ভাষার ভবিষ্যৎ
রিক নোয়াক
🕐 ৯:৩২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০১, ২০১৯
রিক নোয়াক, ওয়াশিংটন পোস্টের বিদেশবিষয়ক প্রতিবেদক। নিবন্ধটি ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয় গত ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫-তে। ভাষান্তর করেছেন জ্যোতির্ময় নন্দী
ভাষার প্রশ্নে বিশ্বের বাকি জনগোষ্ঠীর তুলনায় আমেরিকানরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানেই আছে বলতে হবে। কারণ, দেশটিতে যে দুটো ভাষা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ইংরেজি ও স্প্যানিশ, সারা বিশ্বেও এ দুটো ভাষার ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি। তা হলে, মার্কিনিরা কি এখনো ভাষা শিখতে চায়? আধুনিক ভাষা সমিতির (মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাসোসিয়েশান) এক গবেষণা অনুযায়ী, ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষা শিখতে চায় এমন মার্কিন ছাত্রের সংখ্যা ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রায় এক লাখ কমে গেছে। অনেকের বিবেচনায়, ফরাসি ভাষার একটা কোর্স করার চেয়ে অর্থনীতির পাঠ নেওয়া অনেক বেশি কাজের। কিন্তু কথাটা কি সত্যিই যুক্তিসঙ্গত?
চীনের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাগুলো মিলিয়ে অন্য যে কোনো ভাষার তুলনায় বেশি লোক চীনা ভাষায় কথা বলে। এর ঠিক পরের অবস্থানেই রয়েছে উত্তর ভারতের একই উৎস থেকে উদ্ভূত দুটি ভাষা হিন্দি ও উর্দু। ৫২ কোটি ৭০ লাখ ভাষাভাষী নিয়ে ইংরেজি রয়েছে তৃতীয় স্থানে। ৩৮ কোটি ৯০ লাখ ভাষাভাষী নিয়ে স্প্যানিশের অবস্থান পাঁচ নম্বরে, এবং তার চেয়ে প্রায় ১০ কোটি বেশি ভাষাভাষী নিয়ে আরবির স্থান চার নম্বরে।
তা হলে কোন? ভাষা ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে? এ ব্যাপারে পূর্বাভাসগুলো অবস্থান ও উদ্দেশ্য ভেদে বিভিন্ন রকমের। তবে প্রশ্নটার জবাব খোঁজার কয়েকটা পন্থা এখানে তুলে ধরা হলো। আপনি কি প্রবৃদ্ধি বাজারে টাকা কামাতে চান? তা হলে এগুলোই হবে আপনার ভাষা। যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ কাউন্সিল বিশ্বের ২০টি প্রবৃদ্ধি বাজার ও তাদের প্রধান ভাষাগুলো চিহ্নিত করেছে। এ প্রতিবেদনে তথাকথিত ‘ব্রিক’ বা ‘বিআরআইসি’ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন) দেশগুলোর কথা বলা হয়েছে, যেগুলোকে সাধারণত বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বলা হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি, বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান সাখস? এবং সেবা প্রতিষ্ঠান আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর তালিকাভুক্ত অপেক্ষাকৃত কম প্রবৃদ্ধির বাজারগুলোতে প্রচলিত ভাষাসমূহও এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের তৈরি করা এ প্রতিবেদনের সূচকে বিশেষ করে স্প্যানিশ ও আরবিকে ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে। অবশ্য, জাতিসংঘ ২০৫০ পর্যন্ত জনলেখভিত্তিক (ডেমোগ্রাফিক) প্রবণতা বিচার করতে গিয়ে যে ফলাফলটা পেল, তা একেবারেই ভিন্ন রকমের। জাতিসংঘ দেখতে পেল, ২০৫০ নাগাদ বাণিজ্যিক বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করবে হিন্দি, বাংলা, উর্দু ও ইন্দোনেশীয় ভাষা, এবং স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, আরবি ও রুশ ভাষার অবস্থান হবে তার পরেই। নিজের শেখা ভাষা থেকে সর্বাধিক টাকা কামিয়ে নিতে চাইলে, সম্ভবত ওপরের তালিকাভুক্ত কোনো একটা ভাষা শিখে নেওয়াই সবচেয়ে শ্রেয়।
অবশ্য জনলেখভিত্তিক উন্নয়ন সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়াটা একটু কঠিন। তা ছাড়া, ব্রিটিশ কাউন্সিল তাদের প্রতিবেদন তৈরিতে শুধু আজকের প্রবৃদ্ধি বাজারগুলোকেই গণ্য করেছে, কিন্তু এতে অর্থনৈতিকভাবে এখনো যথেষ্ট কম গুরুত্বের জাতিগুলোর আগামীর সম্ভাব্য উত্থান সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি বললেই চলে। উদাহরণস্বরূপ, আরবি এবং চীনা ভাষারও বহু কথ্য ও আঞ্চলিক রূপভেদ আছে, যার সাহায্যে বিদেশিদের ভাবের আদান-প্রদান কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
