মাঠে-ঘাটে-বাটে
হামিদ ও সময়ের কথকতা
ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:৫৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৮
সম্প্রতি আমার ছেলের পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার জন্য তাকে নিয়ে রংপুর শহরের সমাজকল্যাণ বিদ্যাবিথী স্কুলে গিয়েছিলাম। তার পরীক্ষা চলাকালীন বেড়িয়েছিলাম শ্যামাসুন্দরী নদীটি সরেজমিন দেখতে। সেখানে বৃদ্ধ আব্দুল হামিদের সঙ্গে দেখা হয়। তার বয়স ৮২ বছর। জন্মেছেন ব্রিটিশভারতে। ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন, আর বাংলাদেশ তিনটিই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।
শৈশব শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। ১৯৪৬ সালে যখন দাঙ্গা হয়, তখন তার বয়স ১২ বছর। দাঙ্গা শুরু হওয়ার চার-পাঁচ দিন আগে তার বাবা মারা যান। দাঙ্গার সময় তার চাচাকে হিন্দুরা মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কোনো রকম জীবন নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন।
মৃত্যুর ভয়ে সবাই আলিপুরদুয়ার ছেড়ে বর্তমান নীলফামারী জেলার জলঢাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপরের বছরই দেশবিভাগ হয়। দেশবিভাগ হলেও তারা ফিরে গিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ারে। কিন্তু তাদের বিশাল ধন-সম্পত্তি আর ফেরত পাননি। দখল হয়ে গেছে। কেউ কেউ আশ্বস্ত করেছিলেন সম্পদের কিছু মূল্য পরিশোধ করবেন। কিন্তু কিছুই পাননি।
পরবর্তী সময়ে তারা বাংলাদেশে এসে পঞ্চগড়ের বোদায় বসতি গড়ে তোলেন। বিশাল সম্পদশালী আব্দুল হামিদের পরিবার চরম অর্থকষ্টে ভুগতে থাকেন। পঞ্চগড়ে তাদের এক জোড়া গরু ছিল। যা দিয়ে অন্যের জমিতে ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। গরু দুটি অসুখে মারা গেলে হালচাষ করারও গরু ছিল না। তখন মঙ্গার প্রকোপ ছিল।
আব্দুল হামিদ জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার প্রয়োজনে সপরিবারে রংপুরে চলে আসেন কাজের সন্ধানে। রংপুরে এসে রিকশা চালাতেন অনেক দিন। পরবর্তী সময়ে একটি টিনের দোকানে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। কয়েক বছর থেকে তিনি অসুস্থ।
১৯৪৬ সালে আমরা যে ভয়াবহ দাঙ্গার কথা ইতিহাস পাঠ থেকে জেনেছি, তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই দাঙ্গার ভয়াবহতার দৃশ্য এখনো তার চোখে ভাসে। তিনি বলছিলেন আসাম থেকে দলে দলে সশস্ত্র হিন্দু ‘জয় হিন্দু’ এবং ‘বন্দেমাতরম’ বলে মুসলমানদের হত্যা করতেন। তিনি বলছিলেন ওই সময়ে আলিপুরদুয়ারে অনেক কুয়া ছিল। কুয়াগুলো হাজার হাজার মুসলমানের মৃতদেহে ভরে উঠেছিল।
দাঙ্গা না হলে তাদের বাংলাদেশে আসার প্রয়োজন হতো না। তাদের যে সম্পদ প্রতিপত্তি ছিল তা খোয়া যেত না। তার জীবনে দারিদ্র্য যেভাবে জেঁকে বসেছে তাও হতো না। দাঙ্গাই তাদের জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছে। দাঙ্গার পরপরই দেশবিভাগ হওয়ার কারণে প্রচুর মুসলমান বাংলাদেশে এসেছিল আবার প্রচুর হিন্দু ভারতে গিয়েছিল। দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে দেশবিভাগ হলেও দাঙ্গার ঘটনা না ঘটলে এত মানুষের দেশ ছাড়ার ঘটনা ঘটত না।
আব্দুল হামিদ আমাদের কাছে জীবন্ত ইতিহাস। যে পাঠ আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে সংগ্রহ করি সেই ইতিহাস তার কথাতেই রূপায়িত হয়। দেশবিভাগের বিষয় নিয়ে অসংখ্য গল্প উপন্যাস, নাটক, কবিতা রচিত হয়েছে। সেসব কাহিনীরই যেন এক উজ্জ্বল চরিত্র আব্দুল হামিদ। একটি সচ্ছল পরিবার কীভাবে মুহূর্তে সহায়-সম্পদহীনে পরিণত হন। ৮২ বছরের এক দীর্ঘ জীবন তিনি টেনে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছেন।
কিন্তু আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। ঘোলা চোখে এখন তিনি সবকিছু দেখতে পান। কিন্তু তার অভিজ্ঞতার চোখে কোনো ঘোলাটে ভাব নেই। আমাদের সমাজে এ রকম কত আব্দুল হামিদ আছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। রংপুরের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্কৃতি কর্মী মফিজুল ইসলাম মান্টু।
তিনি জানালেন-তাদের অনেক আত্মীয়স্বজন এখনো ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আছেন। কোনো কোনো আত্মীয় বাংলাদেশে এসেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অর্থনৈতিকভাবে আর দাঁড়াতে পারেননি।
