ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নৈতিক উন্নতি হোক রমজানে

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
🕐 ৭:১৯ অপরাহ্ণ, মে ১৮, ২০১৮

পশ্চিম দিগন্তে এক ফালি চাঁদের হাসি সারা দুনিয়ার জন্য নিয়ে এসেছে পবিত্র মাহে রমজান। আল্লাহর অফুরান রহমতের সয়লাব এসেছে, বরকতের জোয়ার শুরু হয়েছে আর নাজাতের সওগাত বিতরণ হচ্ছে সারা জাহানে। রমজান এসেছে মানুষের নৈতিক উন্নতি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, শারীরিক সুস্থতা ও সামাজিক সাম্য ও শান্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। খোদাভীতি, ধৈর্য্য, ত্যাগ, সাধনা, মানব প্রেম, স্বচ্ছ চিন্তার মতো নৈতিক গুণাবলির বিকাশ সাধন হয় এই মাসে।

মানব সমাজে কেবল অস্ত্র-যন্ত্র, কলাকৌশল, বস্তুগত উন্নতি, কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও সুখ আনতে পারেনি, পারবেও না। বরং এসব বস্তুগত উন্নতির সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও সদ্ব্যবহারের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি। তাহলেই পার্থিব যাবতীয় উন্নতি মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করার পরিবর্তে মানবতার খেদমতেই নিয়োজিত হবে। আজকের পৃথিবীতে নৈতিক চরিত্রের অভাবেই মানুষের হাতের তৈরি মারণাস্ত্র মানব সভ্যতার জন্য মৃত্যু পরওয়ানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষের প্রকৃত পরিচয় কী? একমাত্র নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। এরই গুণে তারা দুনিয়াতে আল্লাহর খেলাফত তথা প্রতিনিধিত্বের মর্যাদার অধিকারী। আর যখন তা খুইয়ে বসে মানুষ তখন হয়ে যায় অপরাপর জানোয়ারের মতো; বরং তার চাইতেও অধম। কুরআন মজিদ বলে:
আমি তো বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তার দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চক্ষু আছে, তার দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের কর্ণ আছে, তার দ্বারা শ্রবণ করে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার চেয়েও অধিক বিভ্রান্ত। তারাই হলো গাফেল। (সুরা আরাফ : ১৭৯)
মানুষকে পশুত্বের এই হীন স্তর থেকে আশরাফুল মাখলুকাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করানোর জন্যই প্রতি বছর আসে মাহে রমজান। রমজান কীভাবে মানুষের জীবনে নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন করে এখানে তা আলোচনা করতে চাই।
প্রত্যহ সুবহে সাদেক থেকে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী-সংশ্রব থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। এ সময় ক্ষুধা-পিপাসার অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও রোজাদার আল্লাহর ভয়ে খায় না এক মুঠো খাবার অথবা এক চুমুক পানি। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী পাশে থাকা সত্ত্বেও তাকে পেতে চায় না আল্লাহর ভয়ে। এভাবে লোভ-লালসা ও যৌন উত্তেজনা, যেগুলো প্রধানত মানুষকে গোমরাহীতে নিয়ে যায় এবং সমাজে যাবতীয় অশান্তির জন্ম দেয়, তার সঙ্গে রোজাদারের সংগ্রাম চলে এক মাসকাল। এই কৃচ্ছ্রসাধনা ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের    মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। দেহ পরিচালিত হয় নৈতিক চরিত্র ও বিবেকের পথ-নির্দেশ মোতাবেক। এভাবেই মানব দেহের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিবেকের শাসন ও আল্লাহর রাজত্ব।
সারা দিন রোজার উপবাসে ক্ষুধার যন্ত্রণা। এরপর ইফতারের সময় যে সামান্যটুকু খাবার সামনে নিল তাও একা নিজে খেয়ে উদরপূর্তি করল না রোজাদার। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস এসে মনের মিনারে আজান দিল: ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তা সে ব্যক্তির গোনাহের ক্ষমা ও দোযখ থেকে মুক্তিলাভের সম্বল হবে এবং তাকে ঐ রোজাদারের রোজার সমতুল্য অতিরিক্ত সওয়াব দেওয়া হবে।’ (বায়হাকির বরাতে মিশকাত।)
