ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভেঙে পড়ছে নদীর আন্তঃসম্পর্ক

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:৫৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১২, ২০১৮

আমাদের দেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। এক নদী আরেক নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বৃদ্ধি করে নদীর পানিপ্রবাহ। পানির প্রবাহজনিত কারণে এবং ভূমির গঠনের ওপর নির্ভর করে নদীর শাখা নদীও সৃষ্টি হয়।
নদীগুলোর দিকে মনোযোগ দিলেই বোঝা যাবে, কোনো নদী বিচ্ছিন্ন নয়। এটা বোঝার জন্য নদী বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। নদী প্রকৌশল কিংবা নদী প্রযুক্তির জ্ঞানও আবশ্যক নয় নদীর আন্তঃসম্পর্ক বোঝার জন্য। তবে যারা প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বোঝেন তারা মাটির তলদেশে নদীর সম্পর্কটাও জানেন।

কোনো নদী এককভাবে চলে না। ভূমির গঠন যেহেতু দক্ষিণে ঢালু, তাই আমাদের দেশের নদীগুলোর পানি দক্ষিণের সাগরমুখী। একটি অবাক করার মতো বিষয়, উত্তর জনপদের যে কোনো বাড়ির উঠানে বৃষ্টির পানির যে প্রবাহ ভাটিতে নেমে যায় তা এক সময় কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রাভিমুখী ছিল। আমরা সড়ক তৈরির জন্য অসংখ্য সেতু এবং কালভার্ট নির্মাণ করেছি। এসব নির্মাণের সময় পরিণামের কথা ভাবিনি। আবার অনেকেই এসব সেতু এবং কালভার্টের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আমাদের বাড়ির উঠানে ফোটায় ফোটায় যে বৃষ্টি পড়ে সেই পানির স্রোত অনেক সময় নদী পর্যন্ত যেতে পারে না। যদি পানির প্রবাহ আমরা অবাধ করতে পারি, তাহলে পানির প্রবাহ মাত্রই কোনো না কোনো নদীতেই গিয়ে পড়বে। আর যে কোনো নদীতে পানি যাওয়ার অর্থই হচ্ছে সেই পানি সমুদ্রের পথে গতি লাভ করা।
আমাদের দেশে প্রায় সব নদীই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। বলা যায় পানি আপন আপন পথ সৃষ্টি করে নিয়েছে। আর একেকটি নদী মিলিত হয়েছে আর একটি নদীর সঙ্গে। নদীগুলোর মধ্যে একটি আন্তঃসম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র আমাদের অনেক বড় নদী। বাংলাদেশে এ নদীটি অনেক নদীর পানি ধারণ করে প্রবাহিত হয়। কুড়িগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র দুধকুমার, ফুলকুমার, সঙ্কোশ, গঙ্গাধর নদীর পানি গ্রহণ করেছে। আরও কিছুটা ভাটিতে এ নদীতে মিলিত হয়েছে ধরলা নদীর পানি। খানিকটা দক্ষিণে যাওয়ার পর নদীটি চিলমারী এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কাছে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র এক হয়ে গেছে। আরও ভাটিতে নদীটি ঘাঘট নদের পানি গ্রহণ করেছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা। তিস্তা-ধরলা-ঘাঘটও অনেক নদীর পানি নিয়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় মিলিত হয়েছে। মূলত তিস্তার পানি গ্রহণ করার আগে পর্যন্ত নদীটির নাম ব্রহ্মপুত্র। তিস্তার পানি গ্রহণ করার পরই এ নদীর নাম হয়েছে যমুনা। যমুনাই যখন ভাটিতে রাজবাড়ির কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে তখন তার নাম হয়েছে পদ্মা। আমাদের কাছে প্রচলিত অর্থে পদ্মার উজানে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা পর্যন্ত এর যে অংশ রয়েছে সেটিকেও আমরা পদ্মা হিসেবেই জানি। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর এ নদীর নাম হয় পদ্মা। পদ্মা চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মেঘনা পতিত হয়েছে সমুদ্রে। এভাবেই নদীগুলোর পানি সমুদ্রেই চলে যায়।
