ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রমজানের সৌন্দর্য তারাবিহ

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
🕐 ৮:১৪ অপরাহ্ণ, মে ১৯, ২০১৮

মাহে রমজানের একটি বিশেষ আকর্ষণ তারাবিহ নামাজ। বলা যায়, এটি এ মাসের আধ্যাত্মিক অলংকার ও সৌন্দর্য। রমজানের চাঁদ দেখা যাওয়ার পরই শুরু হয় এ নামাজ। মুসল্লিদের ঢল নামে মসজিদে মসজিদে। যারা অবহেলায় এতদিন ঠিকমতো নামাজ আদায় করেননি, তারাও সারিবদ্ধ হন নামাজের কাতারে।

এশার পর শুরু হয় তারাবিহ। দু’রাকাত করে দীর্ঘ ২০ রাকাত। দু’রাকাতে এক নিয়ত এবং চার রাকাত পর একটু বিশ্রাম ও বিরতি। এই ফাঁকে ইমাম সাহেব ও মুসল্লিরা তারাবিহ্র বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে আর্তি জানান তার মহিমা-গুণগান প্রকাশের মাধ্যমে, বেহেশতের সৌভাগ্য আর দোজখ থেকে মুক্তিলাভের জন্য।
বছরের অন্য সময় নামাজ আদায় করা হয় কয়েকটি আয়াত বা নাতিদীর্ঘ সুরা পাঠের মাধ্যমে। তাও অনেক সময় মনে হয় ক্লান্তিকর। কিন্তু রমজানে তারাবিহ নামাজে পাঠ করা হয় পুরো কুরআন শরিফ। হাফেজ সাহেব প্রতিদিন দেড় পারা বা এক পারা করে পড়েন কিংবা দু’পারা করে খতম করেন ২০ রাকাতে। এভাবে ১৫, ২০, ২৫ কিংবা ২৭ দিনে এক খতম কুরআন পাঠ শেষ হয়ে যায় আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো অবস্থায়। মসজিদ ভর্তি মুসল্লিরা হৃদয়মন নিবিষ্ট করে শোনেন এই তেলাওয়াত।
সারা দিন পরিশ্রম, তারপর উপোস ও ক্ষুধা-তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। সন্ধ্যায় ইফতার করার পর শরীর যেন ভেঙে পড়ে, বিছানার একটুখানি পরশ চায়। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ডাক পড়ে তারাবিহর। মসজিদের মিনারে ধ্বনিত হয় এশার আজান। ক্ষুধা-তেষ্টায় শ্রম-ক্লান্ত রোজাদার সে ডাকে যেন এক অব্যক্ত শক্তির সন্ধান পান। এক অনুপম আধ্যাত্মিক আকর্ষণ তাকে তাড়া করে নিয়ে যায় মসজিদে।
এই আকর্ষণের স্বরূপ কী? রমজানে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ে যুবক, বৃদ্ধ, ছেলেমেয়েরা অনাবিল শক্তি ও আনন্দ পান কোত্থেকে? হাদিসের ভাষ্য, মাহে রমজান আল্লাহ্র রহমতের মাস। রমজান এলে রহমতের দুয়ার খুলে দেওয়া হয়। দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আল্লাহর আরশ থেকে বেহেশত অভিমুখে রহমতের সমীরণ প্রবাহিত হয়। তার দোল এসে রোজাদারের অন্তর স্পর্শ করে যায় পৃথিবীতে।
বস্তুত রমজানে ইবাদতের জাগরণ, মসজিদে উৎসবমুখর তারাবিহ্র জামাত আর রোজাদারের ক্লান্তিহীন আরাধনার মধ্যে আমরা প্রচ্ছন্নভাবে সাক্ষাৎ পাই আল্লাহ্র রহমতের। এ রহমত খাস রমজানের। তারাবিহর সঙ্গে যেন এ রহমত অঝোর ধারায় নেমে আসে আমাদের সামগ্রিক জীবনে। তাই বুঝি, রোজা রেখে তারাবিহ না পড়লে এত খারাপ লাগে। তারাবিহ বড়জোর সুন্নত। ফরয ওয়াজিব নয়। তবুও ফরজের মতো স্বাদ মিশে আছে তারাবিহ নামাজে। তাই রোজাদারের মন তারাবিহর জামাতে হাজির হওয়ার জন্য অস্থির, উদগ্রীব থাকে।
তারাবিহর আধ্যাত্মিক অলংকারের রূপ ও সৌন্দর্য আরও ব্যাপক, আরও গভীর। পবিত্র কুরআনের স্মারণি এ তারাবিহ। পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে মাহে রমজানে। তাই এ রমজানের এত ফজিলত ও মর্যাদা। কুরআন নাজিলের এই মহতি উপলক্ষকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই যুক্তির দাবি। যাতে কুরআন নাজিলের বার্ষিকী উদযাপিত হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়। তবে, এ বার্ষিকী পালনের কর্মসূচি কী হবে? কীভাবে এ মহতি অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্ভব?