এ সবকিছু সত্ত্বেও, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে দূরে এবং মূলত দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দিকেই যে বাণিজ্যিক বিশ্বের ভাষা এগিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। জার্মান ভাষা বিশেষজ্ঞ উলরিখ? আমন ১৫ বছর ধরে একটা গবেষণা চালানোর পর সম্প্রতি তার একটা বইয়ে ওই গবেষণার সারাংশ প্রকাশ করেছেন। এ বইয়ে আমন সেসব ভাষা বিশ্লেষণ করেছেন, যেগুলোর দেশীয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং বহির্বিশ্বে ভাষা শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে বিশেষ করে দ্বিতীয়োক্ত বিষয়টি সম্পর্কে মূল উপাত্ত খুব কমই পাওয়া যায়, যে কারণে তিনি ভাষাপিছু ব্যবহারকারীর সংখ্যার ব্যাপারে কোনো আভাস দেননি। বিশ্বের সর্বত্র সর্বাধিক ব্যবহারযোগ্য হিসেবে শেখার জন্য আমন নিম্নোক্ত তিনটি ভাষাকে সবার ওপরে রেখেছেন। এর জন্য আপনার হাতে যথেষ্ট সময় না থাকলেও চিন্তার কিছু নেই। আমনের মতে, এ ক্ষেত্রে নিকট-ভবিষ্যতেও ইংরেজির সর্বোচ্চ স্থানটি বজায় থেকেই যাবে।
১. চীনা ভাষা : আমন বলেন, যদিও চীনা যাদের মাতৃভাষা তেমন লোকের সংখ্যা ইংরেজির চেয়ে তিন গুণ বেশি, তারপরও কিন্তু এটা সারা বিশ্বে সমভাবে ছড়ায়নি। তা ছাড়া, বিজ্ঞানে চীনা ভাষার ব্যবহার হয় কদাচিত, এবং এটা পড়া আর লেখাও কঠিন।
২. স্প্যানিশ : আমন বলেন, স্প্যানিশ যাদের মাতৃভাষা এমন লোকের সংখ্যা চীনার তুলনায় কম হলেও, তা পুষিয়ে গেছে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে এটা বিশেষ জনপ্রিয় হওয়ার এবং বিশ্বব্যাপী বিদ্যালয়গুলোতে এটা শেখানো হওয়ার সুবাদে।
৩. ফরাসি : আমন লিখেছেন, গত কয়েক দশকে ফরাসি বিশেষ করে ইউরোপে কিছু জায়গা হারিয়েছে। তবে, যেখানে এখনো এ ভাষার যথেষ্ট ব্যবহার রয়েছে, সেই পশ্চিম আফ্রিকা রাজনৈতিকভাবে আরও স্থিতিশীল এবং বাণিজ্যিকভাবে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারলে ফরাসির প্রভাব আবারও বেড়ে যাবে।
২০১৪ সালে বিনিয়োগ ব্যাংক নাটিক্সিসের এক গবেষণায় জানা যায়, ২০৫০ সালের মধ্যে ফরাসি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা হয়ে উঠবে। গবেষণাপত্রটির রচয়িতারা আফ্রিকায় ডেমোগ্রাফিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। আমন বলেন, ‘বহু ছোট ছোট দেশেও ফরাসি ব্যাপক প্রচলিত।’ নাটিক্সিসের গবেষণায় অবশ্য একটা সত্যকে হিসেবে নেওয়া হয়নি; সেটা হলো : ফ্রান্সের বাইরে যেসব দেশে ফরাসি ব্যবহৃত হয়, সেখানে কিন্তু সবাই এ ভাষায় আসলে খুব একটা সাবলীল না।
সম্প্রতি একদল আন্তর্জাতিক গবেষক সারা বিশ্ব থেকে জড়ো করা ২২ লাখ গ্রন্থানুবাদ বিশ্লেষণ করেন। ইউনেস্কোর ইন্ডেক্স ট্রান্সলেটিয়োনাম প্রকল্পের জোগানো উপাত্তসমূহের ভিত্তিতে তারা যেসব সিদ্ধান্তে পৌঁছেন, সেগুলো সাংস্কৃতিকভাবে বিশেষ গুরুত্ববহ তথাকথিত কেন্দ্রীয় ভাষাগুলোর (Hub Languages) ব্যাপারে গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাভের সহায়ক। অপেক্ষাকৃত ছোট ভাষায় কোনো বই প্রকাশিত হলে, সচরাচর সেটা কোনো-না-কোনো কেন্দ্রীয় ভাষায় অনূদিত হয়। কেন্দ্রীয় বা প্রধান ভাষাগুলোকে চরিত্রায়িত করা হয় তাদের কেন্দ্রীয় অবস্থান, বহু-সংযোজ্যতা, এবং দেশগুলোর সম্পর্কের জোরের ওপর। উদাহরণস্বরূপ, আজারবাইজান থেকে প্রকাশিত প্রায় সব বই-ই রুশ ভাষায় অনূদিত হবে। রুশ ভাষা থেকে একটা বই ইংরেজি ভাষাতে অনুবাদ হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি, কারণ লিখিত প্রকাশনার ক্ষেত্রে ইংরেজিই হলো বিশ্বের প্রধান কেন্দ্রীয় ভাষা। ফরাসি, এবং ইতালীয়, জার্মান, ওলন্দাজ প্রভৃতি অন্য কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষাও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ভাষা।
কোনো একটি ভাষার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তার অতি-সম্প্রতি অর্থনৈতিক বা ডেমোগ্রাফিক গুরুত্বের সঙ্গে সমানুপাতিকভাবে সম্পর্কিত নয় : জার্মান, ওলন্দাজ, কিংবা এমনকি রুশ ভাষাও এখানে আজ পর্যন্ত অসমানুপাতিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করে।
গবেষকদের অন্যতম শাহার রনেন বলেন, আগামী দিনে কোনো একক একটা ভাষা প্রধান হয়ে উঠবে না। বরং ভাষা শিক্ষার্থীদেরই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে, তারা আসলে কী চায়, তাদের ঝোঁকটা কোন দিকে।