ঠেঙ্গামারা গ্রাম ও একজন হোসনে আরা
মো. আব্দুল হামিদ
🕐 ৯:৫৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১২, ২০১৮
বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী কোম্পানি অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস খ্যাতির শীর্ষে থাকাবস্থায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। প্রতিটা মিনিট প্রচণ্ড ব্যস্ততায় কাটানো মানুষটাই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনতে থাকেন। আমাদের চারপাশে আকস্মিক মারা যাওয়া মানুষের জন্য আমরা ব্যথিত হলেও একদিক থেকে তারা খুব ভাগ্যবান। কারণ ‘মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা’ খুব সম্ভবত সত্যিকারের মৃত্যুর চেয়েও হাজার বা লাখোগুণে কঠিন কাজ! তাই তো মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে ভেবে কষ্ট পান।
স্টিভ জবসও সেটা করেছিলেন। জীবনে অর্জিত সব সম্পদের বিনিময়ে হলেও তিনি নাকি আরেকটু সময় চেয়েছিলেন। সেটা অসমাপ্ত কোনো প্রজেক্ট শেষ করার জন্য নয়; বরং প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটানোর জন্য! যদিও তিনি সেটা পাননি; মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করতে হয়। এ রকম অসংখ্য ঘটনা প্রমাণ করে, মৃত্যু যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, কত-কিছুই না মানুষকে আলোড়িত করে। আবারও সুযোগ পেলে ‘অর্থপূর্ণ কিছু করার আকাক্সক্ষা’ তাদের প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে!
মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসা এমনই একজনের অভিব্যক্তির সঙ্গে সম্প্রতি পরিচিত হলাম। চার দশক আগে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসহ স্বজনরা মেনেই নিয়েছিলেন যে পৃথিবীতে তার জন্য বরাদ্দকৃত সময় শেষ। কিন্তু অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশের আগে তিনি প্রার্থনা করেছিলেন: যদি বেঁচে ফিরতে পারি তবে বাকি জীবন মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করব। সৃষ্টিকর্তা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন।
সেই ঘটনায় সত্যিকার অর্থেই তিনি পুনরুজ্জীবন লাভ করেছেন। চল্লিশোর্ধ এক নারী, অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর অঞ্চলের এক গ্রামে-ভিক্ষুক ও গৃহিণীদের নিয়ে যে পথচলা শুরু করেছিলেন-তা আজ ঠিক কোথায় পৌঁছেছে তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন-আমি ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ বা টিএমএসএসের স্বপ্নদ্রষ্টা ড. হোসনে আরা বেগমের কথা বলছি।
প্রায় দুই দশক আগে শিক্ষাবিষয়ক এক ম্যাগাজিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। সেখানে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কয়েক জন সাবেক শিক্ষার্থীর ওপর বিশেষ প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল। হোসনে আরা বেগম ছিলেন তাদের অন্যতম। বলাবাহুল্য তার উদ্যোগ বা সংগ্রামের চেয়ে ‘ছেলে থেকে মেয়েতে রূপান্তরিত হওয়া’র ঘটনাকেই সেখানে ফোকাস করা হয়। যে বিষয়ে মানুষের হাত নেই বা নিজ থেকে বেছে নেননি-সে ঘটনায় তাকে বাঁকা চোখে দেখা নিতান্তই অমানবিক। টিএমএসএসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে সেই প্রথম জেনেছিলাম। বিক্ষিপ্তভাবে মাঝেমধ্যে কিছু বিষয়ে শুনলেও এই প্রথম তার বিশাল কর্মযজ্ঞের কিছু অংশ দেখার সুযোগ হলো।
বাংলাদেশে এনজিওগুলোর পথচলা শুরু হয় আমাদের শৈশবে। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে গ্রামের লোকজন বেশ উৎসাহী ছিল। কারণ সরকারের বাইরেও যে দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে কেউ কাজ করতে পারে-তখন পর্যন্ত তা ছিল কল্পনার বাইরে। আবার তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অনেকে নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করায় সমাজে এনজিওগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে মিশ্র ধারণা ছিল। ব্র্যাক, আশা ও গ্রামীণ ব্যাংকের পাশাপাশি টিএমএসএসের নামও শুনতাম। তবে ‘ঠেঙ্গামারা’ শব্দটা বেশ গ্রাম্য লাগত। ফলে অন্য এনজিও থেকে সেটাকে বেশ অনগ্রসর বলেই জানতাম।
