ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সুষ্ঠু পরিবেশ বনাম শক্তিশালী অর্থনীতি

উমর ফারুক
🕐 ৯:২৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০২, ২০১৯

আমাদের অধিকাংশ উপকূলীয় জেলার নদী অববাহিকায়, দৃষ্টির পুরোটাজুড়ে কেবল নোনাজল। সে নোনাজলেই এসব অঞ্চলের মানুষের মোটা কাপড়, মোটা ভাত জোটে। নিঃশ্বাসটাও জোটে ওই নোনাজল থেকে। জলের চারপাশ উঁচু মাটির দেয়ালে ঘেরা, তাই এর নাম ঘের। সেখানে চিংড়ি চাষ হয়, যা অর্থনীতিতে সাদা সোনা নামে পরিচিত। এসব অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ওই নোনাজলের ওপর নির্ভরশীল। কেউ চিংড়ি চাষ করে। কেউ সে চিংড়ি বাজারে বেঁচে। কেউবা মাছের পোনা বেঁচে। আবার কেউ মাছে পুশ করে। কারও আবার ব্যবসা বরফের। কারও ব্যবসা পরিবহনের। অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল।

যাদের ঘের নেই, তারা অন্যের ঘেরে শ্রম দেয়, আইল বাঁধে, শ্যাওলা বাছে। ওতেই কোনো রকমে চলে তাদের জীবন। নুন থেকে কাঠ সবই কিনতে হয় ওদের। চারদিকে গাঢ় সবুজের কোনো চিহ্ন নেই। কেবল দু’একটি নারকেল গাছ মাথা তুলে আছে। অন্যসব বৃক্ষ রুগ্ন, মৃতপ্রায়। গরু, ছাগল নেই। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হাঁস-মুরগিও নেই। কিন্তু এসব অঞ্চলের মানুষের জীবন এ রকম ছিল না। জীববৈচিত্র্য এ রকম ছিল না। ছিল অন্য রকম। দুই যুগ আগেও এসব অঞ্চল ছিল সবুজে ভরা। ধান চাষ হতো। সবজি চাষ হতো। এখানকার মানুষের অস্তিত্ব ও নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে ছিল সবুজ চাষাবাদ।
উদাহরণ হতে পারে সাতক্ষীরা জেলা। এ জেলার আশাশুনি উপজেলার নাকতাড়া গ্রাম রাজধানী থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটারের দূরত্ব। তবে সড়কপথে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র ১০ কিমি। নদীপথে তা আর একটু কম। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের নদীর নাম খোলপেটুয়া। খালি চোখে দেখার দূরত্ব। এ গ্রামের গ্রামপুলিশ শিবু পদ গাইন। বাবা ভদ্র গাইন ছিলেন এলাকার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।
‘আগে এ এলাকায় ধান হুতো। আমরা গরু পালতাম। শাক-টাক লাগাতাম। কতো শান্তি ছেলো আমাগি। এখন জমিত আর কিচ্ছু হয় না। হয় খালি কডা চিংড়ি। তাও দাম কোম। গরু-টরু নেই, গাছ-পালাও নেই। পানি তুল্যায় প্রায় ৫০০ ফুট তোলাত্তে। ভবিষ্যতে যে কি হবে আমাগি?’ কথাগুলো বলছিলেন শিবু। বলছিলেন তাদের সবুজময় অতীতের কথা, সুন্দর অতীতের কথা। বলছিলেন, ‘আমাগের বাপ-দাদার পেশা কৃষিকাজ এলাকার মানুষ ছাড়তি চায়নি। তারা বাইদ্য হুয়ে ঘের করে। এ্যান্তে ফিরে আসাডাও সোজা কোতা না। ক্ষতি গুন্তেবে।’
প্রায় দুই যুগ আগে এই এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চিংড়ি চাষ শুরু করে। এলাকার লোকজন তখন প্রতিবাদ করেছিল। গণমানুষ প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু অস্ত্র ও অর্থের কাছে পরাজিত হয়। পরাজিত হয় সবুজ কৃষি। জিতে যায় চিংড়ি, অর্থাৎ সাদা সোনা। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে চাষযোগ্য উপকূলীয় জমির ৫ শতাংশে ঘের করা হচ্ছে। যা থেকে প্রতিবছর আসছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৫ হাজার কোটি।
আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিকাল অ্যাকশনের এক গবেষণায় জানা যায়, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে কৃষিজমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাব মতে, খুলনা বিভাগে স্থানীয় চিংড়ি ব্যবসায়ীরা প্রায় তিন হাজার স্লুইস গেট তৈরি করেছে। বাঁধে অবৈধভাবে ফুটো করা হয়েছে অন্তত ১০ হাজার। এসব অননুমোদিত স্লুইস গেট ও ফুটো প্রতিনিয়ত দুর্বল করে দিচ্ছে বেড়িবাঁধ। সামান্য জোয়ারেই তা ভেঙে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। বিপর্যস্ত হচ্ছে জীবন।
কথা ছিল, চিংড়ি ঘেরের মাধ্যমে এ অঞ্চলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সাদা সোনায় শক্তিশালী হবে অর্থনীতি। কিন্তু তা হয়নি। বরং হয়েছে উল্টো। দারিদ্র্য মানচিত্রে চিংড়ির এক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ঘের ব্যবসায়ে, ছোট ছোট জমির মালিকরা জিম্মি হয়ে পড়ে। যাদের জমি নদী থেকে একটু দূরে তারাও জিম্মি হয়ে পড়ে। নোনাজল পেতে ব্যর্থ হয়। আবার আশপাশের সবাই ঘের করায়, চারদিকে নোনাজল থাকায়, ওই জমিতে অন্য কোনো ফসলও ফলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে একসময় বাধ্য হয়ে তারা প্রভাবশালীদের কাছে কম দামে জমি ইজারা দেয়। বিঘাপ্রতি মাত্র ৮-১০ হাজার টাকায়, এক বছরের জন্য ছেড়ে দিতে হয় জমির অধিকার। ফলে, দারিদ্র্য রেখাটা প্রশস্ত হয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা রেখাটা প্রশস্ত হয়। বিবিএসের ২০১৬ সালের আগস্টে প্রকাশিত জরিপ অনুসারে, দেশে বর্তমানে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
