ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমরা বিস্মিত ডক্টর সাহেব!

মঞ্জুরুল আলম পান্না
🕐 ৯:৪৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৮

ড. কামাল হোসেন একজন বিদগ্ধজন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ। তার চেয়ে বড় কথা তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমাদের যে সংবিধান, তা তার নেতৃত্বেই প্রণীত হয়েছে। তার প্রতি দেশের মানুষের একটা শ্রদ্ধাবোধ আছে। সরকারবিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্ট গড়া, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করা এবং পরবর্তীতে আরও অনেক ঘটনায় তিনি নতুন করে আলোচিত যেমন হয়েছেন, সমালোচনারও শিকার হয়েছেন। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন শেষে পরপর দুটি ঘটনা আমাদের রাজনীতির করুণ চিত্র তুলে ধরেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ড. কামাল যা বললেন তাতে বিস্মিত এবং হতবাক হতে হয়েছে আমাদের। পরবর্তীতে স্মৃতিসৌধ স্থান ত্যাগ করার সময় তার গাড়িবহরে হামলার ঘটনাও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথম ঘটনার জন্ম তিনি নিজে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টির জন্ম সরকার সমর্থকদের বলেই ধরে নেওয়া যায়।

ড. কামাল হোসেনকে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, আগামী নির্বাচনে জামায়াত প্রসঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান সম্পর্কে। এ প্রসঙ্গে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইলেন না শহীদ মিনারের (বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধকে বোঝাতে চেয়েছেন) পবিত্রতা রক্ষার দোহাই দিয়ে। সবিনয়ে তার কাছে জানতে চাই, জামায়াত সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করলে কী শহীদ মিনারকে অশ্রদ্ধা করা হয়? বরং তাদের আড়াল করার চেষ্টাতেই কী শহীদের আত্মা কেঁপে ওঠে না?
বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দিনটি তো ওই প্রশ্নের জন্য অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ কিংবা শহীদ মিনারই তো বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী বা যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে কথা বলার উপযুক্ত জায়গা। এই শহীদ মিনারই তো শোষণ-বঞ্চনা আর অগণতান্ত্রিক সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাঙালির দৃপ্ত স্লোগানের পবিত্র স্থান। একাত্তরে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল আল বদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা করা তাদেরই।
সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করার সময় আগামী নির্বাচনে জামায়াত বিষয়ে ড. কামাল সাহেবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান জানতে চাওয়াটা অবশ্যই অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তাহলে উল্টো তিনি খেপে গেলেন কেন? এতখানি উত্তেজিত হলেন কেন? কেন তিনি সাংবাদিকদের ওভাবে ধমক দিলেন? প্রশ্নকারী সাংবাদিকদের চিনে রাখার অর্থাৎ দেখে নেওয়ার হুমকি দিলেন? একথা সত্য, আমাদের অনেক অপ্রশিক্ষিত নবীন সাংবাদিক জানেন না-কাকে কোথায় কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ভিড় ঠেলে বের হওয়ার পথ আটকে ধরে প্রশ্ন করা হয়েছিল বলেই কি ড. কামাল অতটা বিরক্ত হয়েছিলেন? না কি বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটি ক্লান্ত মানসিকতায় ধৈর্যচ্যুত হয়ে কোনো কারণ ছাড়াই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন? না কি জামায়াত প্রসঙ্গটি সত্যি সত্যিই তার জন্য বিব্রতকর বিধায় এত বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি? আমার ধারণা, সর্বশেষ বিষয়টিই চরম সত্য।
একই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে গণফোরাম নেতাদের নির্বাচন করার বিষয়ে কামাল সাহেবের কাছে কোনো সদুত্তর নেই। কারণ, ঐক্যফ্রন্ট গড়ার শুরুতে কামাল সাহেবরা বলেছিলেন, ঐক্যফ্রন্টে আসতে হলে বিএনপিকে জামায়াত সঙ্গ ছেড়েই আসতে হবে। তারা তাদের স্ট্যান্ড ধরে রাখতে পারেননি। আপস করেছেন স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ড. কামাল হোসেনকে যতটুকু জানি, তিনি তরুণদের বিশেষ করে তরুণ সাংবাদিকদের বেশ পছন্দ করেন। টেলিভিশনে কাজ করার শুরুর দিকে যখনই তার কোনো ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছি, সবসময়ই উনি বলতেন, ‘আপনাদের মতো তরুণরাই এ দেশকে বদলে দেবে। টেলিভিশনে আপনাদের মতো সাংবাদিকদের ভূমিকা দেখে খুব ভালো লাগে’। সেই তরুণ সাংবাদিকদের অত্যন্ত যৌক্তিক এবং স্থান-কাল-পাত্র উপযোগী জামায়াত সম্পর্কিত প্রশ্নে তার অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া খুব সহজেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঘটনাটি হয়তো অনেকের কাছে ছোট কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাপক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল তখনো অনেক ধরনের প্রতিবাদ উঠেছে, লেখালেখি হয়েছে; এখনো একইভাবে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে নিয়ে কামাল হোসেন-কাদের সিদ্দিকী-আ স ম রবরা যখন পরোক্ষভাবে ঐক্যফন্টের ছাতার তলায় নির্বাচন করছেন তখনো প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তারা যে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছেন সেই ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করছেন জামায়াতের ২৫ নেতা। পাকিস্তানি সেনাদের হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান যেমন এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন সেই বিষয়েও সাংবাদিকরা কথা তুলেছেন, যেমন তোলা হয়েছে হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতার বিষয়ে নানান প্রশ্ন।
সেদিন হাজারও মানুষের ভিড়ে প্রথম দিকে কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর স্বাভাবিকভাবেই দিচ্ছিলেন কামাল সাহেব, জামায়াত প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠাতেই বাধল যত বিপত্তি। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চুপ করতে বললেন সাংবাদিকদের। যত দোষ নন্দ ঘোষ, যত দোষ সাংবাদিকদের। কেউ আইন করে সাংবাদিকদের চুপ করতে বলেন, কেউ বলেন সরাসরি ধমক দিয়ে। এই যা পার্থক্য।
একই দিনে ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের গাড়িবহরে দুর্বৃত্তদের যে হামলা হলো, এতে নতুন করে নিন্দা জানানো কিংবা বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এ ধরনের ন্যক্কারজনক হামলা এখন ডাল-ভাত হয়ে গেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল থেকে শুরু করে বিরোধী নেতাদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটে চললেও সরকার কিংবা প্রশাসনের কোনো বিকার নেই। এসব হামলা যে ওপরওয়ালাদের প্রত্যক্ষ মদদে ঘটছে তা বলাবাহুল্য।
মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে রাজনীতির হীনস্বার্থে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলা; তাদের অপকর্মকে আড়াল করার চেষ্টা; গণতন্ত্রের কথা বলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির টুঁটি চেপে ধরা; গণমাধ্যমের ওপর খড়গহস্ত হওয়া; সবই এখন প্রতিযোগিতাময়, অসুস্থ রাজনীতির প্রধানতম অংশ। তবে আলো ফুটবেই, ভোর হতেই হবে।

মঞ্জুরুল আলম পান্না : সাংবাদিক, কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper