ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘আমি বাকস্বাধীনতায় বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে’

অরুন্ধতী রায়
🕐 ৯:৫৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৮

ফ্রি স্পিচ ডিবেটে আন্তর্জাতিক পুরস্কারবিজয়ী ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকারের কিছু অংশের ভাষান্তর করেছেন জ্যোতির্ময় নন্দী

মানব ভূষণ : আপনি কি মনে করেন জাতীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা নৈতিকতার খাতিরে বাক্স্বাধীনতার ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত?
অরুন্ধতী রায় : না। আমি যে কোনো বিধিনিষেধের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। একবার বিধিনিষেধ আরোপিত হলে, তখন প্রয়োজন দেখা দেয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের এবং এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সব সময়ই রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই যায়। তাই আমি সব বিধিনিষেধের সম্পূর্ণ বিরোধী।

ভারতের এবং আগেকার ইউরোপের উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে, ফ্যাসিবাদের সূত্রপাত হয় সেসব বক্তব্য থেকে, যেগুলো সমাজে বিদ্বেষের জন্ম দেয় এবং হীন প্রবণতাগুলোকে উস্কানি দেয়। আপনি কি মনে করেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করা উচিত?
বক্তব্য থেকে ফ্যাসিজমের সূত্রপাত হয়, এ কথাটা ঠিক বলে আমি মনে করি না। আরও অনেক বিষয় আছে, যেগুলো থেকে বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিজমের সূত্রপাত হয়েছে। কথা হলো প্রকাশভঙ্গির একটা রূপমাত্র। আমি মনে করি না যে, বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ করলে ফ্যাসিবাদ দেখা দেবে না। মানুষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া উৎপাদনশীলতার বিরুদ্ধে যাবে। আমি অবশ্যই মনে করি যে, ভারতে শুধু বিদ্বেষমূলক কথাবার্তার মধ্যেই সমস্যার মূল নিহিত নয়। যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটছে, তখনই রাষ্ট্র সানন্দে দাঙ্গা ও খুনবিরোধী অবস্থান নিলে সেটা আর ঘটতো না- এই সত্যটার মধ্যেই সমস্যার মূল নিহিত।
বক্তব্য কোনো সমস্যা নয়, এটা একটা কর্ম। যদি আপনি এমন একটা সমাজে বাস করেন, যেখানে হত্যা, গণহত্যা, মানুষকে পুড়িয়ে মারা আর ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন আছে, অথচ আপনি সেগুলো কার্যকরের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেন না, আর অন্যদিকে আপনি একটা আইনের মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তা হলে সেটা শুধু আইনের অপব্যবহারই হবে। আমার মনে হয়, আজকে আপনি যদি ভারতের দিকে তাকান তো দেখতে পাবেন যে, যারা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য আদৌ রাখেননি, তাদের বিরুদ্ধেই বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখার অভিযোগ আনা হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আমি যদি বলি যে কাশ্মিরে ৭০ হাজার সৈন্য নামানোটা গ্রহণযোগ্য নয়, তা হলে কেউ-একজন বলে বসতে পারে আমি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রেখেছি। তাই আমি মনে করি না, বড় বড় রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সংঘটনগুলো কথার মাধ্যমে মানুষের কিছু প্রকাশ করা থেকে আসে। এটা আসে একটা দেশে বা সমাজে মানুষদের পরস্পরের সঙ্গে আপনারা কী কী করতে দিচ্ছেন তার ওপর।

কাশ্মির সম্পর্কে আপনার বিভিন্ন বিবৃতি এবং সে-ব্যাপারে বিজেপির (ভারতীয় জনতা পার্টি) মতো দলগুলোর প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আপনি কি মনে করেন যে ভারত আরও বাকস্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, নাকি তার উল্টোটা?
কাশ্মিরের ব্যাপারে আমি যা বলেছি, তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শুধু একা বিজেপির কাছ থেকে আসেনি। কংগ্রেসের কাছ থেকেও এসেছে। এটা সঙ্গে সঙ্গেই একটা জাতীয় এজেন্ডায় পরিণত করে প্রতিটি দল একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটি নৈতিকতাহীন, নীতিজ্ঞান-বিবর্জিত জাতির নেতা হিসেবে নিজেদের সাহস প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
কিন্তু যখন আমাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারটা আসে, তখন হাতে তারা সবার আগে নৈতিকতা বা নীতিজ্ঞানের তাসটাই টেনে নেয়। তবে হ্যাঁ, আসলে আমি মনে করি যে ভারতে কিছু নতুন জিনিস ঘটছে।
তার মধ্যে একটা হলো, প্রচুর পরিমাণে কোলাহল হচ্ছে। এর কারণ সম্ভবত বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় এখানে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা অনেক বেশি। ক্রমশ আরও বেশি বেশি করে সবকিছু চলে যাচ্ছে বড় বড় করপোরেশনের হাতে, যেগুলোর মধ্যে বড় বড় সব স্বার্থের সংঘাত আছে, যেহেতু ওগুলো সবই একই চরিত্রের করপোরেশন, যারা সম্পদের বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে টেলিকম্যুনিকেশন প্রভৃতি খাত থেকে প্রচুর টাকা কামাচ্ছে। এখন তারা পুরোপুরিভাবে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, হয় সরাসরি অথবা বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে। তাই এটা হচ্ছে চলমান নিয়ন্ত্রণের একটা রূপ।
নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় রূপটা হলো খোদ রাষ্ট্রের সেসব মানুষের পেছনে লাগা, যারা এমন কিছু বলে ফেলেছে যেটা বলুক রাষ্ট্র চায়নি। এবং তৃতীয় রূপটা হলো বাকনিয়ন্ত্রণ বা কণ্ঠরোধের ভারটা খুব বেশি পরিমাণে অন্যদের হাতে দিয়ে দেওয়া। যেমন- রাজনৈতিক দলগুলো এ ভার তাদের পোষা গুন্ডা বা ক্যাডার বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেয়, যারা দরকার হলে মুখ খোলা মানুষকে তার বাড়িতে বা পথেঘাটে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং এমন একটা আতঙ্কজনক পরিবেশের সৃষ্টি করে, যেখানে কিছু বলার আগে অন্তত দুবার ভাবতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার আগে দু-তিনবার ভাবাটা অবশ্যই জরুরি, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কথাটা বলার আগে বলাটা নিরাপদ হবে কিনা সেটাও দু-তিনবার ভেবে নেওয়া জরুরি।
এভাবে কণ্ঠরোধের ভার অন্যকে দিয়ে সরকার সুযোগ পায় চলমান অবস্থাকে গণতান্ত্রিক এবং বাকস্বাধীনতার সহায়ক বলে ভান করার। কিন্তু আসলে এসব উপায়ে করপোরেট, ক্যাডার এবং এমনকি আদালতও কীভাবে বাকনিয়ন্ত্রণ করছে, তার স্বরূপ প্রকাশিত হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি বিচার বিভাগেরও ব্যাপক অপব্যবহার করছে। যেমন- কথা বলার দায়ে আমার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে যাতে আপনি এসব লোকের তাড়া খেয়ে ভয় পেয়ে ও ক্লান্ত হয়ে শেষপর্যন্ত চুপ করে যান।
তাই এটা ঠিক একনায়কতন্ত্রের মতো নয়, যেখানে কী ঘটছে সেটা সবাই জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না। এখানে এটা আরও অনেক সুনিপুণভাবে করা হয় এবং তারা এখন ইন্টারনেটকেও নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করছে।
 
অরুন্ধতী রায় : প্রখ্যাত লেখক ও মানবাধিকারকর্মী

 
Electronic Paper