এই অফুরন্ত সওয়াবের বাসনায় রোজাদার দিন শেষের সামান্যটুকুন খাবারে অপর রোজাদার ভাইকে নিয়ে মিলেমিশে ইফতার করল। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসা ও সহযোগিতার এই অনুশীলন সত্যিই অপূর্ব। যারা সমাজের ওপর তলার কর্তা, তারাও রমজানে উপোস থেকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন অনাহার-উপবাসের কী করুণ যন্ত্রণা।
তাই তারা নিজের সঞ্চিত অর্থের একটি অংশ যাকাত হিসেবে বিতরণ করেন গরিবদের মাঝে। রমজান শেষ হতেই তারা ফিতরা দিয়ে দেন অভাবী লোকদের হাতে। আর সে যাকাত-ফিতরায় গরিবদের সংসারে ফিরে আসে সচ্ছলতা। ধনীর ধনের প্রতি হিংসা আক্রোশের পরিবর্তে গরিবদের মনে জাগ্রত হয় শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ভাবধারা। আল্লাহর ওয়াস্তে নিঃস্বার্থ দান করে ধনীরাও পায় অনাবিল তৃপ্তি। এমনি করে মাহে রমজানে ধনী ও গরিবের মাঝে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার অনুশীলন হয়।
দুনিয়ার সর্বত্র আজ ধনী-গরিবে শ্রেণিসংগ্রাম, হানাহানি, রক্তপাত। সমাজের একদিকে পুঁজিপতিদের স্বর্গসৌধ, অন্যদিকে সেই সৌধের প্রাচীর ঘেঁষে অনাহার-ক্লিষ্ট দরিদ্র মানুষের নিরন্ন মিছিল। এক্ষেত্রে রমজানুল মোবারকের আদর্শই এই শ্রেণিসংগ্রাম, সর্বহারা আর পুঁজিপতির আকাশ-পাতাল ব্যবধান দূর করে সমাজে সাম্য ও শান্তিধারা নামাতে পারে। রমজানের পর ঈদের দিনে আমরা সাম্য মৈত্রীর সেই শান্তিময় সমাজ ব্যবস্থারই প্রদর্শনী দেখতে পাই প্রতিটি মুমিনের ঘরে ঘরে আর ঈদের ময়দানে।
সন্ধ্যায় ইফতারের পর ক্ষুধা-তেষ্টার যন্ত্রণায় ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর যখন বিছানায় মিশে যেতে চায় তখনই তাগাদা আসে তারাবিহ নামাজের। যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর মিলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারাবিহ নামাজ আদায় করে শহর-মহল্লার মসজিদসমূহে। তারাবিহর পর একটু বিশ্রামের জন্য যেই না নিদ্রামগ্ন হয় আবার শেষ রাতে সাহরি খাওয়ার সাড়া পড়ে সারা শহর-গ্রামজুড়ে। রাতের আঁধারে আল্লাহর ইবাদতের প্রস্তুতি গ্রহণের এই উৎসব, এই আয়োজন সত্যিই অপূর্ব। বাস্তবিকই রমজানে এহেন কর্মব্যস্ততা আর তৎপরতা মানুষের যাবতীয় অলসতা-বিলাসিতা দূর করে দেয়। নিত্যনতুন কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মব্যস্ততায় উজ্জীবিত করে রোজাদারকে। প্রত্যেকের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু নিয়ম শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সর্বসম্মত মত, মানুষ যখন রমজান মাসে সারা দিন উপবাস থাকে তখন তাদের পেট থেকে দীর্ঘ এগার মাসের পুঞ্জীভূত ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে বেরিয়ে যায়। বছরের দীর্ঘ এগার মাস একটানা খাটুনির পর মানব দেহের পরিপাকযন্ত্র রমজানের এক মাসে বিশ্রাম গ্রহণ ও অয়েলিংয়ের সুযোগ লাভ করে। ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার মূলকেন্দ্র পাকস্থলী পাক-সাফ হয়ে মানুষ স্বাস্থ্য, মনোবল ও স্বচ্ছ চিন্তাধারার অধিকারী হয়।
বস্তুত মাহে রমজান হচ্ছে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, আত্মগঠন ও সামাজিক উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার এক মাসের ট্রেনিং কোর্স। কিন্তু মুসলমানরা নিছক ট্রেনিংয়ের মনোভাব নিয়ে এ রোজাব্রত পালন করে না। বরং আল্লাহর ইবাদত হিসেবে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের অদম্য আগ্রহে সব কিছুকে বরণ করে। রোজাদারের মনে সারাক্ষণ জাগরূক থাকে আল্লাহর ভয় ও আখেরাতে আল্লাহর অফুরান প্রতিদান লাভের বাসনা। এজন্য রোজার প্রধান শর্ত হচ্ছে, পানাহার ও স্ত্রী সংশ্রব ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত ও সওয়াবের নিয়ত করা। রোজার এই নিয়ত রোজাদারের মনে সঞ্চার করে এক দুর্জয় শক্তি। আল্লাহর দাসত্ব ও খেলাফতের যথার্থ উপলব্ধি হাসিল করে রোজাদার এই নিরবচ্ছিন্ন সাধনার মধ্য দিয়ে।
