বছরের সেরা বাছাই
এডওয়ার্ড ফেলসেন্থাল
🕐 ৯:২৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৫, ২০১৯
এডওয়ার্ড ফেলসেন্থাল টাইম ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক। তার এ লেখাটি ভাষান্তর করেছেন জ্যোতির্ময় নন্দী
মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনের উপকণ্ঠে ‘বার্মার সবচেয়ে অন্ধকার নরকের গর্ত’ নামে কুখ্যাত একটি কারাগারে বর্তমানে বন্দি রয়েছেন দুজন তরুণ প্রতিবেদক। তাদের একজন ৩২ বছর বয়সী ওয়া লোন এবং অন্যজন ২৮ বছর বয়সী ক্যও সোয়ে ঊ। পুলিশের গোপনীয় দলিল সঙ্গে রাখার অপরাধে ২০১৭-এর ১২ ডিসেম্বর তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
কারণ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের হয়ে তারা এমন এক প্রতিবেদন তৈরি করেন, যেটাতে ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যার দৃশ্য উদ্ঘাটিত হয়। এটা ছিল সংখ্যালঘু গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংস অভিযানের একটি অংশ। ২০১৮-এর সেপ্টেম্বরে তাদের সাত বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
ক্যও সোয়ে ঊর স্ত্রী চিৎ সু উইন বলেন, ‘সে গ্রেপ্তার হবে এমনটা আমি কখনই আশা করিনি। বরং তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে, এটাই ছিল আমার আশঙ্কার বিষয়।’
কর্তৃত্ববাদী কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন ধরে যেটাকে প্রথম করণীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তা হলো- স্বাধীনতার হৃৎস্পন্দনস্বরূপ তথ্যপ্রবাহ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা। ২০১৮-তে এই কর্মসূচির ফলাফল দৃশ্যমান হতে থাকে। সারা বিশ্বে গণতন্ত্র আজ মুখোমুখি হচ্ছে গত কয়েক দশকের মধ্যকার বৃহত্তম সংকটের।
এর ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে ওপর থেকে আসা নানা রকমের আক্রমণ আর নিচে থেকে আসা নানা রকমের বিষ, পুরনো প্রবৃত্তিকে ক্ষমতা দেওয়া নতুন নতুন প্রযুক্তি, শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকা ব্যক্তিমানুষ আর দুর্বল হতে থাকা প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত ককটেল। রাশিয়া থেকে রিয়াদ হয়ে সিলিকন ভ্যালি পর্যন্ত সত্যের বিকৃতি আর অপব্যবহার ছিল এ বছরের কত যে প্রধান শিরোনামের মধ্যকার সাধারণ সূত্র, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এটা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতারণাপূর্ণ ও ক্রমবর্ধমান একটা হুমকি। চালকহীন সামাজিক মাধ্যম ফেসবুককে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিয়ে যখন হিসাব-নিকাশ চলছে, তথ্যের ঐতিহ্যবাহী উৎসগুলোতে নানা বিপত্তি বেড়েই চলেছে।
২০১৭-এর ২৮ নভেম্বর হাঙ্গেরির ৪০০টিরও বেশি মিডিয়া আউটলেটের মালিকরা এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তাদের ‘স্বদেশবাদী’ প্রধানমন্ত্রীর ‘মিত্রদের’ বানানো একটি সরকারপন্থী কংগ্লোমারেটকে ‘দান’ করে দেন। ২০১৮-এর বসন্তে বিশে^র বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের দুজন সাংবাদিককে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ‘মেরে পালিয়ে যাও’ ধরনের আলাদা দুটি হামলায় হত্যা করা হয়।
একই বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে একটি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা পত্রিকাটির সংবাদ কক্ষে ঢুকে হত্যা করে পাঁচজন সাংবাদিককে। এ বছরের হেমন্তে বোমা হামলার হুমকির মুখে সিএনএন দুবার তাদের অফিস ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে বাধ্য হয়।
‘বছরের সেরা’ নির্বাচন করতে গিয়ে টাইম ৯ দশক ধরে যে মাপকাঠির ওপর নির্ভর করে আসছে তা হলো, সাহস থেকে উদ্ভূত প্রভাব, তার সর্বোচ্চ চেহারায়।
মানুষের অন্যসব গুণের মতো সাহসও আমাদের কাছে আসে বিভিন্ন মুহূর্তে, বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন চেহারায়। এ বছর (১৯১৮-তে) টাইম সাময়িকী চারজন সাংবাদিক এবং একটি সংবাদপত্রকে বছর সেরার স্বীকৃতি দিচ্ছে, যারা সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে মারাত্মক মূল্য দিয়েছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সাংবাদিকরা হলেন- জামাল খাসোগি, মারিয়া রেসা, ওয়া লোন এবং ক্যও সোয়ে ঊ। সংবাদপত্রটি হলো ম্যারিল্যান্ডের ক্যাপিটাল গেজেট অব অ্যানাপোলিস।
এরা হলেন বিশ^জুড়ে সত্য তথ্য প্রকাশের জন্য আরও বড় মাপে অগুনতি যেসব যুদ্ধ চলছে, সেগুলোর প্রতিনিধিস্বরূপ। ২০১৮ সালে সারা বিশে^ কমপক্ষে ৫২ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। শুধু আমাদের সময়ের বা দুঃসময়ের কাহিনী বলার ঝুঁকি নিতে গিয়েই এদের নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, সে কথা আমরা ভুলি কী করে?