ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রমজানের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
🕐 ৭:০২ অপরাহ্ণ, মে ২০, ২০১৮

‘রমজান মাস। এ মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে। এ কোরআন মানুষের জন্য হেদায়েতের উপকরণ আর সৎ পথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য মিথ্যার ফয়সালা দানকারী।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।

পবিত্র রমজান মাসের অতুলনীয় ফজিলতের জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, মহান রাব্বুল আলামীন এ মাসটিকে স্বীয় ওহি প্রেরণ এবং আসমানি কিতাবসমূহ নাজিল করার মাস হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। কোরআন মাজিদও (প্রথম) এ মাসেই নাজিল হয়েছে। মুসনদে আহমদ গ্রন্থে হজরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা থেকে বর্ণিত; রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, হজরত ইব্রাহিমের (আ.) সহিফা রমজান মাসের ১ তারিখ নাজিল হয়েছিল। আর রমজানের ৬ তারিখে তওরাত, ১৩ তারিখে ইঞ্জিল, ২৪ তারিখে কোরআন নাজিল হয়েছে। হজরত জাবের (রা.)-এর রেওয়ায়েতে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘যাবুর’ রমজানের ১২ তারিখে এবং ইঞ্জিল ১৮ তারিখে নাজিল হয়েছে। (ইবনে কাসির)। উল্লিখিত হাদিসে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের অবতরণ সম্পর্কিত যেসব তারিখের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব তারিখে ওই কিতাবসমূহ সম্পূর্ণটা নাজিল হয়েছিল। কিন্তু কোরআনের বৈশিষ্ট্য হলো, তা রমজানের কোনো এক রাতে সম্পূর্ণভাবে লাওহে মাহফুজ থেকে পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ করে দেওয়া হলেও রাসুল (সা.)-এর ওপর ধীরে ধীরে তেইশ বছরে তা অবতীর্ণ হয়। (মাআরেফুল কোরআন)।
আধ্যাত্মিক জগতের অবর্ণনীয় গুণ, বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে আগমন করে পবিত্র রমজান। কিন্তু অন্যান্য আধ্যাত্মিক বিষয়ের মতো রমজানের দর্শন, তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনাও মানুষের সাধ্যাতীত। যুক্তি ও বুদ্ধির সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে। রমজানে ঈমানের যে জোয়ার, রহমতের যে বসন্ত ও আধ্যাত্মিক সওগাতের যে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয় তা বুঝতে হলে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনাই একমাত্র পথের দিশা দিতে পারে।
পবিত্র রমজানকে তিনটি ভাগে চিহ্নিত করে তার বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার শ্রেণি বিন্যাস করা হয়েছে। প্রথম ভাগ রহমত, মধ্যের ১০ দিন মাগফেরাত ও শেষের ১০ দিন দোজখ হতে মুক্তি লাভের সময়কাল। এসব পরিভাষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও দর্শন আমাদের বোধশক্তির ঊর্ধ্বে। রমজানে অফুরন্ত রহমতের বারিধারা সম্পর্কে আমরা এটুকুন চিন্তা করতে পারি, মাহে রমজান যখন আসে মসজিদসমূহ আবাদ হয়ে যায়। যাদের জীবনে ইবাদত-বন্দেগিতে অবহেলা ছিল তারাও রোজা, নামাজ ও জাকাত দানে তৎপর হয়।
রমজানে কর্ম ও উপোস-ক্লান্ত শরীর নিয়ে এক দুই রাকাত নয় দীর্ঘ ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ আদায় করেন। তাও মসজিদে গিয়ে ইমামের পেছনে, দীর্ঘ কেরাতে কোরআন খতমের মাধ্যমে। এত অভাবনীয় শক্তি ও মনোবল ঈমানদার পায় কোথায়? উপোসের পর দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে নামাজ শেষে যখন বিছানায় শুয়ে পড়ে তখন শেষ রাতে আবার জেগে ওঠে কোন আধ্যাত্মিক আহ্বান পেয়ে? নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আল্লাহর রহমত আমরা চোখে দেখি না সত্য; কিন্তু রমজানে রোজাদারের মনে ও সমাজে ঈমান ও ইবাদতের যে জাগরণ আসে তা আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের নিদর্শন।
