ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
🕐 ৯:২০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৬, ২০১৯

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় জয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। সরকারের কাছে জনতার প্রত্যাশা অনেক। এদিকে বিরোধী দল ছাড়া সংসদই-বা কেমন হবে? এমন অনেক বিষয়ই এখন আলোচিত হচ্ছে।

সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে একটি বিরোধী দল কাম্য। কেন-না, বিরোধী দল সরকারের বিভিন্ন বিল এবং প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে গঠনমূলক বক্তব্য প্রদান করে, যা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিরোধী দলকে গণতন্ত্রের প্রাণও বলা হয়। কিন্তু এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে সব সময় সংসদে থাকতে হবে। অর্থাৎ সরকারের বাইরে সংসদে যে দলই থাকবে, কেবল তারাই বিরোধী দল হিসেবে গণ্য হবে, এমন ধারণা সঠিক নয়। বিরোধী দল সংসদের বাইরে অবস্থান করেও ভূমিকা পালন করতে পারে। সংসদের বাইরে অবস্থান করেও তারা জোরালো ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনা করবে, এবং গণমানুষের বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ থাকবে। অর্থাৎ সরকারের নানা ইস্যুতে সংসদের বাইরে থেকেও তারা বক্তব্য রাখতে পারবে।
এখন কেউ যদি মনে করে, সংখ্যা বিবেচনায় সংসদে বিরোধী দলের জোরালো অবস্থান নেই, সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, এমন ধারণা সঠিক নয়। তারা কেবলমাত্র সংসদে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখতে পারবে না, কিন্তু সংসদের বাইরে তারা ঠিকই বক্তব্য রাখবে। অতীতে আমরা দেখেছি, খুব কমসংখ্যক সংসদ সদস্য নিয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যায়। দুই থেকে তিনজন সংসদ সদস্য নিয়েও বিরোধী দল অতীতে দেখা গেছে। যেমন - বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি একাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন। অতীতে আমরা দেখেছি, অনেক বড় বিরোধী দল যাদের সংসদ সদস্য সংখ্যা শতাধিক, তারা জাতীয় সংসদে যাননি এবং কথা বলেননি। অনেকসংখ্যক সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দল অনবরত সংসদ বর্জন করেছে-এমন নজিরও রয়েছে। কাজেই বিরোধী দলকে সব সময় সংসদে থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বর্তমানে নতুন মন্ত্রিসভা অবশ্যই সংসদীয় রীতি অনুযায়ী গঠন করা হবে।
রাষ্ট্রপতির কাছে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে প্রতীয়মান হবে, সেই দলের প্রধান সংসদীয় নেতা হবেন। রাষ্ট্রপতি সেই দলের প্রধানকে সরকার গঠন করার আহ্বান জানান। এই হিসেবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে সংসদীয় দলনেতা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভায় শেখ হাসিনাকে নেতা নির্বাচন করা হয়। রাষ্ট্রপতি তাকেই সংসদীয় সরকার গঠন করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিসভার আকার, গুণগত বিষয়গুলো কী হবে? অথবা এ ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যাশা কী? মন্ত্রিসভার এই সমস্ত বিষয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করছে। তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞার আলোকে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, যেখানে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে। মন্ত্রিসভায় অবশ্যই ত্যাগী নেতা, যাদের আমরা পরীক্ষিত নেতা হিসেবে জানি, তাদের মধ্যে থেকেই মন্ত্রী হওয়া উচিত। কাজ করার দক্ষতা, কার্যকারিতা এবং যোগ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, এগুলোর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উদ্ভাবনী ক্ষমতা। যারা নতুন চিন্তা করেন, সৃজনশীল নেতাদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিনিয়র ব্যক্তিবর্গ এবং অভিজ্ঞতার অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে যাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা রয়েছে, নতুন কিছু করতে পারবেন, তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। মন্ত্রিসভা যেন আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমলারা যা বলবেন, সে অনুযায়ী মন্ত্রী কাজ করবেন, তা যেন না হয়। বরং মন্ত্রী তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় জনতার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা যে দূরদৃষ্টি নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন পূরণে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন, তা যেন বাস্তবায়িত হয়। সেক্ষেত্রে নতুন যারা মন্ত্রী হবেন, তাদের নতুন চিন্তা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।
