ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাঠে-ঘাটে-বাটে

কৃষিশ্রমিকদের জীবনের একচিলতে

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:১৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০১৯

গোটা দেশই একসময় অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে গভীর কষ্টের অতীত পাড়ি দিয়েছে। বাংলার আকাশ থেকে সেই কলঙ্ক মুছে গেছে। রংপুর অঞ্চল থেকে এ কলঙ্ক মুছে গেছে সবশেষে। এ অঞ্চলে অভাব-অনটনের একটি স্বতন্ত্র আঞ্চলিক নাম ‘মঙ্গা’, যদিও প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান শব্দটির অর্থ বুঝতেন না। মঙ্গা বছরে দুটি সময় যমের মতো জেঁকে বসত, যার শিকার হয়ে অনেকে খেতে না পেয়ে মারাই যেতেন।

এ অঞ্চলে বছরে দুটি সময় প্রায় চার মাস কষ্টে কাটতো। সেগুলো আশ্বিন-কার্তিক এবং চৈত্র-বৈশাখ। এর প্রধান কারণ হলো, কাজ না থাকা। এ অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ কৃষিনির্ভর। ধান কাটার পর থেকে শুরু করে নতুন ধান না লাগানো পর্যন্ত দুই মাস করে বছরের চার মাস ছিল এ অঞ্চলে মঙ্গা। যখন মঙ্গা ছিল, সেই দিনগুলো তো একদিকে পরিবারের সদস্যসংখ্যা ছিল ৫-১০ জন। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল কম। নারীরা গৃহের কাজ ছাড়া আর কিছুই করত না। খুব বিপদগ্রস্তরা অন্যের বাড়িতে নামমাত্র পারিশ্রমিকে গৃহস্থালির কাজ করত। ফসল কাটার সময়েও ও রকমই।
নারীদের মূলত, কাজ করতে দেওয়া হতো না। কুসংস্কার আর শাস্ত্রের নামে ভুল বুঝিয়ে কাজ করা থেকে বিরত রাখা হতো। শ্রমের মূল্যও ছিল অস্বাভাবিক কম। গত শতকে ’৯০-এর দশকেও একজন পুরুষ সারা দিন কাজ করার পর পেতেন এক কেজি চাল আর দুই টাকা।
কেউ কেউ হয়তো দুপুরে খাওয়াতেন। কেউ খাওয়াতেন না। যারা হুঁকা টানতেন না, কিন্তু বিড়ি খেতেন, তাদের গৃহস্থ হয়তো বিড়ি খাওয়াতেন। শ্রমের দাম কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ ছিল, কৃষি তখন ছিল অলাভজনক। আর দিনমজুরও পাওয়া যেত প্রচুর। এ অঞ্চলের মানুষ যেখানে শ্রমের চাহিদা ছিল সেখানে যেতেন না। অনেকে জানতেনও না, কোথায় শ্রমের মূল্য বেশি।
রংপুর অঞ্চল থেকে ঢাকা যাওয়া ছিল খুবই বিড়ম্বনার। বাস কিংবা ট্রেন যেটাতেই হোক না কেন, অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর ফেরিতে করে যমুনা নদী পার হওয়ার পর আবারও সড়কপথ কিংবা রেলপথে যেতে হতো। ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। অনেকের কাছে ঢাকা যাওয়ার মতো এ টাকাটাও ছিল না। এসব কারণে এ অঞ্চলের মানুষ শ্রম বিক্রি করার জন্য দূরে যেত না। ফলে তাদের প্রতিকূল জীবনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে।
সারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন করুণ ছিল, তখন ফরিদপুর, নোয়াখালীসহ অনেক এলাকা থেকে মানুষ কাজের সন্ধানে রংপুর অঞ্চলে আসতেন। কাজের সন্ধানে এসে অনেকেই রংপুর অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলেছেন। রংপুরের অবস্থা সারা দেশের তুলনায় যে কিছুটা অবস্থা ভালো ছিল, অন্য এলাকা থেকে এখানে এসে বসতি গড়া দেখলে অনুমান করা যায়। চার মাস এখনো রংপুরের মানুষ কর্মহীন থাকে।
এই চার মাস রংপুরের সাধারণ কৃষিজীবী অনেক শ্রমিক বগুড়া, টাঙ্গাইল, কুমিল্লাসহ দেশের অনেক স্থানে যায়। ওইসব এলাকায় কাজ শেষ করে ফিরে রংপুর অঞ্চলের কৃষিকাজ করেন। ওইসব এলাকায় প্রায় দুই মাস আগেই ধান চাষও হয়, ধান কাটাও হয়।
রংপুর অঞ্চলের যেসব কৃষিশ্রমিক অন্য অঞ্চলে যান, তাদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।  এদিকের অনেক গ্রামে এসব দিনে পুরুষ থাকে খুব কম। রংপুর বিভাগের সবকটি জেলায় আগে একই দৃশ্য ছিল।