টিএমএসএসের হেলথ সেক্টরে গবেষণারত ড. মোহাম্মদ আমিনুর রহমানের কাছে সম্প্রতি রিসার্চ সম্পর্কিত এক কাজে যাই। গাড়ি থেকে নেমে সেই ‘ঠেঙ্গামারা গ্রামে’র মধ্যে রফাতুল্লাহ্ কমিউনিটি হাসপাতালের ১৮ তলা ভবন দেখেই চমকে উঠি। অসংখ্য বিদেশিসহ হাজারো শিক্ষার্থীর পদচারণা সেই বিস্ময়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। সেটা প্রকাশ করলে, তিনি সন্ধ্যায় এর চেয়েও বড় চমক দেখাবেন বলে জানালেন।
পুন্ড্র বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং ইনস্টিটিউট, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দ্রুতই আমার অতীতের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে। তা ছাড়া ‘ট্যুরিজম মার্কেটিং’ বিষয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে সহজেই বুঝতে পারলাম যে-নির্মাণাধীন আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার, কৃত্রিম লেকের ধারে বিলাসবহুল রিসোর্ট ও করতোয়া তীরবর্তী বিনোদন পার্ক শিগগিরই বগুড়াকে আকর্ষণীয় এক পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করবে।
আমি সত্যিই চমকে গেলাম! ম্যাডামের নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘মম ইন’ নামক পাঁচ তারকা হোটেলে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি বগুড়ায় আছি। কারণ ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশের বহুতারকা হোটেলের সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে পরিচয় থাকায়-সহজেই তুলনা করতে পারছিলাম। বিশেষত সামনের ‘ল্যান্ডস্কেপ’ রীতিমতো অবিশ্বাস্য! সবাই যখন ভাবে, বড় উদ্যোগ নিতে হলে রাজধানী বা বড় শহরে যাওয়া অপরিহার্য। তখন তিনি নিজ গ্রামকেই পরিণত করেছেন অত্যাধুনিক শহরে। দেশ-বিদেশের স্টেকহোল্ডাররা অহরহ তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে আসছেন। ঠেঙ্গামারা গ্রামের ‘ফাইভ স্টার’ হোটেলে অবস্থান করছেন। তিনি শহরে যাননি-শহরই তার কাছে এসেছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎসহ উত্তরাঞ্চলে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিরাই এ হোটেলের নিয়মিত কাস্টমার। তা ছাড়া বেশ কয়েকটি বড় কনফারেন্সও ইতোমধ্যে তারা সফলভাবে আয়োজন করেছে। নিজস্ব হেলিকপ্টার সার্ভিস থাকায় বিদেশি (বা দেশীয় বড় মাপের) অতিথিদের ঢাকা বিমানবন্দরে সরাসরি যাতায়াতের ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। তা ছাড়া সম্প্রতি গেস্টদের জন্য ‘ট্যুরিস্ট বাস সার্ভিস’ চালুর মাধ্যমে তারা উত্তরাঞ্চলের পর্যটন বিকাশেও প্রত্যক্ষভাবে ভ‚মিকা রাখতে শুরু করেছে।
এ কাজগুলো করা খুবই দরকার ছিল। কারণ ২০১৭ সালে মহাস্থানগড়কে ‘সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী’ ঘোষণা করা হয়। সার্ক সচিবালয় এ বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে বেশ প্রচারণাও চালায়। ফলে প্রতিবেশী দেশের পর্যটকদের মধ্যে বগুড়া তথা উত্তরাঞ্চল সম্পর্কে আগ্রহ বেড়েছে। সম্ভাব্য ভ্রমণকারীরা বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় মানসম্মত হোটেল-রেস্তোরাঁ ও পরিবহন সুবিধা পেলে তবেই তো আসতে আগ্রহী হবে। ইতোমধ্যে বেশকিছু বিদেশি অতিথি আসছে বলেও তারা জানালো।
