আসুন, ছুড়ে ফেলি এই শিক্ষা ব্যবস্থা
মঞ্জুরুল আলম পান্না
🕐 ৯:২৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৮
দার্শনিক জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তি বলেছেন, প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার দরজা বন্ধ হলেই কেবল প্রকৃত শিক্ষার আলো ছড়াতে পারে। কিন্তু একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সেই আলোর পথ আমরা বন্ধ করে রেখেছি শিক্ষার বাজারে। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, ‘মনুষত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন’। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-দর্শন সবকিছুরই প্রয়োজন আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে। তবে সবার আগে প্রয়োজন মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া।
একজন ছাত্র সেই নৈতিক শিক্ষার অধিকাংশটুকু গ্রহণ করে তার শিক্ষকের কাছ থেকে। আর এ জন্যই সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে শিক্ষককে বলা হয় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’। তাদের এচঅ-৫ কিংবা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার গড়ার কারিগর বলা হয় না। অথচ এখন তারা যেন কেবল সেই কাজেই ব্যস্ত কিছুসংখ্যক প্রকৃত শিক্ষক বাদে। এর মূল্য কেবল অরিত্রীকেই নয়, খুব নীরবে নিঃশব্দ ঘুণপোকার মতো শেষ করে দিচ্ছে পুরো জাতিকে।
অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় সমাজের বড় একটি অংশ যেমন হতাশ এবং ক্ষুব্ধ অভিযুক্ত শিক্ষকদের প্রতি, একইভাবে শিক্ষকদের একটি অংশসহ কিছু মানুষ প্রকাশ্যে কিছু না বললেও মৌন অবস্থান নিয়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সেই শিক্ষকদের পক্ষেই। তাদের বক্তব্য, ‘নকল করার অপরাধে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষকদের অপরাধ কোথায়?’ শাস্তি অবশ্যই দরকার।
তবে তা সরাসরি ছাড়পত্র দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর কিছু নয়, সন্তানের সামনে অভিভাবকদের অপমান করা নয়। ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নিশ্চয় শাস্তির একাধিক ধাপ সামনে ছিল। আর অরিত্রীর আত্মহত্যার পেছনের কারণ যে শুধু ছাড়পত্র গ্রহণের নির্দেশ কিংবা মোবাইলের মাধ্যমে নকলের জন্য বাবা-মাকে অপমান করার ঘটনা, আমার কাছে ঠিক এমনটা মনে হয় না। স্কুল কর্তৃপক্ষের ঔদ্ধত্য এবং অরিত্রীর আত্মহত্যা দুটির বিশ্লেষণই জরুরি। এর সঙ্গে জড়িত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অসংখ্য অসংগতি, অব্যবস্থাপনা আর দুর্বলতা।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একটা ভয়ঙ্কর বৈষম্যমূলক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিত্তহীন ঘরের সন্তানরা, পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ। পরীক্ষানির্ভর প্রতিযোগিতায় বিত্তবানরা তাদের সন্তানদের নিয়ে রাতদিন দৌড়াচ্ছেন কোচিংয়ের পেছনে, প্রাইভেট শিক্ষকের পেছনে আর ডুবিয়ে রাখছেন মোটা মোটা গাইড বইয়ের মধ্যে। এই সুযোগে লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে জেঁকে বসেছে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা।
লাখ লাখ টাকায় সেই প্রশ্ন কিনে প্রিয় সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন অনেক মা-বাবা। গণমাধ্যম শুরু থেকে ভয়াবহ এ বিষয়গুলো প্রমাণসহ তুলে ধরলেও প্রথম দিকে তা অস্বীকার করে আসছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষাকে পুঁজি করে দেশের কথিত নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক বাণিজ্য করে যাচ্ছে লাগামহীনভাবে। মাথাপিছু লাখ লাখ টাকার ভর্তি বাণিজ্য থেকে শুরু করে কোচিং বাণিজ্য, পরীক্ষার ফিসসহ নানান খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাইয়ে দিতে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সুবিধা আদায়, এমনকি এমন প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এচঅ-৫ না পেলে স্কুলে আর রাখা হবে না বলেও অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রীতিমতো নোটিস জারি করে কোমলমতি শিশুদের মনে ভয়ানক চাপ আর আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। এসবের লাগাম টেনে ধরতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের উদাসীনতা, কারণ বাণিজ্যের অংশীদার আমাদের কর্তাব্যক্তিরাও। শিক্ষার গুণগত মানের চেয়ে পাসের হার এবং হাইব্রিড ফলনের মতো এচঅ-৫ উৎপাদনের দিক থেকে সংখ্যাগত সাফল্যে খুশি থাকার চেষ্টা করেছেন নীতিনির্ধারকরা।
পড়াশোনার মান ভালো দেখাতে পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চোখ বন্ধ করে হাত খুলে উত্তরপত্রে নম্বর দিতে। এ সুযোগে কোনো ধরনের নীতি-নৈতিকতার ধারের কাছে না ঘেঁষে যেমন ইচ্ছে খুশি বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। শিক্ষার্থীদের অস্বাভাবিক মানসিক এবং শারীরিক শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে বেপরোয়া।
শিক্ষার এই বাণিজ্যিকীকরণের জাঁতাকলে চূর্ণ হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষার মহত্ত্ব। অতিমাত্রায় পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা পদ্ধতিতে বেশি বেশি নম্বরই যেখানে শেষ কথা মানবিক মূল্যবোধের আর কী মূল্য সেখানে! একই সঙ্গে অভিভাবক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাপে পিষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিণত করছে এক একটা রোবটে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে তারা আর কিছু ভাববার অবকাশ পায় না।