আশার কথা। কিন্তু অবাক করার বিষয়, সাতক্ষীরা জেলার ৫৫ শতাংশ মানুষ এখনো অতিদরিদ্র। ফলে একথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য, চিংড়ি চাষ এ অঞ্চলের গণমানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে আনতে পারেনি বরং নিচে নামিয়েছে। আগে যেসব মানুষ নানা রকম কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত, এখন তারা হয়তো বেকার, নয়তো শহরমুখী। চিংড়ি ঘেরের ফলে, তাদের জীবনে এক নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তাদের জীবিকায় এক নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
আজকের বিশ্বে পরিবেশ বিনাশী নানা কর্মকাণ্ড চলছে। এ জন্য আমরা সবসময় উন্নত দেশকে দায়ী করি। তারাই দায়ী। কিন্তু, ক্ষুদ্র পরিবেশ প্রেক্ষাপটে, স্থানীয়ভাবেও আমাদের কিছু দায় অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশ্বের অন্যতম বিপন্ন এলাকায় পরিণত হতে চলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা বাড়ছে। সম্প্রতি সিডর, আইলা আমাদের উন্নয়ন চিত্রকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে।
আমরা যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কাটছি। ফসলি জমিতে মহাআনন্দে নোনাজল তুলছি। প্রকৃতিকে মহাবিপর্যস্ত ডেকে আনছি। বাস্তুচ্যুত হচ্ছি আমরা। প্রাণ যাচ্ছে আমাদের। ঘের ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক অর্থনীতির বীজ বপন করছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের পকেটে যাচ্ছে উন্নয়নের সুফল। চিংড়ি চাষ আমাদের গণকর্মসংস্থানকে কেড়ে নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে, চিংড়ি চাষ আমাদের অর্থনীতিতে হয়তো ইতিবাচক অবদান রাখছে। কিন্তু ক্ষতি করেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। আমাদের ভাবতে হবে, এটা কী উন্নয়ন নাকি বিপর্যয়? ভাবতে হবে, আমাদের অর্থনীতিতে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ কতখানি ইতিবাচক? প্রশ্ন উঠছে, চিংড়ি চাষ আমাদের সুষম ক্ষুধা-উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কী সত্যিই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে?
আমরা বাগদা চিংড়ি চাষের বিপক্ষে নই। কিন্তু আমাদের চিংড়ি চাষের ক্ষতিকারক দিকগুলো অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। পরিবেশ বিষাক্ত করে, বিপর্যস্ত করে, আমরা কি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারি? চিংড়ি চাষের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্রকে বাধ্যতামূলক করা জরুরি। পরিকল্পিত, বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এই চাষাবাদ বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় তা সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। চিংড়ি চাষের মাধ্যমে প্রত্যাশিত মাত্রায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে? দরিদ্রতা প্রশমনে চিংড়ি চাষের ভূমিকা বাড়াতে হবে। চিংড়ি চাষে পরিবেশ ব্যয়কে সর্বনিম্ন মাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে।
ক্ষুদ্র চাষিদের স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। প্রয়োজনে কৃষি-সমবায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। চিংড়ি চাষের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নোনাজলের পাশাপাশি মিষ্টিজলে চিংড়ি চাষের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান চিংড়ি চাষ প্রক্রিয়ায় মুনাফা একজনের, কিন্তু ক্ষতি সবার। এ প্রক্রিয়া পরিবেশ ও সুষম-উন্নয়নবিরোধী। চিংড়ি চাষকে যদি এখনই নীতিমালার আওতায় আনা সম্ভব না হয় তাহলে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ, প্রকৃতি ও অর্থনীতি খুব শিগগিরই বিপন্ন হয়ে পড়বে।
আমাদের সামনে এখন মাত্র দুটি পথ। যার যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। হয়তো শক্তিশালী অর্থনীতি, নয়তো সুষ্ঠু পরিবেশ। দুটি একসঙ্গে এই মুহূর্তে সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। তবে এই মুহূর্তে আমরা যদি টেকসই পরিবেশকে বেছে নিই তবে দীর্ঘমেয়াদে হয়তো উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু আজ যদি আমরা চিংড়িনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই তবে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে আমাদের সুষ্ঠু পরিবেশযাত্রা। অতএব, আজ ভাবতে হবে আমরা কী সুষ্ঠু পরিবেশ চাই, নাকি শক্তিশালী অর্থনীতি?

উমর ফারুক : শিক্ষক অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
[email protected]

 
Electronic Paper