নটর ডেম কলেজের ৭০ বছর
সাইফুল আলম
🕐 ৯:২৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০১৯
পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে নটর ডেম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন কলেজের নাম ছিল সেন্ট গ্রেগরি কলেজ। এটি রোমান ক্যাথলিক হলিক্রস মিশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল মূলত, সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সম্প্রসারিত রূপ। ১৯৫৪-৫৫ সালে কলেজটি আরামবাগ, মতিঝিলে স্থানান্তরিত হয়। কলেজের নতুন নামকরণ করা হয় নটর ডেম কলেজ। নটর ডেম বলতে বোঝায় মেরি বা মরিয়ম, যিশুখ্রিস্টের মাতা। কলেজের মটো ‘প্রজ্ঞার আলো কে ভালোবাসো।’
পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনের নিরিখে ওই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নটর ডেম কলেজের প্রথম দিককার অধিকাংশ শিক্ষকম-লী ছিলেন আমেরিকার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। ১৯৮০ সালের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলোর মধ্যে নটর ডেম কলেজের খ্যাতি দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল এবং নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের একচেটিয়া আধিপত্য কলেজটিকে ঈর্ষণীয় খ্যাতির দিকে ধাবিত করে। সে ধারা আজও অব্যাহত আছে।
নটর ডেম কলেজে প্রতিবছর বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় ২১০০ জন। মানবিক বিভাগে ভর্তি হয় ৪০০ জন। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হয় ৭৫০ জন। বিজ্ঞান বিভাগের ১৪টি সেকশন বাংলা মাধ্যমের, ২টি সেকশন ইংরেজি ভার্সনের। মানবিক বিভাগের তিনটি সেকশন, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৬টি সেকশন। ভর্তির ক্ষেত্রে নটর ডেম কলেজ সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে না। ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে। গ্রাম ও শহরের প্রার্থীর ক্ষেত্রে চাহিদাকৃত জিপিএ সমান নয়। ফলে মফস্বল থেকে ভালো শিক্ষার্থী নটর ডেম কলেজে পড়ার সুযোগ পায়।
সংখ্যালঘু গারো খ্রিস্টানরা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পড়ার সুযোগ পায়। তত্ত্বীয় ক্লাস ও ব্যবহারিক ক্লাস সমান গুরুত্ব দিয়ে করানো হয়। নিয়মিত কুইজ পরীক্ষা হয়। কলেজের কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার কারণে শিক্ষাক্রম কোনোক্রমেই বাধাগ্রস্ত হয় না। এর ফলেই শিক্ষার্থীর ফলাফল ভালো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্য বজায় থাকে।
নটর ডেম কলেজের সহ-শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলে। এ কলেজে সহ-শিক্ষাক্রমের ২৩টি ক্লাব রয়েছে। এগুলো হলো- নটর ডেম ডিবেটিং ক্লাব, নটর ডেম বিজ্ঞান ক্লাব, নটর ডেম অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, নটর ডেম রোভার গ্রুপ, নটর ডেম বিজনেস ক্লাব, নটর ডেম চেস ক্লাব, নটর ডেম মানবিক সংঘ, নটর ডেম নেচার স্টাডি ক্লাব, নটর ডেম ডিগ্রি ক্লাব, ইয়ুথ রেড ক্রিসেন্ট ক্লাব, নটর ডেম রোটার্যাক্ট ক্লাব, নটর ডেম নাট্য দল, নটর ডেম আবৃত্তি দল, নটর ডেম ইতিহাস ক্লাব, নটর ডেম ইকো ও স্পেস ক্লাব, নটর ডেম ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যান্ড রিলেশন ক্লাব, নটর ডেম কালচারাল ক্লাব, নটর ডেম লেখককুঞ্জ, নটর ডেম ইংলিশ ক্লাব, নটর ডেম আর্ট ক্লাব, নটর ডেম গণিত ক্লাব, নটর ডেম ইথিংস ক্লাব, নটর ডেম ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি ক্লাব। নটর ডেম ডিবেটিং ক্লাবকে বলা হয় বাংলাদেশের ডিবেটিং ক্লাবের জনক। নটর ডেম বিজ্ঞান ক্লাব বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিজ্ঞান ক্লাব। ওই ক্লাবগুলোতে শিক্ষকরা মডারেটর থাকলেও মূলত, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনে ওই ক্লাবগুলোর ভূমিকা তাৎপর্যময়।