টিএমএসএসের উদ্যোগে একটি ‘কালচারাল সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার কাজও এগিয়ে চলেছে। সেখানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর সংস্কৃতি যথাযথভাবে উপস্থাপনের জন্য একটি ‘সাংস্কৃতিক যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। এখন বগুড়ায় একটি বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা হওয়া সময়ের দাবি। সেটা হলে সমগ্র উত্তরাঞ্চলের আর্থসামাজিক কার্যক্রম আরও বেশি গতিশীল হবে। তখন বগুড়া শুধু অভ্যন্তরীণ পর্যটক নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ‘হেরিটেজ ও কালচারবিষয়ক’ এক পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরিত হবে বলে আশা করা যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজ নিজ পেশায় সফলতা পাওয়া বাংলাদেশিদের ড. হোসনে আরা বেগম টিএমএসএস সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের অনন্য মেধা ও শ্রম দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে উদ্বুদ্ধ করছেন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ উদ্যোগটা খুবই কাজ দেয়। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ‘আহমেদাবাদ কলিং’ কর্মসূচির আওতায় ঠিক এ কাজটিই করেছিলেন। প্রবাসী গুজরাটবাসীদের মেধা, শ্রম ও বিনিয়োগ দিয়ে জন্মভূমির উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাদের বড় একটি অংশ সে ডাকে সাড়াও দিয়েছিল। ফলে ‘অন্ধকার রাজ্য’ বলে পরিচিত গুজরাট মাত্র একদশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে লক্ষণীয় উন্নতি করেছে।
জানতে পারলাম-টিএমএসএস মূলত তিনটি সেক্টরে কাজ করে: স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ক্ষুদ্রঋণ। বার্ষিক ৮ হাজার কোটি টাকার ওপরে বাজেট হওয়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে দেশের ২৫ হাজারের অধিক গ্রামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মাইক্রোফিন্যান্স ছাড়াও ৩টি হাসপাতাল, ৬৫টি স্যাটেলাইট ক্লিনিক, ৫৫টি ট্রেনিং ভেন্যু, ২৬টি টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট, ১৮টি লাইব্রেরি ও ১৪টি সিস্টার কনসার্ন ফাংশনাল রয়েছে। তা ছাড়া বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের উভয় পাশে টিএমএসএসের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান নজরে আসে। সামগ্রিক উদ্যোগকে সক্রিয় রাখতে প্রায় ৩২ হাজার কর্মী দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করছে।
টিএমএসএস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ১২ লাখ এবং পরোক্ষভাবে ৫৫ লাখ মানুষকে সেবা দিচ্ছে! পাশাপাশি অত্যাধুনিক পেপার মিলে পরিত্যক্ত কাগজ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সুবিশাল কোল্ডস্টোরেজ স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দিচ্ছে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা। তদুপরি বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে টিএমএসএস’র রয়েছে সমাজকল্যাণমূলক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ। হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে অত্যাধুনিক মসজিদের নির্মাণকাজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
নিরলস এ চেষ্টার পেছনে ড. হোসনে আরা বেগম সবসময় যে বিষয়টাকে ফোকাস করেন সেটা হলো-নারীর ক্ষমতায়ন। তিনি নিজে পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হওয়ায় (খুব সম্ভবত) তার চোখে বৈষম্যের বিষয়গুলো আরও স্পষ্টভাবে ধরা দেয়। আর সেকারণেই নারীদের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করার ব্রত নিয়ে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করছেন। তার সাহস, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ও দূরদর্শিতায় মুগ্ধ হওয়ার মতো। তা ছাড়া সবাই যখন শহরমুখী তখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই স্রোতের বিপরীতে চলা একজন মানুষ।
আজকাল নানা অজুহাতে বিত্তশালীরা যখন দেশের অর্থ পাচার করতে ব্যস্ত। তখনো তিনি ঠেঙ্গামারা গ্রামের বাড়িতে পরম তৃপ্তিতে ঘুমান। শোনা যায় বগুড়া শহরেও নাকি তিনি বসবাসের জন্য কোনো বাসা বা ফ্ল্যাট রাখেননি। উন্নয়ন সবসময় শহর থেকে গ্রামে যায়-এ ধারণাকে তিনি একেবারেই ভুল প্রমাণ করেছেন। বরং গ্রামের উন্নয়নের অংশ শহরে পৌঁছে দেওয়ার অনন্য এক মডেল তিনি উপস্থাপন করেছেন-এখানেই তার স্বাতন্ত্র্য!