মন্ত্রিসভা যেন সনাতন ধাঁচের না হয়। বিগত দিনে আমরা এমন অনেক মন্ত্রীকে দেখেছি, যারা কেবলমাত্র রুটিনওয়ার্ক করতেন। বর্তমান সরকারের কাছে জনতার প্রত্যাশা অনেক। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, সরকারকে প্রথম গুরুত্ব দিতে হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। আমাদের প্রবৃদ্ধির পরিমাণ সম্প্রসারণ হচ্ছে, এখন দরকার এর সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ানো। তরুণ প্রজন্ম, যাদের আমরা ডেমোগ্রাফিক্যাল ডিভাইডেন্ড বলছি, তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। আর এর মাধ্যমেই ২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ধনী দেশে পরিণত করার টার্গেট পূর্ণ হবে। এসব টার্গেট অর্জন করার জন্য আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান করতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, দেশে প্রচুর লোক বেকার। তারা কাজ পাচ্ছে না। আরেকদিকে আমাদের দেশের কাজ করার জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর লোক নিয়ে আসতে হচ্ছে। দেশে এখন কয়েক লাখ বিদেশি দক্ষ লোক কাজ করছেন। আমাদের যারা মেধাবী তরুণ, তাদের জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু দক্ষতার বড় অভাব। অর্থাৎ তারা কাজটি সঠিকভাবে করার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাত্ত্বিকভাবে তারা খুব ভালো করবে। কিন্তু ব্যবহারিকভাবে কাজ করার জন্য তাদের যে দক্ষতার দরকার ছিল, সেই শিক্ষা আমাদের তরুণরা পায়নি। তাই আমাদের কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব কাজ তরুণরা করবে, সেসব কাজের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা হলে দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এজন্য অবিলম্বে আমাদের কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে শিক্ষার মানগত প্রসারতাও ঘটাতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় থাকার পরও আমাদের যে পরিমাণে দক্ষতার উন্নয়ন করা দরকার, তা হয়নি। সেজন্য কারিগরি, প্রকৌশল প্রশিক্ষণের দিকে আমাদের যেতে হবে। আশা করি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কারিগরি  ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ নিশ্চিত হবে।
দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স দেখানোর পরও দুর্নীতি শেষ হবে না। বরং দুর্নীতি কিছু থেকেই যাবে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা যখন উন্নয়নশীল ধারায় থাকে, তখন রাষ্ট্র কতকগুলো স্তর অতিক্রম করে। তার একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে দুর্নীতি। যতটা সম্ভব দুর্নীতি ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আগামী ১০০ দিনের মধ্যে সরকারকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে বিষয় দৃশ্যমান করতে হবে তা হলো, দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় না দেওয়া। আর এর চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দুর্নীতি করে মানুষ যেসব টাকা উপার্জন করেছে, তা বিদেশে পাচার হওয়ার পথ বন্ধ করা। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, দুর্নীতিবাজরা টাকা বিদেশ পাচার করে। দুর্নীতি করেও অর্থ যদি দেশে রাখত, ব্যাংকে রাখত কিংবা বিনিয়োগ করত, তাহলে সুফল পাওয়া যেত। কোনো-না-কোনোভাবে দুর্নীতির টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। কিন্তু দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিভিন্ন কায়দায় মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে পাচার করে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ট্যাক্স নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের দুর্নীতি বন্ধ করার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যে হারে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, গড় আয়ু বাড়ছে, সে হারে কিন্তু ধনী-দরিদ্রের ভারসাম্য বাড়ছে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম একটি দিক হলো, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন। বাংলাদেশ একটি সাম্যের দেশ হবে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার হয়তো শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, সামাজিক নিরাপত্তার যে নেটওয়ার্ক আছে, তা আরও জোরালো করতে হবে। মাননীয়  প্রধানমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন, কোনো মানুষ গৃহহারা থাকবে না, না খেয়ে থাকবে না, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে না, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় আরও জোরালো করতে হবে। এজন্য অর্থের সংস্থানের লক্ষ্যে সবাইকে ট্যাক্স নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৩০ লাখ মানুষের টিন নাম্বার আছে। তার চেয়েও দুঃখজনক-২০ লাখেরও কম মানুষ ট্যাক্স দেয়। এমনটি হতেই পারে না। আমাদের দেশে সব করযোগ্য লোককে করের আওতায় নিয়ে আসতেই হবে।

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper