ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিভাজনের ট্র্যাজেডি

কুলদীপ নায়ার
🕐 ৯:২৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৮

ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভাজন অথবা হিন্দু ও মুসলিমদের দেশান্তরী হওয়া এখন ৫৭ বছরের পুরনো ঘটনা। আমার মনে পড়ছে, ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট আমি শিয়ালকোটের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম, কারণ নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান অমুসলিমদের পোষণ করতে রাজি ছিল না, ঠিক যেমন পূর্ব পাঞ্জাব চাইছিল না তাদের মধ্যে কোনো মুসলমান থাকুক।

আমি অবশ্য সীমান্ত পেরিয়েছিলাম স্বাধীনতার ৩২ দিন পর। ততদিনে হত্যা আর লুটপাটের উন্মত্ততা স্তিমিত হয়ে এসেছে। হিন্দু আর মুসলিমরা সংঘর্ষে লিপ্ত বা খুনোখুনি করছে, এমন কিছু আমি দেখিনি।
আমি দেখেছি অসংখ্য নারী-পুরুষের বেদনাদীর্ণ মুখ, যারা চলেছে তাদের যৎসামান্য জিনিসপত্রের পোঁটলা-পুঁটলি মাথায় চাপিয়ে, আর তাদের পেছন পেছন যাচ্ছে ভীত-ত্রস্ত মুখে শিশুরা। হিন্দু আর মুসলিম-উভয় পক্ষই পেছনে ফেলে এসেছিল তাদের ঘরগেরস্থালি, বন্ধুবান্ধব আর পাড়াপ্রতিবেশীদের। ইতিহাসের দংশনে উভয় দলই ছিল ছিন্নবিচ্ছিন্ন। উভয়েই ছিল উদ্বাস্তু শরণার্থী।
দেশ বিভাজনের ট্র্যাজেডি ছিল ভাষায় প্রকাশের অতীত বেদনাময়। কিন্তু এটাকে হিন্দু বা মুসলিম সমস্যা বলা মানে হলো এটার একটা রাজনৈতিক চেহারা দেওয়া। দুর্ভাগ্য হলো, এটা যেমন পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে জাগিয়ে তুলবে, তেমনি তুলবে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
কেন দুটো সম্প্রদায়, যারা এত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করে এসেছে, এখন পরস্পরকে হত্যা করছে? উপমহাদেশের বিভাজনের জন্য কারা দায়ী, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টার চেয়ে অর্থহীন কাজ আর কিছুই হতে পারে না। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রলম্বিত ঘটনাবলির পারম্পর্য খোঁজা এখন কেবলমাত্র অ্যাকাডেমিক গবেষণার বিষয় হতে পারে।
উপমহাদেশের বিভাজনটা ছিল গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো। সবাই বুঝতে পারছিল কী ঘটছে। তারপরও কারও ক্ষমতা ছিল না ওটাকে ঠেকানোর। দেশের আবহ এত বেশি দূষিত হয়ে পড়েছিল যে, সে-অবস্থায় গণহত্যা আর দেশান্তরী হওয়া ঠেকানোর কোনো উপায় ছিল না।
দেশভাগের ফলে কি মুসলমানদের উদ্দেশ্য সাধন হয়েছে? আমি জানি না। সে-দেশে (পাকিস্তানে) আমার ভ্রমণকালে লোকজনকে বলতে শুনেছি, অন্ততপক্ষে ‘হিন্দু আধিপত্য আর হিন্দু আগ্রাসন থেকে মুক্ত একটা জায়গা’ পেয়ে তারা সুখী। কিন্তু আমার মনে হয় যে, মুসলিম হিসেবেই মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি লোকসান দিচ্ছে। তারা এখন তিনটে রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভেবে দেখুন, যদি তারা অবিভাজিত উপমহাদেশে থাকতো, তাহলে তাদের সংখ্যা, তাদের ভোট কত বেশি প্রভাব ফেলতে পারতো! তারা হতো মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ওয়াগাহ্-অমৃতসর সীমান্ত থেকে আমি ফিরেছি ভাঙা মন নিয়ে। তার কারণ এ নয় যে, সেখানে অনুষ্ঠিত সূর্যাস্ত কুচকাওয়াজে সৈন্যরা তাদের সামরিক শৌর্য প্রদর্শনের বহর কিছুমাত্র কমায়নি; বরং এ জন্য যে, ওখানে আরেকটি কুৎসিত জিনিস দেখা গেছে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কয়েকটি বোর্ডে ছবি খোদাই করে দেখিয়েছে, দেশবিভাগের সময় কীভাবে হিন্দু আর শিখরা মুসলমানদের হত্যা এবং লুটপাট করেছে। ছবিগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে যেন শুধু ভারত থেকেই ওগুলো দেখা যায়। পাকিস্তানের দিক থেকে ওগুলো দেখা যাবে না, কারণ বোর্ডগুলোর পেছন দিকটা সাধারণ বিলবোর্ডের মতোই।
ছবিগুলোতে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে যথেষ্ট আক্রমণাত্মক এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের দিক থেকে কলুষিত। গত দুমাসের মধ্যে এগুলো বসানো হয়েছে, সম্ভবত ভারতের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি পাকিস্তানে ক্রমশ জোরদার হয়ে ওঠার কারণে এবং স্বাধীনতার ছয় দশক পর গত বছর এই প্রথম প্রায় ৫০ জন লোক সীমান্তের জিরো পয়েন্টে এসে বাতি জ্বালানোর কারণে।
তা ছাড়া, সীমান্তে বসানো এসব ছবিতে সত্যকে দেখানো হয়েছে বিকৃতভাবে। বর্বরতা যা-ই ঘটুক না কেন, উভয় পক্ষেই ঘটেছে। পাকিস্তানে এর শিকার হয়েছে হিন্দু এবং শিখরা, আর ভারতে মুসলিমরা।
নবজাত উভয় দেশেই ছিল একই কুৎসিত দৃশ্য, বর্বরতায় কেউ কারও চেয়ে কম যায়নি। নারী আর শিশুরাই ছিল এ বর্বরতার সবচেয়ে অসহায় শিকার।
কেউ যদি আমাকে বলতে বলেন, হিন্দু ধর্ম অনেক বেশি উদার বা ইসলাম ধর্মে প্রেমের বহিঃপ্রকাশ বেশি, আমি মাফ চেয়ে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করব। আমি দেখেছি, দুই ধর্মের অনুসারীরা কীভাবে ধর্মবিশ্বাসের নামে খুন করছে।
‘হর হর মহাদের’ এবং ‘ইয়া আলী’ ধ্বনি তুলে তারা একে অন্যকে তরবারি বা বল্লমে বিদ্ধ করছে। সেই সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ে এ ধরনের কিছু ঘটনা ধরে রাখা হয়েছে। রামানন্দ সাগরের বিখ্যাত বই ‘অউর ইনসান মর গয়া’ (এবং মানুষ মরে গেছে) এবং বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক কৃষণ চন্দরের ছোটগল্প ‘পেশাওয়ার এক্সপ্রেস’-এ বর্ণিত হয়েছে মানুষের মধ্যে শয়তান জেগে উঠলে কীভাবে মানুষ মারা পড়ে।
এ ছাড়া আছে উর্দুতে সাদাত হাসান মান্টোর কিছু ছোটগল্প, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন দুটো সম্প্রদায়ের মানুষ তখন কীভাবে অপরাধপ্রবণতা আর নির্মমতার শিখর ছুঁয়েছিল।

 
Electronic Paper