কিন্তু গত ১২-১৫ বছরে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও জেলার দৃশ্য বদলেছে। তাদের কাজের ক্ষেত্র শুধু ধান চাষনির্ভর নেই। ফলে তারা সারা বছরই কোনো না কোনো কাজের মধ্যেই থাকেন। রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুরের অবস্থা ঠিক আগের মতো না হলেও দুই মৌসুমে কাজের সংকট কাটেনি। নীলফামারীতে প্রচুর শিল্পকারখানা হওয়ার কারণে সেখানকার মানুষের আর কাজের অভাব নেই।
রংপুর মডার্ন মোড় কিংবা পার্ক মোড় এলাকায় দাঁড়ালেই উল্লিখিত মাসগুলোতে হাজার হাজার কৃষিশ্রমিক পাওয়া যাবে। অসংখ্য বাসে দেখা যাবে, বাসের ভেতরে সিট খালি পড়ে আছে, যাত্রী নেই, কিন্তু ছাদের ওপরে এতটুকু জায়গাও নেই।
বাসের ছাদে যে যাত্রীরা বসেন, মূলত তারাই এ দেশের কৃষিকে সমুন্নত করেছেন। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান হচ্ছে এদের শক্তি। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা নেই। কিন্তু কৃষি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা ব্যক্তিদের চেয়ে তাদের কৃষি জ্ঞান কম নয়।
বাসের ছাদে বসে যাওয়া এরকম অসংখ্য কৃষিশ্রমিকের সঙ্গে আমার কথা হয়। ভোর-সকাল থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত এদের পাওয়া যায়। এদের সঙ্গে থাকে ধান বহন করার জন্য বাঁশের তৈরি একপ্রকার লাঠি (স্থানীয় নাম বাঁকুয়া), কাস্তে, কোদাল, আর বাজারের থলেতে মোচড় দিয়ে রাখা কিছু লুঙ্গি, জামা।
ভাওয়াইয়া গানে গ্রামের যে নারীবিরহ উঠে এসেছে তা মূলত, দূরে শ্রম বিক্রি করতে যাওয়া শ্রমজীবীদের স্ত্রীর। জীবনযাত্রায় বহুবিধ পরিবর্তন এলেও এদের জীবনে উন্নয়নমুখী হাওয়া এখনো লাগেনি।
দিনভর হাজার হাজার কৃষিশ্রমিকের গাড়ির ছাদে কিংবা গাড়ির ভেতরে যখন চরম অসম্মানের সঙ্গে পথ চলতে দেখি, তখন উপলব্ধি করি আমার এখনো শ্রমজীবীদের প্রাপ্য অধিকার দিতে পারিনি।
কয়েক দিন আগে রাত ১১টার দিকে এক দল কৃষি শ্রমিকের সঙ্গে দেখা। তারা যাবেন কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায়। কুড়িগ্রাম থেকে আরও প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে তাদের বাড়ি।
পার্ক মোড়ে যারা গাড়ির খবর রাখেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, কুড়িগ্রামের আর কোনো গাড়ি নেই। ওদের সঙ্গে বসে কথা বলি। গাড়ি নেই জেনেও তারা অপেক্ষায় কেন থাকলেন জিজ্ঞাসা করতেই একজন বললেন, ‘যদি এলা ট্রাক পাই। রাইতোত ট্রাক পাওয়া যায়।’ সবার চোখ সড়কের পশ্চিম দিকে।
রাতে দূরে যে গাড়িই দেখা যায়, তাদের সঙ্গে আমারও আশা জেগে ওঠে-এই বুঝি খালি ট্রাক আসে। কিন্তু কোনো খালি ট্রাক আসে না। অবশেষে তারা হেঁটেই রওনা হলেন সাতমাথা অভিমুখে। সাতমাথা নামক স্থানে কোনো অটোরিকশা কিংবা অন্য কোনো বাহন যদি পাওয়া যায় এ আশায়। জানি না তারা সেখানে কোনো বাহন পেয়েছিলেন কি না। গত বছর এক দিন পার্ক মোড় এলাকায় আমরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম।
 আমাদের মধ্যে একজন ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক শাহীনুর রহমান। এমন সময় এক দল কৃষি শ্রমিক এসে বাসের জন্য দাঁড়ালেন। শাহীনুর তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, তারা সকালে নাশতা খেয়ে টাঙ্গাইল থেকে রওনা করেছেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত আর খাননি। শাহীনুর রহমান তাদের সবাইকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন।
তাদের চোখ-মুখে তখন কৃতজ্ঞতা। তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, জাতীয় উন্নয়নে তাদের অবদান সম্পর্কে তারা জ্ঞাত কি না। তারা এসবের কিছুই জানেন না। তারা না জেনেও প্রতিদিন এভাবেই নিজেদের সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে গড়ে তুলছেন আমাদের অর্থনীতির ভিত। এক দিন দেশ সমৃদ্ধশালী দেশ হবে। সেই সমৃদ্ধির শিরায়-উপশিরায় প্রবাহিত হবে এসব কৃষকের অন্তহীন ত্যাগ।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]

 
Electronic Paper