ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কতটা পূরণ হলো গার্মেন্টকর্মীর দাবি

আশেক মাহমুদ
🕐 ৯:৪০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০১৯

মজুরি কাঠামো নিয়ে পোশাক শ্রমিকদের টানা বিক্ষোভের মুখে তাদের মজুরি কাঠামো শেষ পর্যন্ত সংশোধন করল সরকার। এতে কয়েকটি গ্রেডে মজুরি সমন্বয়ের পাশাপাশি মজুরি বাড়ানোও হয়েছে। কিন্তু এই সংশোধিত বেতন কাঠামো নিয়েও শ্রমিকদের কিছু অসন্তোষ রয়েছে। তা ছাড়া গার্মেন্ট মালিকরা এটা বাস্তবায়নে অযথা কালক্ষেপণ করেন কি না, সেটাও জিজ্ঞাস্য থেকে যায়।

ন্যূনতম মজুরিসহ আরও কয়েকটি দাবিতে কয়েক দিন ধরে ঢাকার গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার ও ঢাকার অভ্যন্তরের অঞ্চলগুলোতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন চলে আসছিল। এ আন্দোলনে গার্মেন্ট শ্রমিকরা দুটি উপহার পেয়েছে, যার একটি হলো এক শ্রমিকের লাশ, যে কি না পুলিশের গুলিতে নিহত, আর অন্যটি হলো দাবি পূরণের সরকারি আশ্বাস। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া ও আন্দোলন নিয়ে মনে হচ্ছে শ্রমিক ছাড়া আর কারও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ অর্থনীতিবিদরা গর্ব করে বলছেন, আমাদের গার্মেন্ট শিল্প আমাদের অর্থনৈতিক খাতকে সমৃদ্ধ করেছে বহুগুণে। এ সমৃদ্ধির পেছনে রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রম, যার আশি ভাগই নারী। অথচ এই শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে আমাদের ভাবনাই প্রমাণ করে, আগেকার মতোই শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের মূল্য কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার কালের নারীর মূল্য সম্পর্কে বলে গেছেন, প্রচলিত সমাজবিধিতে নারীর মূল্য নির্ধারিত হয় নারী কী পরিমাণে সেবাপরায়ণা, স্নেহশীলা, দুঃখ-কষ্টে মৌন, আর কি পরিমাণে তার স্বামীর সুখ, সুবিধা, লালসা ও প্রবৃত্তি মেটাতে পারে তার ওপর। আজকের যুগেও আমরা দেখি, নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে শ্রমিকের মূল্য সেই নারীর মূল্যের মতোই সূত্রাবদ্ধ। শ্রমিকদের কাজই হলো মালিকদের মুনাফা লাভের পরিধি বাড়াতে অক্লান্ত পরিশ্রম করা, মজুরি যা দেওয়া হয় তা সেবাপরায়ণ চিত্তে মেনে নেওয়া, সেই মজুরিতে যদি বেঁচে থাকা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন কষ্টকর হয়, সে ক্ষেত্রে মৌনতা অবলম্বন করা। মোট কথা, মালিক শ্রেণির সেবাদাস হয়ে তাদের সুখ সুবিধা ও অধিক মুনাফা লাভের বর্ধিত বাসনা পূরণ করতে শ্রমিকরা এক প্রকার বাধ্য। আর নারী শ্রমিক মানে তো অনুগণ দাসানুদাস।

এই হলো শ্রমিকের মূল্য, যে কি না মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে। যদিও আমাদের সংবিধান স্পষ্ট জানিয়ে দেয় : সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী (অনুচ্ছেদ ২৭)। এর পাশাপাশি সংবিধানের ৩৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘সকল প্রকার জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধ; এবং এই বিধান কোনোভাবে লঙ্ঘিত হইলে তাহা আইনত দ-নীয় অপরাধ।’ অথচ বাস্তবে দেখা যায় গার্মেন্ট শ্রমিকরা আজ শুধু ন্যূনতম মজুরি থেকেই বঞ্চিত নয়, উপরন্তু তাদের ৮ ঘণ্টার অধিক (১০-১২ ঘণ্টা) খাটানো হয় অতিরিক্ত শ্রম হিসেবে। এই অতিরিক্ত শ্রম হলো এক ধরনের কৌশলী জবরদস্তি শ্রম। কেননা মালিকপক্ষ ভালো করেই জানে, নিয়মতান্ত্রিক শ্রমে ওদের সংসার তো চলবেই না, বরং নিত্যনতুন অভাব-অনটনে দিন কাটাতে হবে।

অতি অল্প মজুরি দেওয়া মানেই যে শ্রমিকদের বাড়তি শ্রমে বাধ্য করার সুযোগ তৈরি করা, সেই বুদ্ধি খাটিয়ে শ্রমিকদের বোকা বানানোর কাজ চলছে পুরোদমে। এর ফলে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবন বলতে, সংসার বলতে কিছুই থাকে না। এমনও দেখা গেছে, তাদের জাতীয় ছুটি কাটানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। কেননা তারা চালাকি করে ছুটি দেয় ঠিকই, কিন্তু সেই ছুটির দিনের কাজ আদায় করে নেয় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, রুল জারি করে। এই জবরদস্তি শ্রম এতকাল ধরে চলে এলেও কেউ এর প্রতিকারে উচ্চবাচ্য করছে না। যারা করছে, তাদের কথা কেউ শুনছে না। মোটের ওপর গার্মেন্ট শ্রমিকরা যে শুধু শ্রমিক তা নয়, তাদের মর্যাদা এখন অনুগত দাসের, যে কি না মালিক পক্ষকে তুষ্ট করবে মাত্রাধিক শ্রম আর সময় দিয়ে। আর এর বিনিময়ে তারা মালিক পক্ষ থেকে পাবে সারা জীবনের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা।