প্রাকৃতিক বসন্তের সম্পর্ক যেমন সৌরবর্ষের সঙ্গে তেমনি আধ্যাত্মিক জগতের বসন্তের সম্পর্ক চান্দ্রবর্ষের সঙ্গে। বসন্তে যেমন গাছে গাছে নতুন পত্র-পল্লবের সমারোহ জাগে, বিশ্ব প্রকৃতি মুখরিত হয় নতুন জীবনের জয়গানে ঠিক তেমনি আধ্যাত্মিক জগতেও যখন রমজান নামক বসন্ত আসে তখন থেমে যায় মন্দের স্রোত ও প্রবাহ। আকাশ বেয়ে নেমে আসে রহমতের বরিষণ। বেহেশতের দরজাগুলো খুলে যায়, তার সুবাতাস ছোঁয়া দিয়ে যায় রোজাদারের অন্তরে, মসজিদে, ঈদগাহে সর্বত্র। হাদিস শরিফে এ আধ্যাত্মিক বসন্তের কিঞ্চিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে মানুষের বোধগম্য ভাষায়। এরশাদ হয়েছে- আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে, আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। অপর বর্ণনায় রয়েছে, বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। অপর বর্ণনায় আছে, রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।’ (বুখারী, মুসলিম)।
প্রশ্ন জাগতে পারে, শয়তানকে শৃঙ্খলিত রাখার পরও পাপ-অপরাধ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয় না কেন? হাদিস বিশারদরা এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, পাপ শয়তান করে না, করে মানুষ। শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়। কাজেই শয়তান বন্দি হলেও মানুষের কর্মক্ষমতা তো রহিত হয় না। তবে মাত্রা কমে যায়, এমনকি অনেক পাপী-অপরাধী রমজানে এসে তাদের জীবন শুধরে নেয়, পাপের পথ ত্যাগ করে। এরা মূলত ভালো লোক, শয়তানের ফাঁদে পড়ে সাময়িক বিভ্রান্ত হয়েছিল। হজরত সাহল বিন সাআদ বলেন, রাসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বেহেশতে আটটি দরজা আছে। তন্মধ্যে একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। রোজাদার ব্যতীত ওই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারী, মুসলিম)। মানে রোজাদার বেহেশতে জাগতিক পরিভাষায় ভিআইপি পারসন। তাদের জন্য সারা বছর ধরে সাজানো হয় বেহেশতকে। তাদের জন্যই আনত-নয়না হুরিরা অপেক্ষমাণ।
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, মানব সন্তানের নেক আমল (এর সওয়াব) বৃদ্ধি করা হয় প্রত্যেক নেক আমল দশগুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ বলেন, তবে রোজা ব্যতীত। কেননা রোজা আমার জন্যই; আমিই এর (যত ইচ্ছা তত) প্রতিদান দেব; সে আমার জন্যই তার শাহওয়াত (কাম-লালসা) ও খানাপিনার জিনিস ত্যাগ করে। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে, একটি তার ইফতারের সময় অপরটি (বেহেশতে) আপন পরওয়ারদেগারের সাক্ষাৎ লাভের সময়। নিশ্চয়ই রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকের খুশবু অপেক্ষাও অধিক সুগন্ধময়। রোজা হচ্ছে মানুষের জন্য ঢালস্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারও রোজার দিন আসে সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। আর (নিজকে এমনভাবে সংযত রাখে যে) কেউ যদি তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায় সে যেন বলে, আমি রোজাদার। (বুখারী, মুসলিম)।