হাদিস শরিফে বর্ণিত, প্রতি রমজানে হযরত জিব্রাঈল (আ.) নবীজিকে পুরো কুরআন পাঠ করে শুনিয়ে যেতেন। এটি কুরআন নাজিলের বার্ষিকী পালনের কোনো আসমানি ব্যবস্থাপনা কি না জানি না। কিন্তু চিন্তা করলে আমরা একটি সত্যে উপনীত হতে পারি। তাহলো, কুরআন নাজিলের বার্ষিকী উদযাপন ও পবিত্র কুরআনকে বরণ করার সুন্দর ব্যবস্থাপনা নিহিত তারাবিহর মাঝে।
প্রত্যেক মসজিদে কুরআন মজিদ বিশুদ্ধ পাঠে খতম করা হয়, তাও নামাজে। মুসল্লিরা নামাজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে পাঠ শোনেন আর সমান সওয়াবের ভাগী হন। আপন ধর্মগ্রন্থকে শিশু-কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ মিলে সর্বজনীনভাবে পড়া ও শোনার এরূপ সুন্দর নিয়ম ও আয়োজন অন্য কোনো ধর্মে নিশ্চয়ই নেই।
হিন্দুধর্মে তো সাধারণ মানুষের পক্ষে ধর্মগ্রন্থ পড়া ও শোনা মহাপাপ। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের তো নির্ভেজাল অবিকৃত ধর্মগ্রন্থ বর্তমান নেই। ওসব ধর্মের অনুসারীরাও তার দাবি করে না। বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করণের বৈপরীত্য ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অভাব সর্বজনবিদিত। এসব ধর্মগ্রন্থ নির্ভেজাল নয়, তাই ওসব ধর্মগ্রন্থের হাফেজও নেই। তার মানে পুরো ধর্মগ্রন্থ কেউ বিশুদ্ধভাবে মুখস্থ করে না, মুখস্থ রাখেও না।
একটু গভীরে গিয়ে চিন্তা করুন। দেখবেন, নামাজে তারাবিহ হাফেজ এবং তার হেফজকে সংরক্ষণ করে চলেছে বিস্ময়করভাবে। কুরআন মজিদ হেফজ করার পর প্রতি বছর রমজানে হাফেজকে পুরো কুরআন মুখস্থ তেলাওয়াত করতে হয় তারাবিহ নামাজে। সে জন্য সারা বছর সযত্ন পরিচর্যা করতে হয় হেফজের। খোদা না করুন যদি ভুলে যায় বা পড়ায় ভুল হয় পেছনের হাফেজ লোকমা দেবেন। মসজিদে আল্লাহ্র সামনে ও সমাজের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না। হাফেজ নামের কলঙ্ক হবে। সমাজ প্রত্যাখ্যান করবে। এ ভয় ও আতঙ্ক তাকে তাড়িত করে কুরআন মজিদকে মুখস্থ রাখার প্রেরণায়।
তারাবিহ গোটা মুসলিম সমাজকে সমগ্র কুরআনের সামনে দণ্ডায়মান করায়। সমাজের প্রতিটি মানুষ মেধা, যোগ্যতা ও প্রস্তুতি অনুসারে কুরআন মজিদ থেকে শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা নেয়। হয়তো সবাই তারাবিহতে কুরআন পড়ে বা শুনে অর্থ বুঝে না। তবুও লাভ অপার। প্রতি রাতে দীর্ঘ দেড় দুই ঘণ্টা কুরআন মজিদের তেলাওয়াত শোনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা, তাও ওজুসহ পবিত্র অবস্থায় আল্লাহ্র দরবারে হাজির হয়ে, চাট্টিখানি কথা নয়। না বুঝলেও এর প্রভাব, আবহ ও আমেজ আমাদের জীবন ও সমাজকে কুরআনের রঙে রঙিন হতে অনুপ্রেরণা জোগায়।
যে ব্যক্তি রমজান মাসে আত্ম-উপলব্ধিসহ সওয়াবের নিয়তে রাত জাগে (ভাষ্যকারদের মতে, রাত জাগে মানে তারাবিহর নামাজ পড়ে) তার অতীতের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (মিশকাত)।
এ হাদিসের ভাষ্য অনুসারে তারাবিহ নামাজের মাধ্যমে অতীত জীবনের সকল সগিরা (ছোটখাটো) গোনাহ্ মাফ হয়ে যায়। আর যদি আত্ম-উপলব্ধির মাঝে কবিরা গোনাহ্ চিরতরে ত্যাগ করার সংকল্প ও আল্লাহ্র দরবারে পাপের ক্ষমার আকুতি-তওবা থাকে তাহলে কবিরা গোনাহ্ও মাফ হয়ে যাবে। তারাবিহর মাঝে নিহিত এই সৌভাগ্য প্রকারান্তরে রমজান মাগফিরাতের মাস হওয়ার সত্যকেও সপ্রমাণিত করে।

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী : প্রাক্তন শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

 
Electronic Paper