ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাঠে-ঘাটে-বাটে

ব্যক্তিমাত্রই জীবন্ত ইতিহাস

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:২৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০১৯

সময় গড়িয়ে চলে। আর এরই মাঝে সমাজে কত বিচিত্র পরিবর্তন সূচিত হয় তার কোনো অন্ত নেই। মোটা দাগে হয়তো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের গল্প আমাদের লেখা থাকবে। হয়তো এটাও লেখা থাকবে, আমাদের কষ্টে থাকা গ্রাম জনপদের মানুষের জীবন-জীবিকার অনেক কাহিনীও। কিন্তু, সবটুকুই কি লেখা সম্ভব?

মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হাজার বছরের অধীনতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই মুক্তিযুদ্ধের সবটুকুও কি লেখা সম্ভব হয়েছে? কিছু কিছু ঘটনা লিখিত হয়েছে মাত্র। অযুত ঘটনার মধ্যে সামান্য কিছু ঘটনাই লিখিত হয়েছে। যুদ্ধকালে দেশজুড়ে দীর্ঘ ৯ মাসে কোটি কোটি ঘটনা ঘটেছে। সমাজে যত মানুষ আছে তাদের ব্যক্তিবিশেষে ব্যক্তিক পর্যালোচনা, মূল্যায়ন, দর্শন স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য সাধারণ থেকে সমাজের উচ্চশ্রেণিভুক্তদের যে কোনো কারও হতে পারে। মানুষ মাত্রই মহান। মানুষ মাত্রই অনেক বড় কিছু। হোক তিনি বিশেষ কিংবা সাধারণ।


সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক অসাধারণ গল্প থাকে। কয়েক দিন আগে এমন একজনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়। কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে একই সঙ্গে বাসে উঠি। দুজনের গন্তব্য রংপুর। বাসটি খুব ধীরে ধীরে চলছিল। রাজারহাট থেকে রংপুরের দূরত্ব মাত্র ৩২ কিলোমিটার। এটুকু পথেই ২ ঘণ্টা সময় নিয়েছে বাসটি। পাশের সিটে বসা সহযাত্রী লোকটির নাম ওমর আলি। পরনে লুঙ্গি আর সোয়েটার। চোখে-মুখে তার আত্মবিশ্বাস। সুখী জীবনের বয়ান তার ভাষ্যেই উঠে আসছিল। তিনি ৪৭ বছর ধরে ব্যবসা করেন। বয়স প্রায় ৫৮ বছর। শৈশবেই ব্যবসার হাতেখড়ি। জীবনের শুরুতে লবণের ব্যবসা করতেন। যার সঙ্গে ব্যবসা করছিলেন তার ধূর্ততা তিনি টের পেয়েছিলেন। যৌথ ব্যবসা নিয়ে অংশীদারের সঙ্গে মতভেদ চরমে উঠলে লবণের ব্যবসা ছেড়ে দেন।

শুরু করেন কাপড় ফেরি করে বিক্রি করা। কম পুঁজিতে সহজ ব্যবসা। উত্তরাঞ্চলে আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে ভারতের কাপড় কালোবাজারিরা এনে বিক্রি করতেন। অসংখ্য নারীও এই পেশায় যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন ওমর আলী সেই ব্যবসা করতেন। এই কাপড়গুলো বিক্রি করতেন গ্রামে গ্রামে ফেরি করে। প্রধানত ক্রেতা ছিলেন নারীরা। নারীরা ধান, গম, সুপারি, বিভিন্ন ধরনের সবজি, মুরগি কিংবা মুরগির ডিম, অন্যের বাড়িতে কাজ করে জমানো টাকায় এই কাপড় কিনতেন গ্রামের নারীরা। বিষয়-সম্পত্তিওয়ালারাও কিনতেন, তবে কম কিনতেন। সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করার পর ভারতের কাপড় বাংলাদেশে অবৈধভাবে আসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন এই ভারতের কাপড়ে যারা ব্যবসা করতেন তাদের অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দেন। কেউ কেউ বাংলাদেশি কাপড় পাইকারি কিনে ব্যবসা অব্যাহত রাখেন। ওমর আলি তাদেরই একজন।

হাটবাজারে তার কাপড়ের কোনো নির্দিষ্ট দোকান কোনো কালেই ছিল না। একসময় তিনি সপ্তাহে চারটি হাটে কাপড় বিক্রি করতেন। বৃহস্পতিবার, রোববার সিঙ্গারডাবরি হাট এবং বুধবার, শনিবার রাজারহাট। কখনো কখনো আরও দূরে যেতেন। এখন যান না কেন এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘এলা রাস্তার মোড়ে মোড়ে অনেক দোকান হইচে। হাট জমে কম। তাই দূরে আর যাওয়া হয় না। আগে হাটে হাটে যাওয়া যে ব্যবসায়ীদের নামডাক ছিল, তাদের অনেকেরই এখন আর ব্যবসা নাই।’

জীবন সম্পর্কে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ১০-১১ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক কথাই তার মনে আছে। পাকিস্তানি আর্মিরা তাদের গ্রামে আসতেন। গ্রামে একজন রাজাকার ছিলেন। সেই রাজাকার পাকিস্তানি আর্মিদের পথ চেনাতেন। একবার ওমর আলির বাবাকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরেছিলেন। ছোট বয়সে তারা বিভিন্ন বাড়ি থেকে মুরগি ধরে এনে দিয়ে বাবাকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। পাকিস্তানি আর্মিরা তাদের গ্রামের ছাগল-মুরগি ধরে নিয়ে যেত। ওমর আলিরাও কখনো কখনো মুরগি ধরে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়ি অনেকেই পাহারা দিয়ে রাখতেন। রাজার হাটের জমির আলির ছেলেকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেছিল। সেই কাহিনী তিনি বলছিলেন।