ব্রহ্মপুত্র যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তখনি সেটি একটি অনেক বড় নদী। কিন্তু যতই পানি গ্রহণ করেছে নদী আর তত বড় হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। ব্রহ্মপুত্র যে নদীর পানি গ্রহণ করেছে তার মধ্যে বড় বড় নদীও আছে। কালজানি-দুধকুমার, গঙ্গধর, ধরলা, তিস্তা, ঘাঘট, হলহলিয়া, বড় নদী। এর মধ্যে ধরলা বর্ষা মৌসুমে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত হয়। তিস্তা বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১০ কিলোমিটার প্রস্থে রূপ লাভ করে। তাহলে এই দুটি নদীর পানির প্রবাহতা প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এই পানির প্রবাহ যখন ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয় তখন এ নদীর প্রস্থ ২২-২৫ কিলোমিটার হলেও আর বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকে না। এগুলো হচ্ছে নদনদীর আন্তঃসম্পর্ক। যে নদীটি অন্য নদীর সঙ্গে মিলিত হয় সেগুলোকে বলা হয় উপনদী। আর যে নদীগুলো কোনো নদী থেকে বের হয়ে গেছে সেটি হচ্ছে শাখা নদী। কখনো কখনো একটি নদী একই নদীর শাখা নদী এবং উপনদী।
দিনের পর দিন আন্তঃসম্পর্কগুলো আমরা নষ্ট করছি। নদীর আন্তঃসম্পর্ক নষ্ট করার পরিমাণ যতই বাড়তে থাকবে, প্রকৃতি ততই জনগণের অকল্যাণ বয়ে আনবে। আমরা এখন বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টিতে অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা দেখি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে নদীর আন্তঃসম্পর্কই নদীর পানিকে দ্রুত সমুদ্রমুখী করে। শুধু তাই নয়, ভারী বর্ষণে কিছুটা বন্যা হলেও সামান্য সময়ে সেই পানি নেমে যাবে। ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি তখন কম হয়।
আমাদের দেশে যেসব এলাকায় নদীর আন্তঃসম্পর্ক ব্যাহত হয়েছে, সেসব স্থানে আন্তঃসম্পর্ক ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। নদীর আন্তঃসম্পর্ক ফিরিয়ে আনার ব্যয়বহুল হবে। কারণ নদীর যত্ন দীর্ঘদিন না নেওয়ার কারণে অনেক স্থানে অনেক নদী ভরাট হয়ে গেছে। অনেক স্থানে ভরাট হওয়ার নদী অসাধু চক্র ব্যক্তি মালিকানায় কবে নিয়েছে। অসাধু ব্যক্তিকে জমির নকল কাগজ তৈরি করে দেওয়ার মতো সরকারি অনেক ব্যক্তি আছেন। এখন এসব দখলদারদের হাত থেকেও নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। তবেই কেবল নদীর আন্তঃসম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
সারা দেশের সব নদী আন্তঃসম্পর্কের জালে বাঁধা। আমাদের দেশের বড় সৌন্দর্য আমাদের জালের মতো ছড়িয়ে থাকা হাজারো নদী। এ নদীই নির্দিষ্ট করেছে আমাদের ভূমির গঠন। এ দেশের আবহাওয়ার ধরনও নির্ভর করে নদী ও ভূমির গঠনের ওপর। কারণ এ দেশের জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে নদী ও ভূমি সম্পর্কিত। মূলত এর সব অনুষঙ্গই একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত। এ দেশের আবহাওয়া, জীবনবৈচিত্র্য, স্বাভাবিক যাপিত জীবন সবকিছু রক্ষা করতে আমাদের নদীর আন্তঃসম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]

 
Electronic Paper