ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভোট বিক্রির জন্য নয়

আবু বকর সিদ্দীক
🕐 ৯:২২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৮

ভোট উৎসবে মাঠে নেমেছে মৌসুমি ক্রেতারা। রাজনীতির নামে বেনিয়ারা টাকা দিয়ে কিনতে চায় নাগরিক অধিকারের অমূল্য সম্পদ। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তাদের এজেন্ট ভোট কেনার মিশনে নেমেছে।

প্রান্তিক মানুষের কাছে জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনই অন্যতম উৎসব। ভোটাধিকার আছে বলেই সমাজের অনেক উঁচুস্তরের মানুষ তাদের ভাঙা ঘরের দরজায় নেমে আসে। বিভিন্ন আত্মীয়তার সূত্র ধরে আপন করে নেয়, সম্পর্কের জায়গাগুলো উজ্জ্বল হয়। এ সময় অনেক নামি-দামি মানুষ মাটির মানুষের মতো আচরণ করে, আপন করে নেয়।

নির্বাচনী আয়োজন ঘিরে তারা একঘেয়েমি জীবনের আশা-ভরসা ও সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। একটি ব্রিজের অভাবে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না, সড়কের দুরবস্থার কারণে তাদের হাটে ও হাসপাতালে যেতে ভোগান্তি হচ্ছে এবং বিদ্যুতের অভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী এসব নির্বাচনে আশার আলো দেখে। বৈষম্য ও অধিকারবঞ্চিত মানুষ অল্পতেই খুশি হয়। তারা পরিশ্রম করে বাঁচতে জানে, কারও কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নেওয়া তাদের কাছে ভয়ানক কষ্টের। নদীভাঙনকবলিত মানুষ ভয়ানক দুরবস্থার মধ্যে ত্রাণ ফিরিয়ে দেয়, তারা বাঁধ নির্মাণের দাবি তোলে। ব্যক্তিগত সুবিধার বাইরে এই নির্বাচন তাদের গোষ্ঠীগত ও সামাজিক উন্নয়নের ইশতেহার হয়ে পড়ে।

জাতীয় নির্বাচন শুরু হলেই তৎপর হয়ে পড়ে টাকাওয়ালা মানুষ। বাণিজ্যের প্রসারে তারা ব্যাংক দখল করে থাকে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা ব্যবসা ও ব্যক্তিগত ভোগবিলাসকে সুরক্ষিত করতে রাজনৈতিক নিরাপত্তা চায়। আদর্শিক জায়গায় শূন্য ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও তারা টাকার জোরে জনপ্রতিনিধির তকমাটি কব্জা করতে চায়। ক্ষমতামুখী সব দলেই সুবিধাভোগী কিছু মানুষ ঘাপটি মেরে থাকে। সাদা পোশাকের আড়ালে তারা কেনাবেচার অনৈতিক ইজারা নেয়। অনেকটা উৎসবের কোরবানির মতোই দরদাম হাঁকিয়ে প্রার্থী বেচাবিক্রি করে।

পত্রপত্রিকায় ও অনলাইন মাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি হয়। মাটির সঙ্গে সম্পর্ক নেই এসব প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েই ফিরে আসে রাজধানীতে। সেখানে তারা ফুলেফেঁপে ওঠে। কেটেছেঁটে দাখিল করা হলফনামাতেও তাদের সম্পদের বহর দেখে আঁতকে ওঠে মানুষ। ক্ষমতার রসদ পেয়ে আজকের ভালো মানুষ, ফুলের মতো পবিত্র ভোটপ্রার্থীরা এক মেয়াদে সম্পদ বাড়ায় শতগুণ, কেউ কেউ তারও বেশি। কিন্তু ভোটারের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাতাসে ভেসে যায়, ঘাম ঝরানো মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটে না। স্থানীয় উন্নয়ন বরাদ্দের সিংহভাগ চলে যায় একক ব্যক্তির পকেটে।

সহজ করে বললে, এ অনিয়মটাই আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। আইনপ্রণেতা হিসেবে যেসব মহামানব তৃণমূলের দরজায় দরজায় ভোটের জন্য যাচ্ছে, দুদিন পরে আকাশের চাঁদ ছোঁয়া গেলেও তাদের দেখা অজপাড়াগাঁয়ে পাওয়া যায় না। তখন তারা সুরক্ষিত ভদ্রপল্লীর আয়েশি বাসিন্দা।

অকল্যাণ এ রাষ্ট্রব্যবস্থা এক দিনে নির্মূল হবে না। মহান স্বাধীনতার চেতনা ও প্রগতিশীলতার প্রগলভ কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে তা কোনো কাজে আসবে না। এবার বিপুলসংখ্যক তরুণ নতুন ভোটার হিসেবে নাগরিকের স্বাক্ষর রাখবে। নষ্টদের দখলে থাকা দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকে মুক্ত করতে হলে এই তরুণদের জেগে উঠতে হবে।

