউকে লেখাপড়া শেখাতে পারে না। একথাটা আমরা সবাই বিশ্বাস করি, মানি না। এটা আমাদের মেনে নিয়ে সন্তানদের একটা ভয়হীন জীবনের খোঁজ দেওয়া সব বাবা-মায়ের দায়িত্ব।
রিয়াজুল হক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
[email protected]