আল্লাহর বান্দাদের আজীবন আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনে অভ্যস্ত করে তুলে ত্রিশ দিনের এই সংগ্রাম। আল্লাহর ভয়, খেলাফতের দায়িত্বানুভূতি ও পরকালে জবাবদিহির জাগ্রত আতঙ্ক বদ্ধমূল হয় প্রত্যেকের অন্তরে। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে রমজানে নিজের হালাল খাবার ও হালাল স্ত্রীকে বর্জন করেছে পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ লংঘন করার সাহস পায় না-যদি সে বাস্তব উপলব্ধি নিয়ে রোজা রেখে থাকে। হাদিস শরিফে এ কথাই বুঝানো হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ইমান ও এহতেসাব (আত্মবিশ্লেষণ)-সহকারে রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’
এমনিভাবে রোজা সম্বন্ধে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ পাক বলেন, ‘রোজা একমাত্র আমার জন্য এবং তার প্রতিদান আমি নিজ হাতে দেব অথবা অন্য অর্থে আমিই স্বয়ং তার প্রতিদান।’ (বুখারি, মুসলিমের বরাতে, মিশকাত)
দুনিয়ার যত অন্যায়-অবিচার একমাত্র আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস ও আখেরাতের প্রতি ঔদাসিনতা তথা নাস্তিক্যবাদেরই ফসল। রমজান এক্ষেত্রে সবক দেয় আল্লাহর ভয়, আত্ম-উপলব্ধি ও পরকালে জবাবদিহি হওয়ার তীব্র অনুভূতি। ফলে কোনো গোয়েন্দা পুলিশ, সৈন্যসামন্ত অথবা দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রয়োজন হয় না রোজাদারকে শাসন করার জন্য। তারা আল্লাহর ভয়ে নিজে নিজেই সংযত হয়ে যায়। আদর্শ নাগরিক, সোনার মানুষ, আল্লাহর প্রতিনিধি, দ্বীনের মুজাহিদ প্রভৃতি যে কোনো উপাধিই প্রযোজ্য হয় তখন তাদের জন্য। মূলত এরই জন্য আল্লাহ্ পাক ফরজ করেছেন রমজানের রোজা। কুরআন মজিদ বলে-
‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকি-সংযমী হতে পারো।-(সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৪)
 রোজাদারের সামগ্রিক জীবনে যদি রোজার এই নৈতিক সামাজিক শিক্ষার কোনো প্রতিফলন না ঘটে তাহলে আল্লাহর কাছে সে রোজার কোনো মূল্য হয় না। আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ  করেন :
হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে রোজাদার অন্যায় অশ্লীল কথাবার্তা ও পাপাচার ত্যাগ করে না তার পানাহার ত্যাগ করে উপবাস থাকাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (মিশকাত, কিতাবুস সউম)
বর্ষাকালে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে, আমরা চোখে দেখি। রমজানে অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হয়, চোখে দেখি না, অন্তরে অনুভব করা যায়। অন্য সময়ের তুলনায় রমজানে মসজিদসমূহে মুসল্লিদের প্রচণ্ড ভিড় এবং মানুষে মানুষে ইমানি চেতনার উজ্জীবন রহমতের সেই বরিষণের ফল। আল্লাহ পাকের কাছে আমাদের ফরিয়াদ, এবারের রমজান যেন আমাদের নিজেদের জন্য, পরিবার পরিজন, সমাজ, দেশ, জনগণ, সারা দুনিয়ার মুসলমান ও সমগ্র মানব সভ্যতার   জন্য অফুরান কল্যাণ বয়ে আনে। রমজানের কল্যাণ ও সৌভাগ্য জীবনে ধারণ করতে হলে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত সচেতনভাবে কাটাতে হবে।
হাদিসের ভাষায় ‘যে ব্যক্তি ইমান ও আত্মজিজ্ঞাসা সহকারে রমজান মাসে রোজা রাখবে তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (মিশকাত) অবশ্য এ হাদিসে গুনাহসমূহ বলতে সগিরা বা ছোটখাটো পাপকর্ম বুঝানো হয়েছে। বড় গুনাহ বা কবিরা গুনাহ মাফ হওয়ার জন্য অবশ্যই তাওবা করতে হবে। তাওবা মানে কৃত পাপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, ভবিষ্যতে করব না বলে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়া, তারপর আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
রমজানে এই তওবার অবারিত সুযোগসহ আল্লাহর স্মরণ ও ভালোবাসায় সৎকাজ ও সৎচিন্তার এবং আগামী এক বছরের কর্মপরিকল্পনার সুযোগ আমরা কাজে লাগাব এই হোক আমাদের আজকের প্রত্যয়।

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী : প্রাক্তন শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

 
Electronic Paper