গত বছর ভারতে গিয়েছিলাম। কলকাতার ঐতিহাসিক কফি হাউসে বসে নাস্তা করছিলাম। সেখানে কয়েকজন বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ হয়। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশ থেকে দেশবিভাগের সময় ভারতে গেছেন। তিনি তার যাওয়ার সময়ের এবং বর্তমান অবস্থার কথা বলছিলেন।
তিনি বলছিলেন, যখন বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েছিলেন, তখন একেকটি ঘরে ১৫-২০ জন করে মানুষকে ঘুমাতে হয়েছিল। সেই সীমাহীন কষ্ট এখন আর নেই। তিনি আক্ষেপ করে বর্তমান অবস্থার কথা বলছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে যারাই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, তারাই তাদের পাশে থেকেছেন।
তারা প্রত্যেকে বলেছেন বাংলাদেশ থেকে যারা এসেছেন তারা সংখ্যালঘু, তাদের পাশে আমরা আছি। তারা কখনোই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নাগরিকদের সর্বভারতীয় বলেননি। জন্মভূমি ছেড়ে একেবারেই চলে যাওয়া কখনোই সুখকর হতে পারে না এটা তার কথাতেও ফুটে উঠেছে।
রংপুর শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরী নদীর পাশেই আব্দুল হামিদের বাড়ি। তিনি বলেন ৪০ বছর আগে এ নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ। প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এ নদী তখন অনেক প্রশস্ত ছিল। শ্যামাসুন্দরীতে এক সময় স্নান করা হতো। এ নদীতে নৌকা চলত। বারো মাস এ নদীতে পানি থাকত। তিনি জানালেন গত কয়েক বছরে নদীটির অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। শ্যামাসুন্দরীতে এখন প্রচুর ময়লা ফেলা হয়। তিনি কালেক্টরেট স্কুলের পাশে ময়লার স্তূপ দেখাচ্ছিলেন। ওই স্কুলের সব ময়লা সেখানে ফেলা হচ্ছে। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকে এ শহরের মানুষের বসতি অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। আব্দুল হামিদের ভাষ্যমতে জনবসতি বৃদ্ধির কারণে শ্যামাসুন্দরীতে ময়লা-আবর্জনা বেশি করে ফেলা হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল। তার মধ্যে দুই বছর ধরে এ নদীর অবস্থা আরও শোচনীয়। প্রতিবছর পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানি সব ময়লা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ার কারণে ময়লা আর সরে যায়নি। আগামী বছর বৃষ্টিতেও আর ময়লা সরবে কিনা সেই আশঙ্কা আছে। যদি আগামী বছর বৃষ্টির পানি এ ময়লা সরাতে না পারে তাহলে শহরে সীমাহীন জলাবদ্ধতা এবং বন্যা দেখা দেবে। আব্দুল হামিদ তার অভিজ্ঞতা দিয়ে যেটুকু বুঝেছেন, সিটি করপোরেশন কিংবা সরকার দক্ষ-অভিজ্ঞ জনবল দ্বারাও তা বোঝেন কিনা সন্দেহ। বুঝে থাকলে শহরের অবস্থা এ রকম হওয়ার কথা নয়।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি সমাজের মানুষ দেখছেন। মানুষ সম্পর্কে তার নিজস্ব মত হচ্ছে- আগে অভাব ছিল এখন দেশে অভাব কমেছে। কিন্তু মানুষ এখন আর মানুষকে সম্মান করে না। ছোটরা বড়কে মানে না, বড়রাও ছোটদের ভালোবাসেন না। কেন এমন অবস্থা হলো এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বড়দের দায়ী করেছেন। বড়রাই ছোটদের শেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তার কাছ থেকে বিদায়ের আগে জিজ্ঞাসা করি ৮২ বছর বয়সে এসে জীবনটা কেমন মনে হয়? তিনি এক কথায় বললেন-‘দেখতে দেখতেই জীবনটার বয়স বাড়ি গেল বাবা। সেদিনের কথা হামরা বাংলাদেশে আসছি। তাতে কত বছর হয়া গেলো। দুনিয়া থাকি যাওয়ার সময় আসি গেলো।’
আব্দুল হামিদ কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি নন। প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তা ব্যক্তিও ছিলেন না। কর্মজীবন তার অত্যন্ত ম্রিয়মাণ। শৈশবে শুধু নিজেই নিজেদের সচ্ছল দেখেছেন। বাকি সারাটা জীবন কেটেছে অভাব আর অনটনে। তবুও নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করা ঘটনার সাধারণ বর্ণনাই যেন নিটোল ইতিহাস। লোকায়ত জীবনে লুকিয়ে থাকে প্রকৃত জ্ঞান। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের নিচেই যেন জমে থাকে অভিজ্ঞতার দীর্ঘ বয়ান। যে কোনো বয়সী মানুষের কাছে তাদের প্রত্যক্ষ করা জীবন ইতিহাসে সমৃদ্ধ থাকে। আব্দুল হামিদও সে রকম একজন সাধারণ মানুষ মাত্র। কিন্তু তিনি সব সাধারণ মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এমনই ইতিহাস।
ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]