ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী

ছোট নদী ছোট নয়

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ১০:১৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৬, ২০১৯

ছোট অনেক কিছুই ছোট নয়। আকৃতিতে ছোট হলেই তার অর্থ কমে যায় না। পরিমাণও সব সময় গুরুত্বপূর্ণ নয়। কখনো কখনো হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাসের চেয়েও একেকটি কবিতাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে ছোট নদী আর বড় নদী বিষয়টি তুলনীয়ই হতে পারে না। একেক নদীর একেক প্রকৃতি। একেকভাবে গড়ে ওঠে সেই নদী। গভীরতা, জলের প্রবাহ ছোট নদীর অনেক না হলেও তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে হতে পারে যথার্থ।

আমাদের দেশে অসংখ্য ছোট নদী রয়েছে যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে অনেকেই খাল বলে উল্লেখ করেন। অনেকেই আবার যে নদীগুলো মৌসুমি নদী সেগুলোকে নদী মানতেই চান না। অথচ, মৌসুমি নদীগুলোও যে গুরুত্বপূর্ণ নদী সেটি তাদের জানা নেই। সবদিক বিবেচনায় ছোট নদীগুলোকে কোনো অবস্থাতেই ছোট বলার যৌক্তিক কোনো কারণ থাকতে পারে না।

নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বিবেচনায় ছোট-বড়-মাঝারি এরকম সহস্রাধিক নদনদী আমাদের দেশে আছে। আমরা এ দেশে অনেক ছোট নদী দেখি। সাধারণত ছোট নদীগুলো মৌসুমি নদী হয়ে থাকে। অনেক ছোট নদী আছে যেগুলো দৈর্ঘ্যে অনেক কম। আবার অনেক নদী আছে যেগুলো দৈর্ঘ্যে অনেক বড় হলেও প্রস্থে অনেক কম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় আমরা ছোট নদীর কথা পাই। সে নদীতে বৈশাখ মাসে ‘হাঁটু জল’ থাকার কথা বলা হয়েছে। রবীন্দ্রযুগের নদীর সঙ্গে বর্তমানের নদীর বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। রবীন্দ্রযুগে দেশে রেলপথ, সড়কপথ দুটোই অনেক কম ছিল। নগরায়ন দেশে খুব বেশি ছিল না। মানুষও দেশে অনেক কম ছিল। ফলে নদীগুলোর ছিল অবাধ স্বাধীনতা। বর্তমানে নদীগুলো তার স্বাধীনতা হারিয়েছে। আর সে কারণে ছোট অনেক নদী বিলুপ্ত নদীর তালিকাভুক্ত হয়েছে।

এখনো দেশে প্রচুর ছোট নদী রয়েছে। এ নদীগুলো সারা বছর মানুষের কল্যাণ সাধন করে। ছোট নদী বলে কোনো নদীর গুরুত্বকে ছোট ভাবার কারণ নেই। ছোট নদীগুলো বড় নদীর প্রাণ। অনেক সময় বড় নদী যখন পানি ধারণ করতে পারে না তখন শাখা নদী সেই পানি বহন করে। আবার ছোট নদীগুলো অসংখ্য বিলের পানি বহন করে নিয়ে যায় উপনদী হয়ে।

যতই একটি নদী ভাটির দিকে যেতে থাকে, ততই উপনদীর পানি সেই নদীতে মিলিত হতে থাকে। এভাবে নদীটি প্রস্থে বাড়তে থাকে। সেই অর্থে অনেক বড় নদীর প্রবাহ বৃদ্ধিতে ছোট নদীর অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।

বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সমুদ্র পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান কাজটি ছোট নদীর মাধ্যমেই প্রাথমিকভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। আকাশ থেকে বৃষ্টি হলেই সেই পানি সমুদ্রে যাওয়ার কোনো পথ পায় না। সেই পথ হচ্ছে ছোট নদী।

অনেক বড় নদী এখন ছোট নদীতে পরিণত হয়েছে। একইভাবে অসংখ্য বারোমাসি নদীও এখন মৌসুমি নদীতে পরিণত হয়েছে। বড় অনেক নদী অতীতে যেভাবে যত পানি পেত কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে হয়তো সেই নদীর পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে। তখন হয়তো সেই নদীগুলোয় আর বারো মাস প্রবাহিত হচ্ছে না। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে যত গভীরতা সৃষ্টি হতো, পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে সেই গভীরতাও কমছে। সে কারণে অতীতে নদীগুলো যে যৌবন নিয়ে প্রবাহিত হতো এখন হয়তো সেগুলো বার্ধক্যে এসে পড়েছে।

দেওনাই নামে একটি নদী আছে। নদীটি নীলফামারী থেকে ভাটিতে প্রবাহিত হয়েছে। নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় এ নদীতে চেকাডারা, শালকি, কলমদার-বুড়িখোড়া নদী মিলিত হয়েছে। আরও ভাটিতে রংপুরে মিলিত হয়েছে বুল্লাই-খাড়ুভাজ, চিকলী। এরপর মিলিত হয়েছে মরা, ঘিরনই, খটখটিয়াসহ বিভিন্ন নদী। দেওনাই নদীর নামও পরবর্তিত হয়েছে। দেওনাই থেকে যমুনেশ্বরী, তারপর করতোয়া। এ পানি আবার মিলেছে বাঙালি নদীতে। বাঙালি নদী মিলিত হয়েছে পদ্মায়। পদ্মা, যমুনায় মিলিত হয়েই মেঘনা নামে সমুদ্রে পৌঁছেছে। এখন যদি আমরা লক্ষ করি, দেখব অনেক ছোট নদীর পানি কীভাবে সমুদ্রে পড়ছে। আমাদের নদীর পানিচক্রে ছোট নদীগুলো তাই অপরিসীম গুরুত্বের।

এই ছোট নদীগুলোর প্রকৃত পরিচর্যা না থাকলে দেশজুড়ে অসংখ্য জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। আমাদের জীববৈচিত্র্য, কিংবা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার্থেও ছোট নদীর অন্তহীন অবদান রয়েছে।

বর্তমান সরকার গত কয়েক বছর ধরে ছোট নদীগুলো খননের কাজ করছে। কিন্তু দুঃখজনক, এ নদীগুলো খনন করার ক্ষেত্রে নদীর প্রকৃত মাপ আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ফলে নদীগুলোর অতীতের চেহারায় ফেরানো যাচ্ছে না।

নদী রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ক্ষতিও করা হচ্ছে। আগামী দিনে নদী খননের প্রকল্প গ্রহণের সময় নদীর প্রকৃত মাপ বজায় থাকছে কিনা তা ভেবে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া জরুরি। ছোট নদীগুলো যে প্রক্রিয়ায় খনন করা হচ্ছে তাতে নদীর চেহারাও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নদী খনন হলে আশা করি নদীর মাপ এবং চেহারা দুটোই রক্ষিত হবে।

তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল।
[email protected]

 
Electronic Paper