কিমিয়ায়ে সাআদতের রোজা অধ্যায়ে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (র.) বলেন, রোজা হচ্ছে মুসলমানিত্বের রোকনগুলোর মধ্যে অন্যতম রোকন। রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহর বাণী-‘প্রত্যেক সৎ কাজের দশগুণ প্রতিদান দেওয়া হবে। কিন্তু রোজার প্রতিদান আলাদা। কেননা, রোজা খাস আমার জন্যই এবং আমিই তার প্রতিদান দেব।’ ‘যারা শাহওয়াত (কাম-লালসা) হতে ধৈর্য ধারণ করবে (বিরত থাকবে) তাদের পারিশ্রমিক কোনো হিসাবের আওতায় আসবে না; বরং তা সীমার বাইরে। (সূরা যুমার ঃ ১০)।
রোজার দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। যে কারণে রোজা খাস আল্লাহর বলে সাব্যস্ত হওয়ার যোগ্য হয়েছে। একটি হলো, রোজার আসল কাজ হচ্ছে পানাহার না করা। আর এটি গোপন কাজ, যা মানব চক্ষুর আড়ালে হয়। ফলে তাতে রিয়ার (লোক দেখানোর) কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয়টি হলো, আল্লাহ তাআলার দুশমন হচ্ছে ইবলিস। তার সেনাদল শাহওয়াত (কাম-লালসা)। রোজা তার সেনাদলকে পর্যুদস্ত করে। কেননা, রোজার মূল বিষয় হচ্ছে, শাহওয়াত বর্জন করা। এ জন্য রাসুল (সা.) বলেছেন যে, ‘শয়তান মানুষের অভ্যন্তরে শরীরের রক্ত প্রবাহের মতোই চলাচল করে। কাজেই ক্ষুধার মাধ্যমে তার চলাচল পথ সংকীর্ণ করে দাও।’ ঈমানদারের রোজার পরিচয় হচ্ছে, তারা নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অনুচিত বিষয় থেকে বিরত রাখবে। শুধু পেট ও লজ্জাস্থানের বিষয় নিয়েই ক্ষান্ত হবে না। ছয়টি জিনিসের মাধ্যমে এ স্তরের রোজা সম্পূর্ণ হয়।
প্রথম : যা কিছু রোজাদারকে আল্লাহর স্মরণ থেকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখবে তা দেখা থেকে নিজের চোখকে বিরত রাখবে।
দ্বিতীয় : অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা হতে মুখকে হেফাজতে রাখা। হয়তো নীরব থাকবে অথবা কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকবে। তর্ক-বাহাস ও জেদাজেদি অনিষ্টকারী অনর্থক কথাবার্তা হিসেবে গণ্য। আর গীবত ও মিথ্যাচার কোনো আলেমের মতে সাধারণ লোকের রোজাও নষ্ট করে দেয়।
তৃতীয় : নিজের কানের হেফাজত করা। কেননা, যা বলা উচিত নয়, তা শোনাও উচিত নয়। মিথ্যা, গীবত প্রভৃতি যে শোনে সেও, যে বলে তার সঙ্গে গোনাহে অংশীদার।
চতুর্থ : নিজের হাত-পা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যায় অনুচিত কাজ হতে বিরত রাখা। যে কেউ রোজা রাখার পর এসব কাজ করবে তার উদাহরণ হবে সেই রোগীর ন্যায়, যে রোজার দ্বারা পানাহার হতে বিরত থাকে (রোগের কারণে সাধারণ আহার করে না); অথচ বিষপান করে। কেননা, গোনাহ হচ্ছে বিষ।
পঞ্চম : ইফতারের সময় হারাম ও সন্দেহজনক বস্তু আহার করবে না। সম্পূর্ণ হালাল জিনিসও বেশি পরিমাণে আহার করবে না। কারণ, যে ব্যক্তি দিনের বেলা যা কিছু বাদ পড়েছে, রাতে তা পুষিয়ে নেয় তাতে কি তার মকসুদ হাসিল হবে? কেননা, রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে শাহওয়াত (কাম-লালসা) দুর্বল করা।
ষষ্ঠত : ইফতারের পর তার অন্তর ভয় ও আশার মধ্যে দুদোল্যমান থাকবে। কারণ, সে জানে না তার রোজা কি কবুল হয়েছে, না হয়নি।
মোদ্দাকথা, যে ব্যক্তি রোজাকে শুধু পানাহার ত্যাগ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে তার রোজা বাহ্যিক ও প্রাণহীন। আর রোজার হাকিকত হচ্ছে, তুমি নিজেকে ফেরেশতাদের মতো করবে। তাদের তো মোটেও শাহওয়াত (কাম-লালসা) নেই।
    
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী : প্রাক্তন শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

 
Electronic Paper