ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী’?

নূরুজ্জামান
🕐 ৯:২৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৫, ২০১৯

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদপত্রের খবর দেখে ফররুখ আহমদের কবিতার কথা মনে পড়ে গেল। স্বাধীনতা-পূর্বে লেখা কবিতায় নিপীড়িত মানুষের মুখপাত্র কবি নেতার কাছে আকুতি জানিয়ে বলেছেন, ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী? / এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে? / সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?’

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরিয়ে গেছে। কবি ফররুখ আহমদের কবিতার ভাষা যেন এখনো বাঙালির চোখে-মুখে ভেসে বেড়াচ্ছে! স্বাধীনতা নামের ছোট্ট শিশুটি এখন যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছে। অনেক অন্ধকার রাত্রি পেরিয়ে, সাপ-বিচ্ছুর দংশনে ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে সবেমাত্র আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আজ বিশ্ব বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে অবাক হয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। আমরা বাঙালি! আমরা পেরেছি! পেরেছি একটি তলাবিহীন ঝুড়িকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে। এটা সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও প্রাজ্ঞতার কারণে।
২০১৪ সালের পরেও বিশ্ব যে বাংলাদেশকে নিয়ে নানা শঙ্কার পূর্বাভাস দিয়েছে, সন্ত্রাসকবলিত দেশের সারিতে নাম লিখেছে, ভয়ঙ্কর আইএস-এর শ্যেনদৃষ্টির কথা বলেছে, জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাছে, সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে শান্তির প্রতীক, উন্নয়নের রোল মডেল। ভাবা যায়, আমাদের মর্যাদা ও সম্মান কত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে! আজ আমাদের নাগরিকদের নির্দ্বিধায় বিভিন্ন উন্নত দেশ ভিসা দেয়। কারণ তারা জানে, বাংলাদেশিরা এখন আর ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লেখাবে না। তারা এখন আর নিজের দেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্য তাদের দেশে থাকবে না। বাংলাদেশিদের এখন জীবনমানের অনেক উন্নয়ন হয়েছে।
আগামীতে তারা আরও উন্নত জীবনের পথ তৈরি করে নিতে পারবে। সুতরাং তাদের এখন আর বোঝা ভাবার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশিরা এখন মানবসম্পদে পরিণত হয়েছে। তারা এখন উন্নত জীবনের সন্ধান পেয়েছে। তাই তারা বিশ্বের অন্যান্য জাতিকেও উন্নত জীবনের সন্ধান দিতে সক্ষম।
এই পরিস্থিতিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে। সহিংসতা যা হয়েছে, তা পূর্ববর্তী নির্বাচন অপেক্ষা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এখন প্রয়োজন বিরোধী দলগুলো নির্বাচন নিয়ে যেসব অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে তা খতিয়ে দেখা, এবং সেসব অভিযোগের সুরাহা করা। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, সন্ত্রাস পরিহার করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা করা। আর সরকারের উচিত, নিজ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যে-সব অপকর্মের অভিযোগ উঠছে, সেগুলো সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুরাহা করা।
নির্বাচনের আগে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাঙালির মুখে শুনছি ও বাংলা লেখায় পড়ছি কিছু অপ্রিয় বক্তব্য। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-কর্মীদের নানা অপকর্মের কথা, ঘুষ-দুর্নীতির কথা, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির কথা, নির্যাতন-নিপীড়নের কথা। নির্বাচন-পরবর্তী সেই মানুষদের লেখাতেই দেখছি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চার সন্তানের জননী ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অপরাধে গণবলাৎকারের শিকার হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে। আবার সেই মানুষরাই প্রিয় নেতা সৈয়দ আশরাফুলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছেন। খবরে প্রকাশ, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গৃহবধূকে যারা বলাৎকার করেছে, তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আবার বাংলার মানুষ জানে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের প্রিয় নেতা।
সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ যেমন হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত অকুণ্ঠ ভালোবাসার প্রকাশ, তেমনি সুবর্ণচরের ধর্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হৃদয়ের গভীর থেকে ঘৃণা আর বিষবাষ্পের বহিঃপ্রকাশ। এ যেন একই গাছের দুই ডালের দুই ফল! একটি অতি সুমিষ্ট, যার জন্য মানুষ পাগলপ্রায়। অন্যটি মাকাল ফল, যার বিরুদ্ধে মানুষ অগ্নিশর্মা!
