নারীরাও কাজ করেন
অমৃতা নন্দী
🕐 ৯:৪২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০১৯
‘আমার মা কাজ কোরো না।’ একজন মহিলা বেতনধারী কাজ করেন না, এটা বোঝানোর জন্য দেশে দেশে এ কথাটা শোনা যায়। ‘সমক্ষমতায়ন : কীভাবে নারীর সমতা বৈশ্বিক বিকাশে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অবদান রাখতে পারে’ শীর্ষক ম্যাককিনসে’র সম্প্রতি এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে ‘বাড়িতে থেকে যাওয়া’ মহিলারা সরাসরি দেশের জিডিপির শত শত কোটি টাকার ক্ষতি করে। এর মানে হলো, প্রতিটি মহিলাকে ‘কাজ’ করতে হবে। আরও নারী শ্রমশক্তিতে যুক্ত হলে ভারতের জিডিপি ২০২৫ নাগাদ ১৬ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
এ ক্ষেত্রে নারীদের ‘কর্ম’ এবং ‘কর্মহীনতা’ শব্দ দুটোর মৌলিক অর্থ কিছুটা বিভ্রান্তিকর। কেউ যদি অসুস্থ বা অক্ষম না হয়, সে ক্ষেত্রে কর্মহীনতা এবং উপার্জনহীনতা এক কথা নয়। কন্যা, বোন, স্ত্রী বা মা হিসেবে বেশিরভাগ নারী সারাদিন গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকে, এবং পণ্য, উৎপাদন ও সেবা বাজারে বিক্রি হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। সন্তানের লালনপালন ছাড়াও তারা পরিবারের যত্নআত্তির অনেক কাজও করে থাকে। এসব কাজ আর বেতনধারী চাকরির মধ্যে তফাতটা হলো বেতন বা মজুরির।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতে ‘কর্মহীন’ বা চাকরিহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭২ কোটি ৮৯ লাখ। এদের মধ্যে ১৫ কোটি ৯৯ লাখ জন (৯৬.৫ শতাংশ) বলেছে তাদের প্রধান কাজ হলো গৃহকর্ম, এবং এরা সবাই নারী। নারীবাদী অর্থনীতিবিদরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, নারীদের বেতনবিহীন কাজের অর্থমূল্য (ভারতের দক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম বেতনের গড়পড়তা হিসেবে) বছরে প্রায় ১৬ লাখ কোটি রুপি।
মহিলাদের নানা রকমের বেতনহীন দক্ষ কাজ সরাসরি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে। এসব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নারীরা অন্য সব ধরনের শ্রমকে সম্ভব করে তোলে।
গবেষণাটি থেকে দেখা গেছে, পুরুষরা যদি আরও বেশি সময় ঘরের কাজে দেয়, এবং এভাবে নারীদের আরও বেশি করে বেতনভোগী কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেয়, তা হলে নারীদের করা মজুরিপ্রাপ্ত এ বাড়তি শ্রমের সুবাদে জিডিপি বাড়বে। কিন্তু বেতনহীন সেবাকর্মগুলো যদি জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত না হয়, তবে যেসব ক্ষেত্রে পুরুষরা আরও বেশি পরিমাণে মজুরিহীন গৃহকর্মে অংশ নেয় সেখানে জিডিপিতে পুরুষদের অবদানের পরিমাণের নিম্নাভিমুখিতা নতুন করে হিসেব করতে হবে। নারীবাদী অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনীতিতে নারীদের উৎপাদনশীলতার এ অবমূল্যায়ন সমাজে তাদের অবস্থানকে দুর্বল করে এবং ত্রুটিপূর্ণ নীতিমালার সৃষ্টি করে। নারীদের বাজারবহির্ভূত কাজগুলোকে যদি মজুরির আওতায় এনে জিডিপিতে যোগ করা না হয়, তা হলে ভুল হিসাবের চলমান ধারা চলতেই থাকবে।
গৃহকর্মী বা সেবাদাতা হিসেবে আমাদের অর্থনীতিতে নারীদের অবদানকে অবহেলা করার একটা সাধারণ প্রবণতা রয়েছে এবং সমাজে এটার গ্রহণযোগ্যতাও আছে। ভারতে উপার্জনহীন মহিলার দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর কোনো মূল্য নেই বললেই চলে।
এ গবেষণায় আরেকটি সমস্যার বিষয় হলো, এতে নারীদের কর্মনিয়োগ বাড়ানোর জন্যে জিডিপি বৃদ্ধির যে যুক্তিটা দেখানো হয়েছে সেটা। লিঙ্গ সমতার একটা অর্থনৈতিক ধারক তৈরি করে পরোক্ষে যেন এ বার্তাটাই দেওয়া হয়েছে, মহিলাদের বেতনধারী কাজের শুধু ব্যবহারিক মূল্যই রয়েছে, নিজস্ব কোনো মূল্য নেই।
গবেষণাটির পক্ষে যুক্তি দেওয়া যায়, সরকারি-বেসরকারি খাতে নারী কর্মশক্তির আরও বেশি অংশগ্রহণে আইডিয়া বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে জিডিপিকে শুধু একটা পেরেক হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মর্মার্র্থ হলো, পুরুষ ও নারীর মধ্যে বেতনহীন ও বেতনধারী শ্রমের আরও বেশি করে ভাগাভাগি শুধু প্রান্তিকভাবেই জিডিপি বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে, এটার বাস্তবায়নের তেমন কোনো প্রকৃত প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে ভালো হয়, নারীদের বেতনধারী কাজকে (বা শিক্ষা) মানবাধিকার, নারীদের পূর্ণতর ব্যক্তিসত্তা এবং স্বনির্ভরতার দিক থেকে দেখা, দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যম হিসেবে নয়।
শ্রমশক্তিতে নারীদের আরও বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যেটা যেমন মূল্যবান, সেই সঙ্গে কেন নারীরা যেসব কারণে এটা থেকে দূরে থেকে যাচ্ছে সে ব্যাপারে আরও গভীর বিশ্লেষণও জরুরি।
তার মধ্যে, পরিবারের বাইরে এবং রাষ্ট্রীয় আওতার ভেতরে সেবামূলক কাজকে একটা সামষ্টিক উদ্যোগ হিসেবে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে। লিঙ্গবৈষম্যভিত্তিক শ্রমের আড়ালে নারীদের যেসব কর্মদক্ষতা ও সামর্থ্য চাপা পড়ে আছে, আমাদের ধারণা ও হিসাব-নিকাশে যুগোপযোগী পরিবর্তন আনার মাধ্যমে সেগুলোকে মুক্ত করা যেতে পারে। এটা অবশ্যই আমাদের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে, শুধু জিডিপির হিসাবের মাধ্যমে নয়, পুরুষ ও নারীর সৃজনশীল সম্ভাবনার সমবাস্তবায়নের পরিমাপের মধ্য দিয়েও।
অমৃতা নন্দী একজন ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত তার লেখাটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন জ্যোতির্ময় নন্দী।