নির্বাচনে উৎসবের বাড়াবাড়ি কাম্য নয়
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
🕐 ৯:২৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৮
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়েছেন, তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। তবে নির্বাচন কখনই উৎসবমুখর হওয়া উচিত নয়। নির্বাচনের সঙ্গে উৎসব একটি বেআইনি শব্দ। নির্বাচনে উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকতে পারে। সহিষ্ণুতাও থাকবে। কিন্তু উৎসব বললে নির্বাচনে হইহুল্লা হবেই। কারণ উৎসব মানে আতশবাজি পোড়ানো, গরু জবাই করে মানুষকে খাওয়ানো, ট্রাকযোগে গান, বাদ্যযন্ত্র বহন করা। পৃথিবীর আর কোনো দেশে নির্বাচনের সঙ্গে উৎসব যুক্ত করে না।
কোনো দেশে নির্বাচন উৎসবও হয় না। বাংলাদেশে নির্বাচনের সঙ্গে উৎসবমুখর শব্দটির উৎপত্তি আমার জানা নেই। কিন্তু উৎসবের নামে আমাদের দেশে যা করা হয়, তা নির্বাচনী আইনে নেই। নির্বাচন হতে হবে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। নির্বাচনে মানুষকে পর্যাপ্ত তথ্য দিতে হবে। যাতে ভোটাররা সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আবার নির্বাচন কোনো খেলাও নয় যে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে এটাকে খেলার মাঠ বানানো যাবে না।
নির্বাচন কোনো খেলা হতে পারে না। আগামী ৫ বছর জাতি কোন দিকে যাবে, দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে? এই সব চিন্তা করে ভোটারকে ভোট দিতে হবে। কোন প্রার্থীদের ভোট দিলে তারা আগামীদিনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন? সেই সব তথ্য জনগণকে দিতে হবে। অর্থাৎ ভোটারদের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। মূলত সেই কাজটিই রাজনৈতিক দল এবং গণমাধ্যমকে করতে হবে। এ কাজ করতে গিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকতে পারে। কিন্তু উৎসবমুখর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মনোনয়ন নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটেছে।
ধানমন্ডি কিংবা পল্টনে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন আবেদন ফরম বিতরণের যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো ব্যতিক্রমী। মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষোভ, বিক্ষোভ অনেক কিছুই ঘটেছে। কিছু অর্থ বাণিজ্য হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে এসব ঘটনা মীমাংসাও হয়ে যাচ্ছে। একজনকে মনোনয়ন দেওয়া আবার ফেরত নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
তবে নভেম্বরের সংলাপ থেকে শুরু করে আজ অবধি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দশম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত নির্বাচনগুলোতে এর চেয়ে ভালো অবস্থা আগে কখনো বিরাজ করেনি। দুই-তিনটি ঘটনা বাদ দিলে আর কোনো বড় ধরনের ঘটনা সারা দেশে কোথাও ঘটেনি। আমি মনে করি, নির্বাচনে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করবে।
আমার প্রত্যাশা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে অবস্থা আরও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়বে। তবে নির্বাচন উৎসবমুখর করতে গিয়ে যেন বেশি বাড়াবাড়ি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচনে নেতিবাচক প্রচার প্রচারণা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও নেতিবাচক প্রচারণা ছিল। বলা হয়েছিল যারা নৌকা মার্কার প্রার্থী, তারা ভারতের দালাল, হিন্দু ইত্যাদি। পরবর্তীকালে নেতিবাচক প্রচারণার এই ধারা ছয় দফার আন্দোলন থেকে শুরু করে সব কিছুতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে যত শক্তি আছে, তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল ভারতবিরোধিতা, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি এবং ধর্মান্ধতা। প্রত্যকটি নির্বাচনে তারা এগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও উস্কে দেয়। এর ধারাবাহিকতা আজও চলছে।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। সুলতান মনসুরসহ অনেকে আবার জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছেন। তাই বলে তারা নেতিবাচক চিন্তা থেকে বের হয়ে আসছেন- এমন ভাবলে ভুল হবে।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বাকস্বাধীনতা, ভোটের অধিকার যত কথা বলা হোক আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি এবং জামায়াতকে সেই পুরনো ধাঁচের কথাবার্তাই বলতে হবে। তা হলো ভারতবিরোধিতা, ধর্ম চলে যাওয়া, ধর্মাশ্রয়ী বক্তব্য। এগুলোতে তাদের ফিরে আসতেই হবে। কারণ এগুলোই তাদের রাজনীতির মূলধন।
বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি একটি আদর্শের ওপর টিকে আছে প্রায় ৩৫ বছর পর্যন্ত। বিশ্বে সামরিক শাসকদের কোনো রাজনৈতিক দলই টিকে নেই। ধর্মাশ্রয়ী মুসলিম লীগ ভাবধারা নিয়েই কেবল বিএনপি টিকে আছে। কিছুদিন পর তাদের সামনে বলার আর কিছু থাকবে না। দুই চার দিন পর একই কথা তাদের বলতে হবে। উন্নয়ন নিয়ে তাদের কথা বলার সুযোগ নেই। দেশের বর্তমান উন্নয়নের চেয়ে তাদের সময়ে অনেক বেশি উন্নয়ন হয়েছে বলার সুযোগও নেই। দুর্নীতির কথা বলারও সুযোগ নেই।
কারণ দুর্নীতির দায়ে তাদের শীর্ষ নেতারা উচ্চ আদালত পর্যন্ত দণ্ডিত হয়েছে। কাজেই তাদের আবার পুরনো ধারায় ফিরে যেতে হবে। ভারতবিরোধিতা, ভারত সব কিছু নিয়ে গেল এবং ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির ওপর তাদের নির্ভর করতেই হবে।
নির্বাচনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতিবাচক প্রচারণা নতুন নয়। ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে কথা বলা, অপবাদ দিয়ে প্রচারণা কেবল আমাদের দেশে নয়, আমেরিকাতেও হয়। ছাত্রজীবনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কোন নারীর সঙ্গে কী করছেন সবই সম্মুখে চলে আসে। নায়িকারা প্রমাণ নিয়ে এসে বলেন, আমার সঙ্গে এই হয়েছে। এগুলো সারা পৃথিবীতে হয়ে থাকে। এগুলো কমবে না বরং বাড়বে।
কারণ সামাজিক মাধ্যমে কিছু ব্যক্তিকে অ্যাসাইন করে বসানো হয়েছে, তারা সারাক্ষণ উত্তেজনাকর, ধর্মাশ্রয়ী, সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্রূপ, অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্র সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রদান করছে।
ইতোমধ্যেই কীভাবে উস্কানি দেওয়া যায়, রাজনৈতিকভাবে ফায়দা লুটা যায় এসব নিয়ে অনেক কাজ শুরু হয়েছে। আগামীদিনে এসব কর্মকাণ্ড আরও বাড়বে। নতুন করে বিএনপির বলার কিছু নেই। টিকে থাকার জন্য ধর্ম, ধর্মান্ধতা, ভারতবিরোধীর মতো কাজ তাদের করতে হবে। এর থেকে দূরে অবস্থান করলে তাদের ভোট ব্যাংক নষ্ট হবে।
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়