হে আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, তুমি কার? প্রিয় নেতা সৈয়দ আশরাফের, নাকি সুবর্ণচরের ধর্ষকদের? আওয়ামী লীগ, তুমি কার? বাংলার আপামর জনতার? নাকি খুনি-ধর্ষকদের? বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে প্রিয় হওয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা, আপনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু-কন্যা, বাঙালির অহংকার! আপনার সুদৃঢ় নেতৃত্বকে কিছু জঞ্জাল এসে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, আর জাতি তা মাথা পেতে মেনে নেবে, এটা কীভাবে সম্ভব? বিশ্ব নেতৃত্বের চেয়েও আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে বেশি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করে রাখতে চাই। সৈয়দ আশরাফের ভালোত্ব যেমন আপনার ওপর এসে বর্তায়, তেমনি সুবর্ণচরের ধর্ষকদের মন্দত্বও আপনাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। সুতরাং সুবর্ণচরের জঞ্জালদের পরিষ্কার করে আপনি আমাদের তথা বাঙালি জাতির অন্তরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে অম্লান হয়ে থাকবেন, এমনটি আশা করা কী অন্যায়? আমরা সুবর্ণচরের অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার খবরে আলোর আভা দেখলাম। কিন্তু সেই আলো যেন কোনো অন্ধ গলিতে হারিয়ে না যায়, সেটাও নিশ্চিত করা দেখতে চাই। এ ধরনের অন্যায়ের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শেষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এটুকু আশা কী আমরা করতে পারি না?
ইয়াসমিনকে ধর্ষণের ও হত্যার দায় খালেদা জিয়াকে সুমহান করেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরের নারকীয় তাণ্ডব বিএনপি বা খালেদাকে সুমহান করেনি। ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলা করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করা বিএনপি বা খালেদা জিয়াকে মহান করেনি। এসব ঘটনায় যত-না ঘটনা সৃষ্টিকারীরা ধিক্কার পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি ধিক্কার পেয়েছে দল হিসেবে বিএনপি ও নেতা হিসেবে খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া। জনমনের ক্ষোভ কখনো ধিকিধিকি জ্বলে, কখনো সেই ধিকিধিকি আগুনই ধূমায়িত হতে হতে লেলিহান শিখা সৃষ্টি করে। সুতরাং জনমনের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হওয়ার আগেই তাতে পানি দিয়ে নিভিয়ে দিতে হবে। গাঢ় অন্ধকার যেন আর কোনোভাবেই বাংলার বুকে আশ্রয় না পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। অন্ধকার তাড়াতে যত নিষ্ঠুর হওয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি হলেও ক্ষতি নেই।
মাদকের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ জনমনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। হলি আর্টিজানের সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গার জঙ্গি আস্তানায় সফল অভিযান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগ্যতা ও সক্ষমতার প্রমাণ বহন করেছে। এসব অভিযানকে দেশের মানুষ যে সর্বান্তঃকরণে স্বাগত জানিয়েছে, তার প্রমাণ জঙ্গিদের লাশ পর্যন্ত তাদের আত্মীয়-স্বজন নিতে আসেনি। দেশ যেমন অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে, তেমনি আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছে। দেশের মানুষও শান্তির পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিচ্ছে। এটা একটি দেশের উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ধামাচাপা দেওয়ার অবকাশ নেই। কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নও ঘটছে, মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। মানুষের চাওয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রের কর্মের মেলবন্ধন সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। সেই দাবিকে উপেক্ষা করা মানে সমাজকে অবজ্ঞা করা, ধানের গোলায় ইঁদুর ঢুকিয়ে দেওয়া। আমরা দেখতে চাই, রাত পোহাচ্ছে, ভোরের আলোয় সব অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যাচ্ছে। এখন চাই- ‘আলো আলো, আরও আলো!’ আমরা এগিয়ে যেতে চাই তারুণ্যের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোনালি সোপান ধরে! সেই পথে যে বা যারাই বাধা হয়ে আসুক, দল-মত-নির্বিশেষে তাদের সমূলে ধ্বংস করতে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। রবিঠাকুরের ‘ন্যায়দণ্ড’ কবিতার ভাষায় সংকল্প হোক, ‘ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, / হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা / তোমার আদেশে...।’
দল-মত, ধনী-নির্ধন-নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনের শপথও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্ণধাররা নিয়েছেন। সুতরাং এখন জনগণ সেই শপথের সুদৃঢ় প্রয়োগ দেখতে চায়। এতে সমাজ দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। সেই এগিয়ে যাওয়ার সূচনা হোক সুবর্ণচরের গণধর্ষণের বিচারের মধ্য দিয়ে।
যাতে করে আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি-আমরা সভ্যতার পথযাত্রী, আমরা আলোর দিশারী। আমরা যেমন একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার করতে পারি, তেমনি ২০১৯ সালের ধর্ষক, খুনি, মানবতাবিরোধীদেরও সুষ্ঠু বিচার করতে পারি। আমরা যেমন জঙ্গিদের বিচার করতে পারি, তেমনি সন্ত্রাসীদেরও বিচার করতে পারি। আমরা সদা সত্যের পূজারি। মিথ্যা ও অন্যায়ের শত্রু! আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই গৌরবান্বিত হবে। সমাজ সুন্দর ও কল্যাণের পথে অবিচলভাবে এগিয়ে যাবে।

নূরুজ্জামান : কলাম লেখক।
[email protected]

 
Electronic Paper