মাস্টারদার গ্রামে প্রণববাবুর সফর প্রসঙ্গে
জ্যোতির্ময় নন্দী
🕐 ৯:৩৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০১৯
কে যেন সেদিন বলছিল, প্রেসিডেন্ট আছেন পৃথিবীর সব দেশে, কিন্তু রাষ্ট্রপতি আছেন শুধু দুটো দেশে-ভারত আর বাংলাদেশে। তো সেই ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি (এবং এ পদে প্রথম বাঙালি) প্রণব মুখোপাধ্যায় অবসর গ্রহণের পর তার সফরের জন্য প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিলেন। ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর গত বছর জানুয়ারিতে তার একান্ত ব্যক্তিগত সেই সফরে তার প্রধান লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম। তিন দিনের সেই সফরে পুরো একটা দিন তিনি কাটান চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে রাউজানের ঐতিহ্যবাহী নোয়াপাড়া গ্রামে, মোগল আমলের বর্ধিষ্ণু ‘পরগনে নোয়াপাড়া’য়, মহাবিপ্লবী সূর্য সেনের বাস্তুভিটে পরিদর্শনেও যান তিনি।
নোয়াপাড়ায় সেনপাড়া মূলত দুটো-একটা বদ্যি সেনপাড়া, যেখানে মহাকবি নবীন চন্দ্র সেনের বাড়ি, আর কায়েত সেনপাড়া, যেখানে সূর্য সেনের বাড়ি। দ্বিতীয়োক্ত সেনপাড়ার এখন নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সূর্যসেনপল্লী’, এবং এ সুবাদে গাঁগেরামের পুরনো তদ্ভব পাড়াটি আবার তৎসমের জাতে উঠেছে।
এখন প্রণববাবু এমন এক বিপ্লবীর জন্মস্থানের তীর্থ গেলেন, যাকে তার নিজের রাজনৈতিক দল ব্রাত্য করেছিল, যিনি প্রণববাবুর দলের প্রধান নেতার অহিংসবাদের বিপক্ষে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিলেন।
সবচেয়ে মজার কথা হলো, সূর্য সেনের যে জন্মভিটে প্রণববাবু দেখতে যান, সেখানে এখন সরকারিভাবে তার নামে প্রতিষ্ঠিত একটি চিকিৎসাকেন্দ্র আর শিশুসদন চলছে। চত্বরের একপাশে তার নামফলক লাগানো একটা বেদি আর সেটাকে ঘিরে চারটে স্তম্ভের একটা স্মারকও আছে। কিন্তু সেখানে বা তার আশপাশে সূর্য সেনের পার্থিব জীবনের স্মৃতিবাহী কোনোকিছুর চিহ্নমাত্র নেই। সূর্য সেন শহীদ হওয়ার পরবর্তী একটা শতকও কাটার আগেই তার বাড়িঘর, পরিবার, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সবকিছু এ ভূমিখ- থেকে নিঃশেষে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তাকে স্বাগত জানাতে আসা জনগণের মধ্যে মহাবিপ্লবীর সঙ্গে রক্তসম্পর্কিত কাউকে অবশ্যই পাননি।
প্রণববাবু কি কখনো ভেবে দেখেছেন বা দেখবেন-যে মাটির জন্য সূর্য সেন ও তার সহযোদ্ধারা প্রাণ দিলেন, সেই স্বাধীন দেশের মাটিতে তার উত্তরপুরুষদের ঠাঁই হলো না কেন? কেন তারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলেন অভিশপ্তের মতো?
এর জন্য প্রণববাবুদের রাজনৈতিক দল ও তার শীর্ষনেতারা কি প্রধানত দায়ী নন?
