ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সৈয়দ আশরাফ : অসাম্প্রদায়িক চেতনার নাম

আবু আফিয়া আহমদ
🕐 ৯:১১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০১৯

বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ৩ জানুয়ারি ব্যাংককের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং স্বাধীনতার চেতনা ও সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দেশের এবং দলের ক্রান্তিলগ্নেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী একটি সভায় তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্রের উগ্র-ধর্মান্ধদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পাবে বলে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে মগজধোলাইকৃত এক শ্রেণির অতি ধার্মিকদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ইসলামী জিহাদের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে জঙ্গি বানানোর কথা উল্লেখ করে দলের সবাইকে সতর্ক করে দেন। এর আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্র-ধর্মান্ধদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুধীমহলে নিন্দিত ও সমাদৃত হয়েছিল। তার মৃত্যুতে জাতি, বর্ণ-নির্বিশেষে মর্মাহত।
তিনি কতটুকু অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতেন এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে শ্রদ্ধা করতেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ মিডিয়াতে দেওয়া তার একটি বক্তব্যের ভিডিও এখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সংবিধানে প্রত্যেকটি ধর্মেরই স্বাধীনভাবে পালন করার অধিকার আছে এবং সেই অধিকার রক্ষা করার জন্য আমরা সব সময় সদা সচেতন। যখন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পাবলিকেশন ব্যান্ড করা হয়, বাংলাদেশে আমরা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তার প্রতিবাদ করেছি। আমাদের নেত্রী বারবার একথা বলেছেন, কিছুদিন আগেও তিনি এক সাক্ষাৎকারে এবং প্রেস রিলিজের মাধ্যমে উনি বলেছেন, কে মুসলমান, কে মুসলমান না, সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার। এটার দায়িত্ব পৃথিবীর কাউকে দেওয়া হয় নাই। আজকে যে পাকিস্তানে মুসলমানদের ভেতরে শিয়া সুন্নির যে গণহত্যা চলছে, সেটারও কিন্তু পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে ঘটতে পারে। আজকে আহমদিয়া সম্প্রদায় পরবর্তীতে শিয়া সম্প্রদায়, কেউ আসবে ওয়াহাবি সম্প্রদায়, কেউ আসবে হানাফি সম্প্রদায়। বিভিন্ন ধরনের ফেতনার ঘটনা ইসলামের মধ্যে আছে। এতে কেউ নিরাপদ থাকবে না। আমরা সংবিধানে বিশ্বাস করি এবং সংবিধানে সব ধর্মেরই, সব মনোভাবেরই প্রকাশ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সেখানে আছে, এবং সে বিশ্বাস করার জন্যই আজকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সঙ্গে একত্র হয়েছি। এবং আমরা নিশ্চিত করতে চাই, আপনারাসহ বাংলাদেশের সব ধর্মের সমান অধিকার যেন বাংলাদেশে বহাল থাকে। এই ধর্মের নামে যে ব্যবসা, সেই ব্যবসাকে বন্ধ করার জন্য আজকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’  
২০১১ সালের জুলাই মাসে যেদিন ১১টি ইসলামী দলের নেতৃত্বে হরতাল পালিত হয়েছিল সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ থাকার বিষয়ে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে মতবিনিময়কালে তিনি বলেছিলেন, ‘কমিটি যদিও রাখতে চাইছে, কিন্তু আমি এবং সংবিধান সংশোধন কমিটির কয়েকজন সদস্য এই রাষ্ট্রধর্ম রাখার বিরুদ্ধে।’ তিনি বলেছিলেন, ‘সংবিধান তো দেশের সব নাগরিকের জন্য। সংবিধান যখন পড়ব, তখন আমি হিন্দুও না, আমি মুসলিমও না। আমি দেশের নাগরিক হিসেবে এটা পড়ব, এটা মান্য করব।’ ‘আমি হিন্দুও না, আমি মুসলিমও না’-এটাই ছিল তার প্রাণের কথা। তিনি আপাদমস্তক ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, আর তাই তার এই অসাধারণ বক্তব্যকে কিছু ধর্মান্ধরা বিকৃত করে তাকে নাস্তিক আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছে ও করেছে। তার এ বক্তব্যের পরপরই তাহফিজে হারামাইন পরিষদের সভাপতি মাওলানা সাদেক আহমদ সিদ্দিকী এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, তিনি (সৈয়দ আশরাফ) যেহেতু নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করছেন, তা হলে কি তিনি ধর্মবিরোধী না ধর্মবিদ্বেষী?’ (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম, ১৫/৭/২০১১)  
আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি, এর অর্থ ধর্মহীনতা বা ধর্মবিমুখতা নয়। এর অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়করা নাগরিকদের ধর্ম বা বিশ্বাসের বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবেন। কে কোন ধর্মে বিশ্বাসী বা কে অবিশ্বাসী অথবা নাস্তিক এ বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার, সবাই রাষ্টের দৃষ্টিতে সমান-এই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আর এই নীতিতেই তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।
আমরা জানি, ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ব্যাখ্যা দেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জোচ্চুরি, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে।
আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।’ (তথ্য-‘বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ’ পুস্তক-পৃষ্ঠা-৮-১২)
ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ঐতিহাসিক ৭ জুন উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন ‘বাংলাদেশের মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এখানে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা করা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।’ (বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ)। স্বাধীনতার এতটি বছর অতিক্রম করার পরেও এই শান্তিপ্রিয় দেশে যারা ধর্মের নামে রাজনীতি ও বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় জাতি তাদের চিনতে ভুল করেনি, এবারকার নির্বাচনই তার বড় প্রমাণ।
মূলত, ধর্মনিরপেক্ষতা এমন একটি চশমা, যা পরিধান করলে শাসকদের চোখে ধর্ম-বর্ণ- নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ কেবল একজন মানুষ হিসেবেই ধরা দেয়। তখন সে খোদার এক সম্মানিত সৃষ্টি হিসেবে মনে হয়, যার প্রতি ন্যায়বিচার ও সদাচরণ করা শাসকদের পবিত্র দায়িত্ব। এই শিক্ষা আমরা মহান আল্লাহর ব্যবহার থেকেও গ্রহণ করতে পারি। তিনি যেমন মুসলমান-অমুসলমান, আস্তিক-নাস্তিক, পুণ্যবান-পাপী নির্বিশেষে সবার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তাদের সৎকর্মের প্রতিদান দেন, সবাইকে সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত করেন সবাইকে তার করুণার বৃষ্টি বর্ষণ করে, ঠিক তেমনি জাগতিক সরকার বা রাষ্ট্রনায়কদেরও এই গুণটি অবলম্বন করা উচিত। তবেই রাষ্ট্র ও দেশ হবে সুখী, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

 
Electronic Paper