আমাদের দেশে শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো-একটি চাকরি জোগাড় করা। এমন পরিস্থিতিতে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন গ্রামে এমন উদ্যোগ নেওয়া খুব দরকার। সৃষ্টিশীল ধারণাকে পুঁজি করে নিজ এলাকায় ‘একটা কিছু’ করার সংকল্প থাকা জরুরি। সবাই মিলে ঢাকা শহরের ওপর চাপ না বাড়িয়ে-নিজ জেলা বা জন্মস্থানে এমন উদ্যোগ নিলে তা দেশের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের সহায়ক হবে। তা ছাড়া সেই অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসবে-যেমনটা ঠেঙ্গামারায় হয়েছে।
উদ্যোগগুলো ঘুরে দেখার সময় কয়েকটি বিষয় আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। যেমন : সামগ্রিক কার্যক্রম খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। অ্যাপল বা কোকা-কোলার মতো বিশ্বব্যাপী সফল কোম্পানিগুলো চাইলেই ব্যবসায়ের আওতা ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটাতে পারত। কিন্তু তারা সেপথে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কিছু প্রতিষ্ঠান সেরকম চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে শেষমেশ মূল ব্যবসায়ে ফিরে আসতে হয়েছে। অনেককে দেউলিয়াও হতে হয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রেক্ষাপটে এখন শুধু ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসায়ে’ থাকা যৌক্তিক নয়। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে ব্যবসায় কার্যক্রমের বিস্তার ঠিকই আছে। তবে সুযোগ থাকলেই ব্যাপকভাবে ব্যবসায়ের বিস্তার ঘটানো অনেক সময় লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লা ভারী করে।
তা ছাড়া রাজধানী থেকে দূরে থাকার বড় চ্যালেঞ্জ হলো-দক্ষ মানবসম্পদের অপ্রতুলতা। সব বৈশিষ্ট্যের লোক নিজেরা তৈরি করা যায় না। ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে মানসম্মত পণ্য ও সেবার সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় না। ইতিপূর্বে অসংখ্য উদ্যোক্তা এক জীবনে ঈর্ষণীয় সফলতা অর্জন করেছেন। কিন্তু তাদের অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিকতা সেভাবে রক্ষা হয়নি। ফলে এমন কাঠামোর ওপর সেগুলো দাঁড় করানো দরকার-একজনের অনুপস্থিতিতে যেন পুরো কার্যক্রমে স্থবিরতা না আনে। দক্ষ ও পেশাদার মানবসম্পদ গড়ে তোলা ও ক্রমান্বয়ে তাদের ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত করে তোলাটা খুব দরকার।
যারা কাজ করে তাদের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তিনি যেহেতু নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সেহেতু কিছু সীমাবদ্ধতা বা সমালোচনার জায়গা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে নিশ্চয়ই অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। নইলে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে ও সফল হতে পারতেন না। তার মত বা দর্শনের সঙ্গে আমাদের মিল নাও হতে পারে। কিন্তু তিনি যে পথ আমাদের দেখালেন তার তুলনা মেলা ভার। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ‘একই সময়ে তিনটি কাজ’ করার মাধ্যমে তার এক জীবনকে তিন জীবনে পরিণত করতে চাইতেন। সে হিসেবে ড. হোসনে আরা ইতোমধ্যে দশ জীবনের সমান কাজ করেছেন বলে অনেকেই মনে করেন।
মাস বা বছর দিয়ে সত্যিই কী জীবনের দৈর্ঘ্য মাপা যায়? কবি সুকান্ত, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কিংবা সুকুমার রায় কী খুব বেশিদিন বেঁচেছিলেন? কিন্তু অনন্য সৃষ্টির মাঝে কী তারা শত শত বছর বেঁচে থাকবেন না? ঠিক তেমনিভাবে রণদা প্রসাদ সাহা, জহুরুল ইসলাম ও স্যামসন এইচ চৌধুরীদের উত্তরসূরি ড. হোসনে আরা বেগমও বেঁচে থাকবেন তার অসংখ্য উদ্যোগ ও কর্মের মাঝে। তবে আমাদের দেশে ইতিপূর্বে কোনো নারী উদ্যোক্তা এতটা বিপুল পরিসরে কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে এভাবে সফলতা পাননি-এ ক্ষেত্রে তিনি অনন্যা!
মো. আব্দুল হামিদ : সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