বহুবার, দেশের ক্রান্তিকালে তরুণরাই হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। তারুণ্যের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই মহান স্বাধীনতাসহ জাতির অর্জনগুলো আমাদের হয়েছে। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে যুবরা লড়েছে, তাদের আন্দোলন সংগ্রামেই রচিত হয়েছে বীরত্বের ইতিহাস। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে না জানা এই তরুণ প্রজন্মই আলোর মশাল নিয়ে জাতিকে পথ দেখিয়েছে, নাড়িয়ে দিয়েছে শাসকদের ভিত। তাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাছে হার মেনেছে অনিয়ম। নানা কারণে দেশ আজ মহাসংকটে। বিপর্যয় কাটিয়ে স্বমহিমায় এ দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলা ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যোগ্য লোকের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া জরুরি।

চলমান নির্বাচনে যেসব প্রার্থীর সঙ্গে মাটি ও মানুষের সম্পর্ক নেই, দায়বদ্ধতা ও আঞ্চলিক টান নেই তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। সাময়িক কিছু নগদপ্রাপ্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে দীর্ঘমেয়াদি কুফল ডেকে আনা যাবে না। বসন্তে বেড়াতে আসা এসব মৌসুমি পাখিকে না বলে যে প্রার্থী এলাকায় থাকে, অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখে পাওয়া যায় তার পক্ষে হ্যাঁ বলুন।

তরুণদের প্রথম ভোট, প্রথম প্রেমের আরাধ্য। এই ভালোবাসা ও আবেগ কোনো অবস্থাতেই বিক্রি করা যাবে না। বৈষম্য ও অপশাসন রুখতে যোগ্য লোককেই নির্বাচিত করতে হবে। সেখানে কোনো অবস্থাতেই টাকার কাছে নিজের বিবেক ও মর্যাদা বিলিয়ে দেওয়া যাবে না।

‘ভোট বিক্রির জন্য নয়’ স্লোগানে আজই আশপাশের সমমনাদের বলতে থাকুন। তরুণরা আজকের সামাজিক যোগাযোগসহ অনলাইন গণমাধ্যমে সজাগ থাকে। তারা সব বিষয়েই সচেতন। আমার বিশ্বাস, এ আন্দোলন জোরদার হবে। সব এলাকাতেই এই নতুন ভোটাররা তাদের প্রথম প্রেমকে বিক্রি করবে না।

বন্ধুদের উৎসাহিত করবেন, আগামী প্রজন্মের মুক্তির জন্য এ ভোটযুদ্ধে কারও কাছ থেকে কোনো অনৈতিক সুবিধা নেওয়া যাবে না। নিজে ভোট বিক্রি করবে না। ভোট বিক্রি আর মাথা বিক্রি সমান। অন্যকেও এ থেকে বিরত থাকার আহ্বান করবে। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ ও সর্বোপরি স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখার এ সুযোগ অবশ্যই আমাদের শ্রেষ্ঠ তরুণরা হাতছাড়া করবে না। ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন থেকে সবাই উচ্চকিত হোক, ভোট বিক্রি করবে না, টাকাওয়ালা প্রার্থীর হাতে টাকার বিনিময়ে আত্মসম্মান হারাবে না।

রাজনীতির সুষ্ঠু ও শুদ্ধধারা ফিরিয়ে আনতে আমাদের তরুণদের শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। মেধাবী প্রজন্ম অস্থিতিশীল ও লেজুড়বৃত্তির বলয়ে নষ্টদের কবলে পড়ছে। এখানে মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে কিছু নগদপ্রাপ্তির বিপরীতে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে অনেক সম্ভাবনাময় যুবক। বদলে দেওয়ার মিছিলের সে কণ্ঠগুলো কথিত নেতাদের চক্রে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।

রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন না হওয়ায় বহু সমালোচিত নেতারা আবারও জয়ের মালা পরছে। সামন্তবাদ প্রথার মতো তারা নির্দিষ্ট মেয়াদে টেন্ডার পাওয়ার আলোকে লুটেপুটে খাচ্ছে, মানুষের কষ্টার্জিত টাকা, উন্নয়নের বরাদ্দ এবং অবৈধ ব্যবসা থেকে হাতিয়ে নিয়ে টাকা বিদেশে জমাচ্ছে। এসব নেতারা নিজেদের ছেলেমেয়েকেও দেশে রাখে না। শুধু টাকা কামানোর জন্যই তারা রাজনীতি করে, আজ এখনই তাদের এ ভোটের টাকায় থুতু ছিটিয়ে উপযুক্ত জবাব দিতে হবে।

আবু বকর সিদ্দীক : সংবাদকর্মী
[email protected]

 
Electronic Paper