এ কারণে গার্মেন্ট শ্রমিকরা বেঁচে থাকার অনুপযোগী বস্তিতে ঠাঁই পায়, যে দৃশ্য থেকে মানুষ একটুও স্বস্তি পেতে পারে না। তাদের কোনো সংসার নেই, ঘুম নেই, আনন্দ নেই, সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সময় নেই, অসুস্থ হলে চিকিৎসার সাধ্য নেই, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ নেই। তাদের জন্য আছে দুটি জিনিস- একটি হলো সশ্রম কারাগার, যার নাম গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি, আরেকটি হলো অভিযোগ। অভিযোগটি হলো, কেন আমরা শ্রমিকরা দিনরাত খেটে মরব, অথচ ন্যূনতম মজুরি পাব না। সামান্য মজুরি যা দেওয়া হবে, তাও বকেয়া রাখা হবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার জন্য। তাদের প্রশ্ন, তাহলে গাধার মতো খেটেও আমরা কি গাধার মতোও বাঁচতে পারব না? মানুষের মতো বাঁচার দাবি করা তো আরও দুরূহ ব্যাপার। ন্যূনতম দাবিও যখন মানা না হয়, তখন রাস্তায় নামা কি অপরাধ? রাস্তায় অবরোধ করার দায় কি এই শ্রমিকদেরই নিতে হবে? সে কারণে তাদের গুলি করে হত্যা করা হবে মালিক শ্রেণির অঙ্গুলিহেলনে? নাকি এর দায় মালিক পক্ষকে নিতেই হবে? শ্রমিকদের দাবি অযৌক্তিক, নাকি মালিকদের সৃষ্ট দাস প্রথাই যুক্তিসম্মত?

আমরা কি অ্যাডাম স্মিথের কথা মানব, যিনি লিখে গেছেন, শ্রমিকদের বেশি মজুরি দেওয়া ঠিক না, কেননা এতে তারা অর্থের অপচয় করবে? আমরা কি ডেভিড রিকার্ডোর কথা শুনব, যিনি বলে গেছেন, শ্রমিকদের মজুরি ততটাই হওয়া প্রয়োজন, যতটা না দিলে তারা বাঁচতে ও শ্রম বিক্রি করতে পারবেন না? এসব নির্মম তত্ত্ব দিয়ে আমরা কি মালিক শ্রেণির পক্ষ নেব? নাকি শ্রমিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলব? নাকি গার্মেন্ট শিল্প আমাদের জিডিপি বাড়ায়, এই স্বস্তি নিয়ে নিশ্চুপ থাকব? জিডিপি দেখে সমাজবিজ্ঞানী মারকুজ কিন্তু স্বস্তি পাননি। তিনি বলেছেন, পাশ্চাত্যে উন্নয়নের ভিত্তি রচিত হয়েছে ধ্বংস সাধনের প্রক্রিয়ায়। ঠিক তেমনি আমাদের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশকে দাস প্রথা, অভাব-বঞ্চনায় রেখে জিডিপি বৃদ্ধির প্রশংসা করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। বরং তাদের অধিকারকেই মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে রাখা উচিত।

শ্রমিকদের দাবি ও অধিকার আদায়ের প্রক্রিয়াকে সমাজবিজ্ঞানী Ralf Dahrendorf তিন ধাপের প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লে­খ করেন- ১. সমঝোতার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ (conciliation) ২. সরকার পক্ষ থেকে মধ্যস্থতা (mediation) ৩. সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা (arbitration)। এর মানে শ্রমিকদের দাবি আদায়কে যোগাযোগ আর দমন-নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমিত করার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ যতটা শ্রমিকদের পক্ষে কাজ করবে তার চেয়ে বেশি করবে মালিক শ্রেণির স্বার্থে। এই প্রক্রিয়াতে প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই। মূলত, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব শুধু শ্রমিক আন্দোলন আর আন্দোলন দমনের সীমায় রাখলে হবে না। সমাজের ছাত্রসমাজ, জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন সিভিল সোসাইটিকে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে জোরালো কথা বলা এখন ফরজ হয়ে গেছে। সচেতন শ্রেণির নীরবতা যত বাড়বে শ্রমিকদের ভাগ্য তত নির্মমতার দিকে যাবে। এই সচেতন শ্রেণির দায়িত্ব হবে সরকার ও প্রশাসনকে মালিকপ্রীতি থেকে সরে এসে জনগণের অধিকার আদায়ে সক্রিয় করা। নীরবতাই দাবি আদায়কে কঠিন করে তোলে। সেই নীরবতা না ভাঙলে সামাজিক সংকট গভীর থেকে গভীরতর হবে। সাংবিধানিক অধিকার কাগজেই থাকবে, বাস্তবে দেখা যাবে না। আমরা চাই, বঞ্চিতরা ফিরে পাক তাদের প্রাকৃতিক অধিকার।

আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[email protected]

 
Electronic Paper