নটর ডেম কলেজের বার্ষিক প্রকাশনা ‘ব্লুএন্ড গোল্ড’, শিক্ষার্থীদের লেখাকে উৎসাহিত করতে ত্রৈমাসিক ‘ঢাক-ঢোল’ ও ‘চিটচেট’ প্রকাশিত হয়ে থাকে। নটর ডেম কলেজের প্রত্যেকটি ক্লাবের নিজস্ব প্রকাশনা আছে। নটর ডেম বিজ্ঞান ক্লাব প্রকাশ করে ‘আধুরী’, নটর ডেম নেচার স্টাডি ক্লাব থেকে প্রকাশিত হয় ‘নিসর্গ’। নটর ডেম কলেজের ২৩টি ক্লাবের প্রকাশনায় শিক্ষার্থীরা যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে তা অকল্পনীয়। ছাত্রদের সুকুমারবৃত্তির প্রকাশ ও বিকাশে ওই প্রকাশনা তাৎপর্যপূর্ণ।
রোমান ক্যাথলিক হলিক্রস মিশন, ঢাকার ফাদাররা নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরা হলেন- জন জে হেরিংটন (১৯৪৯-৫৪), জেমস এল মার্টিন (১৯৫৪-৬০), থিউটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলি (মার্চ-১৯৬০-অক্টোবর-১৯৬০), উইলিয়াম গ্রাহাম (১৯৬০-১৯৬৭), জন ভেনডেন বসিই (১৯৬৭-৬৯), যোশেপ এস পিশোতো (১৯৬৭-১৯৬৯), রিচার্ড টিম (১৯৭০-১৯৭১), এমব্রোস হুইলার (১৯৭১-৭৬), যোশেপ এস পিশোতো (১৯৭৬-১৯৯৮), বেঞ্জামিন কস্তা (১৯৯৮-২০১২), হেমন্ত পিয়াস রোজারিও (২০১২-অদ্যাবধি)। এদের মধ্যে ফাদার টিম জীববিদ্যা বিশারদ হিসেবে খ্যাতিমান।
তিনি নটর ডেম বিজ্ঞান ক্লাব ও নটর ডেম ডিবেটিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। নটর ডেম কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে জাতীয়ভাবে পরিচিত শিক্ষকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। যারা সারা দেশব্যাপী পরিচিত তারা হলেন- নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা, জীববিদ্যা গ্রন্থের লেখক গাজী আজমল, শিক্ষাবার্তা সম্পাদক এ এন রাশেদা। এখানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ও হিন্দুদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। নটর ডেম কলেজের শিক্ষকরা আন্তরিক, নিয়মনিষ্ঠ। জাতির প্রত্যাশিত উদার মানবতাবাদী শিক্ষার সম্প্রসারণে তারা অবদান রেখে চলেছেন।
নটর ডেম কলেজের সাবেক ছাত্ররাই কলেজটি সারা বিশ্বে পরিচিত করে তুলছে। নটর ডেম কলেজের অ্যালামনাই সদস্যরা বিভিন্ন স্তরে জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক আবদুল মঈন খান, ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহফুজ আনাম, সাবেক সচিব ড. সৈয়দ আবদুস সামাদ, সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্য জাহিদ মালেক, ইয়াফেস ওসমান, গোলাম দস্তগীর গাজী, ডা. মুরাদ হাসান, সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী, বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, বর্তমান বিমানবাহিনীপ্রধান মাশিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, জাতিসংঘের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, তপন চৌধুরী, চেয়ারম্যান স্কয়ার গ্রুপ, ফরিদুর রেজা সাগর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চ্যানেল আই, শাইখ সিরাজ, বার্তা সম্পাদক চ্যানেল আই, মাইলস-এর সংগীত শিল্পী হামিন আহমেদ, দলছুটের বাপ্পা মজুমদার, ফুয়াদ আল মুকতাদির, সংগীতজ্ঞ, সংগীত শিল্পী তাহসান, চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, নাট্য নির্দেশক ও নাট্যশিল্পী আজাদ আবুল কালাম, প্রথম এভারেস্ট শৃঙ্গ বিজয়ী মুসা ইব্রাহিম। নটর ডেম কলেজ তার পথচলার ৭০ বছর পূর্ণ করেছে। ৫ বছর পরই কলেজটি হীরকজয়ন্তী পালন করবে। এরপর আছে শতবর্ষ উদযাপনের জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা। নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের এক্স নটর ডেমিয়ান বলে পরিচয় দেয়। এ পরিচয় তাদের গর্বের ও আত্মমর্যাদার। রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের জন্য যে মানবসম্পদ প্রয়োজন সে মানবসম্পদ সরবরাহ করছে নটর ডেম কলেজ।
ড. সাইফুল আলম
সহকারী অধ্যাপক, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ
[email protected]