১৯৩৫-এ যখন রাঢ়বঙ্গের (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের) বীরভূমের মিরাট গ্রামে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হচ্ছে, তার মাত্র পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের রেশ তখনো কাটেনি। সারা উপমহাদেশ তখনো প্রবলভাবে আন্দোলিত হচ্ছে এর অভিঘাতে, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত বলছেন, ‘চিটাগং টু দা ফোর’-চট্টগ্রাম সবার আগে, যদিও অতিশৈশবের সেসব ঘটনা প্রণববাবুর মনে থাকার কথা নয়। অথচ পরবর্তী মাত্র ১২ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ তার বাল্যকাল কাটার আগেই ভারতের বিপ্লবপ্রসূতি সেই ভূমিখ- কেন ছিন্ন হয়ে গেল, এর পেছনে প্রধান কুশীলবরা কে ছিল, একজন প্রাজ্ঞ, বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ হিসেবে তা জানতে নিশ্চয় তার বাকি ছিল না। তিনি নিশ্চয় জানতেন, কাদের নিজেদের হালুয়া-রুটির ভাগাভাগির কারণে ভারতবর্ষকে ভাগের মা করা হলো, গঙ্গার দেশেরই গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটানো হলো।
তবুও তিনি আজীবন সেই নেতাদের দলই করে এসেছেন। সেই দলেরই একজন হিসেবে দীর্ঘকাল মন্ত্রিত্ব করেছেন, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, পূর্বসূরি নেতাদের হালুয়া-রুটির উত্তরাধিকারী হিসেবে। এখন অবসর জীবনের সূচনায় শ্রদ্ধা নিবেদনে এসেছেন এমন এক বিপ্লবীর জন্মস্থানে, যার বিপ্লবী পরিচয়ই বলে দেয় তিনি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া, আর তাই শুরুতে প্রণববাবুরই দলের অনুসারী হলেও পরে মত ও পথ বদলেছেন, এবং কথার চেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন কর্মে বা অ্যাকশনে।
গান্ধী-নেহরু, জিন্নাহ্-সোহরাওয়ার্দী-সবাই যার যার মতো হালুয়া-রুটির ভাগ পেয়েছে, প্রসাদ পেয়েছে আর উত্তরাধিকার ভোগ করেছে প্রণববাবুদের মতো আরও অনেকে। কিন্তু সে তো সূর্য সেনের আর তার উত্তরপুরুষদের রক্ত আর অশ্রুর বিনিময়ে।
মাস্টারদার রক্তসম্পর্কিতরা, মহাকবি নবীন সেনের বংশীয়রাও, কেউ এ দেশে টিকতে পারলো না। তারা সবাই উৎখাত হলো, দেশান্তরী হলো নানাভাবে। কেউ এর জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস পর্যন্ত ফেললো না। কেউ লিখলো না এক্সোডাসের কোনো মহাকাব্য।
এখন প্রণববাবুরই বিশাল দেশের আনাচে-কানাচে কোথাও পাদপ্রদীপের অন্তরালে দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন সূর্য সেনের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কেউ কেউ। তাদের পিতৃপুরুষের গাঁয়ের মাটিতে যে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির পা পড়েছে, অন্তত এক দিনের জন্য হলেও সব আলো যে সেখানেই পড়েছে, তা হয়তো তাদের সবাই না হলেও বেশিরভাগই কিছু জানতেই পারেননি।
এ যেন সূর্যের আলোয় আলোকিত হলো সারা জগৎ, শুধু অন্ধকার রয়ে গেল সূর্যের নিজের ঘরটা! ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং আগত অন্য মান্য অতিথিরা মহাবিপ্লবীকে নিয়ে অনেক গলদশ্রুকৃতবাস শ্রদ্ধা-ভক্তি নিবেদন করেছেন, যার মধ্য দিয়ে মাস্টারদার বর্তমান পণ্যমূল্যের চেয়ে বেশি কী আর প্রমাণিত হয়েছে?
১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ছিল সূর্য সেনের ৮৫তম মৃত্যুদিবস। ১৯৩৪ সালের এই দিনে কারাপ্রকোষ্ঠে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক প্রতিভূদের নির্মমতম নির্যাতনে অর্ধমৃত সূর্য সেনকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে পূর্ণমৃত করার পর তার লাশকেও জন্মভূমিতে ঠাঁই দেওয়া হয়নি। ব্রিটিশ শাসকরা ‘ভয়ঙ্কর’ সূর্য সেনের চিহ্নটুকুও না রাখার অভিপ্রায়ে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ বাক্সে পুরে জাহাজে করে মাঝসমুদ্রে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেয়। এখন তার সেই স্বদেশে তার উত্তরপুরুষরা কেউ ঠাঁই পেল কি পেল না, তাতে প্রণববাবু বা কারোরই কিছু যায় আসে না। সব দই সবসময় নেপোরাই খাবে-এটাই বুঝি এ দুনিয়ার অলিখিত নিয়ম!
আমাদের স্বাধীনতা, যত প্রাপ্তি, যত সৌজন্য ও লৌকিকতার মাঝখানে যে একটা বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে, সেটা অনুভব করার মগজ বা মানসিকতা কি কারও আছে?
জ্যোতির্ময় নন্দী : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
[email protected]