পরিবার এবং সমাজের কাছে ভালো ফল অর্জনই যেন তার অস্তিত্বের মূল পরিচয়। সেটি নিশ্চিত করতে অবলম্বন করতে হচ্ছে যে কোনো অসদুপায়। এক পর্যায়ে পুরো জীবনটাই হুমকির মুখে।
অনেক সাধনার পর জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকার জাতিকে একটা একমুখী শিক্ষানীতি উপহার দিয়েছিল ঠিকই, তবে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তার কিছুই প্রায় হয়নি।
একটি বৈষম্যহীন গণমুখী-সুলভ-সুষম-সার্বজনীন-সুপরিকল্পিত-বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমগ্র দেশে প্রাথমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয়গুলো এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তন করার কথা বলা ছিল এই শিক্ষানীতিতে।
সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাধারার সবকটিতেই বাংলা-ইংরেজি-তথ্যপ্রযুক্তিসহ কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে অভিন্ন পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক করা, গাইড বই, নোট বই, প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং নিষিদ্ধ করা, শিক্ষকদের মর্যাদা অধিকার এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নিশ্চিত করতে সব শিক্ষকের জন্য পৃথক বেতন-কাঠামো প্রণয়ন, দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রশাসনকে জবাবদিহি গতিশীল ও কার্যকর করতে সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রবর্তন এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আচরণবিধি প্রণয়ন, শিক্ষার কোনো স্তরেই শিক্ষার্থী যাতে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি না হয় তার বিশেষ নির্দেশনাসহ আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ও প্রস্তাবনা ছিল এই শিক্ষানীতিতে।
অথচ আমরা চরম হতাশায় দেখলাম, জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হওয়ার পরও গত প্রায় এক দশকে একই সরকার ক্ষমতায় রইলেও শিক্ষার নগ্ন বাণিজ্যওয়ালাদের নানাবিধ তৎপরতা আর ষড়যন্ত্রে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যম্ভাবী ‘শিক্ষা আইন বিল’ উত্থাপন করা গেল না জাতীয় সংসদে।
শুরুতে জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকার কথা বলছিলাম। সারা বিশ্বের গবেষক এবং শিক্ষাবিদরা সেই সুদূর অতীত থেকে বলে আসছেন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে একজন ছাত্রকে যতটা সুন্দর করে গড়ে তোলা যায় তার বিপরীতে আর কোনো কিছুতে তেমনটা সম্ভব হয় না।
সৃজনশীল মানসিকতায় আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষাদানকে একজন শিক্ষকের জন্য সেরা শিল্পকর্মের সঙ্গে তুলনা করেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন।
এমন আদর্শবান শিক্ষক যে এখন আর নেই তা কিন্তু নয়। খুলনার উপকণ্ঠে মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। স্কুলটি ‘গরিব স্কুল’ নামে পরিচিত। কারণ এখানকার প্রায় সব শিশুই নিম্নবিত্ত পরিবারের।
সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রীর জন্য শিক্ষক মাত্র পাঁচজন, যেখানে শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকার কথা। স্কুলটিতে নেই কোনো শৌচাগার, নেই খেলার মাঠ। শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে গাদাগাদি করে বসতে হয় বাচ্চাদের। তবু সেই স্কুলের শিক্ষকদের অপার মমতা আর প্রগাঢ় ভালোবাসায় আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করছে প্রতিটি শিশু।
কয়েক বছর ধরে পিইসি পরীক্ষায় পাসের হার শতভাগ। কয়েক বছর আগে জেলার সেরা স্কুলের মর্যাদাও লাভ করে গরিব স্কুলটি। এমন দৈন্যের মাঝেও এমন একটি স্কুলে মাত্র পাঁচজন শিক্ষক যদি হাজার হাজার শিশুকে আলোকিত করতে পারেন, আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারেন, ভিকারুননিসার মতো বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কেন অরিত্রীদের তাদের ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে এনে বাঁচাতে পারেন না? না পারার কারণ হলো অধিকাংশ শিক্ষকই এখন তাদের নীতি-আদর্শ-কর্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে ব্যক্তিগত লাভের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। তবে শুরুতেই বলেছি, আমাদের দানবীয় এই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এককভাবে শুধু শিক্ষকরাই দায়ী নন। একের পর এক রাষ্ট্রীয় ভুলনীতি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য রেখে আর মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকা হাজারো অব্যবস্থাপনা জিইয়ে রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবল বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করলেই শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন হয় না।
রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই দানবীয় শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তাই উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এই সৌরমণ্ডলের
এই পৃথিবীর এক কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে
যে শিশুর জন্ম।
দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন
যে কিশোরের।
জ্যোৎস্না যাকে প্লাবিত করে।
বনভূমি যাকে দুর্বিনীত করে।
নদীর জোয়ার যাকে ডাকে নেশার ডাকের মতো।
অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক জোয়াল
গোলাম বানানোর শিক্ষাযন্ত্র।
অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে
এক হৃদয়হীন ধর্মের আচার।
অথচ যাকে শৃঙ্খলিত করা হয়েছে স্বপ্নহীন সংস্কারে’।
মঞ্জুরুল আলম পান্না : সাংবাদিক
[email protected]