একবার তারা হিন্দুদের কিছু ধান কিনেছিলেন। সেই ধান এনে বাড়িতে যখন ঢেলেছেন তখন সেই ধানের ভেতর অনেকগুলো টাকা পেয়েছিলেন। ওমর আলি বলছিলেন, পাকিস্তানিদের হাত থেকেই হয়তো রক্ষা করার জন্য তারা টাকাগুলো ধানের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

ওমর আলি নিজেকে খুব সুখী মানুষ বলছিলেন। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার কারণে লেখাপড়া বেশি করতে পারেননি। কষ্ট বলতে সেটাই। মা আর বিয়ে করেননি। ছোটবেলা থেকেই তাই তাকে কাজ করে টাকা উপার্জন করতে হয়েছে। তার দুই ছেলেমেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে লেখাপড়া করছে। জীবনে কোনো দিন ঋণ করেননি। একবার বিপদে পড়েছিলেন। সৈয়দপুর থেকে কাপড়ে কিনে ফিরছিলেন। এমন সময় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। তার মা তাকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু এই ব্যবসা ছাড়া তো তার আর কোনো অবলম্বন নেই। তাই ব্যবসা বন্ধ করতে পারেননি।

তিনি বলছিলেন, সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা। তার বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায়। কুড়িগ্রাম থেকে রাজারহাট হয়ে তিস্তা পর্যন্ত শুধু রেললাইন ছিল। সরু পথে কোনো রকম একটি সাইকেল চালানো যেত। রাজারহাট থেকে অনেক দিন হেঁটে হেঁটে তিস্তা পর্যন্ত গিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলছিলেন, ‘রাস্তা পথের যোগাযোগ ছিল না। এলা কত বড় রাস্তা হইছে। রংপুর শহর ছিল যেমন তেমন একটা শহর। সেই শহর এলা কত সুন্দর হইছে।’

অনেক মানুষ আছেন যারা রাজনীতিতে আগ্রহ বোধ করেন না। তেমনই একজন হচ্ছেন ওমর আলি। রাজনীতির প্রসঙ্গ তুললে তিনি বললেন, ‘হামরা রাজনীতির কি বুঝি ভাই! দেশ কাঁয় চালায় চালাউক। হামরা ওইগুলার খবর নেইনা।’

তিনি এনজিও থেকে ঋণ নেন না। কেন ঋণ নেন না একথার উত্তরে বললেন, ‘এম্নি ভালো আছি। লোন নিয়া বিপদ হয়। সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তি দেওয়া নাগে। লোন না নিয়ায় ভালো আছি। কোনো দিন সাতশ-আটশ টাকাও কামাই হয়। যদ্দিন বাচি আছি লোন নিবার নই। গ্রামোত অল্প মানুষ ছাড়া সবাই লোন নেছে।’

জীবনে কোনো অতৃপ্তি আছে কি না, ওমর আলির কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তার কথায় বুঝলাম তার জীবন নিয়ে বড় কোনো পরিকল্পনা ছিল না। দিন আসে দিন যায়। প্রতিদিন ঠিকমতো খাওয়া-পরা-থাকার চাহিদা পূরণ হলেই তার হলো। এর বেশি তার কোনো চাওয়া নেই। স্বামীর বাড়িতে মেয়ে ভালো আছে। ছেলে যদি কোনো দিন কোনো চাকরি পায় তাহলেই খুশি।

সমাজের প্রতিটি মানুষই যেন ইতিহাস। বয়স যত বাড়ে ইতিহাসও যেন ততই দীর্ঘতর হয়। ৬০ বছরের একজন মানুষ ৫০ বছরের প্রত্যক্ষ করা সমাজের নিখুঁত বর্ণনাকারী হতে পারেন। অথচ, জন্মের আগের ৫০ বছরের ইতিহাস-সময়-সমাজ বুঝতে আমাদের কত বই পড়তে হয়।

ওমর আলিরও একটি জীবন। এই জীবনে গভীর কোনো দুঃখের ছায়াপাত নেই। আমাদের সমাজে এ রকম লাখো ওমর আলি আছেন। যাদের জীবনের পরিধি সামান্যতেই ব্যপ্ত আছে। তবুও সেই জীবনে সুখের অন্ত নেই। রাষ্ট্র-রাজনীতি-ঈর্ষা-দ্বেষ কোনো কিছুর মধ্যে নিজের সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান ওমর আলি। তিনি বলছিলেন, অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির পতন দেখেছেন, অনেক সাধারণ মানুষের বিত্তশালী হওয়া দেখেছেন। কিন্তু নিজে এর কোনোটিতেই পড়েন না। সামান্যতেই তিনি খুশি।

রংপুরে তার গন্তব্যের সামান্য আগে আমার গন্তব্য। তিনি নামবেন রংপুরের শাপলায়, আমি পার্কমোড়ে। নামার আগে তিনি বললেন, ‘আপনার বাবার কাছে অনেক চিকিৎসা নিছি। এক দিন বাড়ি আইসেন। খুব খুশি হমো।’ আমিও বললাম আমার বাসায় অথবা ভার্সিটিতে আসার। এক গাল হাসি হেসে তিনি বললেন, ‘ছেলেটা আগামী বছর ভর্তি পরীক্ষা দেবে। দোয়া করেন।’ আপনার ছেলের জন্য অনেক দোয়া রইলো-একথা বলতে বলতে নিচে নেমে এলাম। ওমর আলির বাসের চাকা তখন ঘুরতে শুরু করেছে।

ড. তুহিন ওয়াদুদ
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]

 
Electronic Paper