ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সশস্ত্র বাহিনী দিবসের গুরুত্ব

মিল্টন বিশ্বাস
🕐 ৯:৩৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২০, ২০১৮

আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস। ২০১৮ সালে এসে কেবল গত ১০ বছরে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন ও তাদের কার্যক্রমের সাফল্যগাঁথা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হবে এই দিবসটি উদযাপনের তাৎপর্য। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূচনা করে। ’৮০র মাঝামাঝি থেকে সম্মিলিতভাবে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এর আগে ২৫ মার্চ সেনা, ১০ ডিসেম্বর নৌ এবং বিমানবাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর আলাদাভাবে দিবসগুলো পালন করত। পরে ২১ নভেম্বরের তাৎপর্য সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের পেছনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর অবদানকে সাধারণ জনতার আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করে দেখা হয় এ দিবসটিতে।  
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলার জবাবে অস্ত্র তুলে নেয় বিপ্লবী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, আনসার এবং অন্য সদস্যরা। পরবর্তী সময়ে এগিয়ে আসে পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি নাবিক ও নৌ অফিসার, সেনা ও বিমান কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সর্বস্তরের মুক্তিপাগল হাজার হাজার যুবক। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ধারণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানি শাসকদের স্বপ্ন নস্যাৎ ও তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় একটি সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর। মুজিবনগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে (পরবর্তী সময়ে জেনারেল) মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিয়োগ করে। তার ওপর মুক্তিবাহিনীকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা দ্রুত নিজেদের সুসংগঠিত করে পাল্টা আক্রমণ করে। সারা দেশকে বিভক্ত করা হয় ১১টি সেক্টরে যার নেতৃত্ব দেওয়া হয় একেকজন সুশিক্ষিত পেশাদার সেনা কর্মকর্তাকে। আট মাস পর ’৭১ সালের ২১ নভেম্বর চূড়ান্তভাবে সম্মিলিত আক্রমণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সেদিন স্থল, নৌ ও আকাশপথে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে চালানো হয় ত্রিমুখী আক্রমণ। উন্মুক্ত হয় বিজয়ের পথ। এই আক্রমণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফলতা লাভ করে জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে। তারা বাধ্য হয় পশ্চাদপসারণে। সুশিক্ষিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে সূচিত হয় মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের ইতিহাস। তারপর মিত্রবাহিনীর সহযোগে ঘোষিত হয় সার্বিক যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয়। প্রকৃতপক্ষে এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক রক্ষিত রয়েছে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারির মিলিটারি একাডেমিতে। অন্যদিকে নেভাল একাডেমিতে নির্মাণাধীন রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’। সেখানকার ‘রেডকিন’ চত্বরটি মুক্তিযুদ্ধের পরে মাইন অপসারণের সময় নিহত রাশিয়ান নাগরিক শহীদ রেডকিনের নামে করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদরদপ্তর অবলুপ্ত হয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিন বাহিনীর  পৃথক সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলোর সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে এবং আইনের দ্বারা তার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।       
০২.
শেখ হাসিনা সরকারের ১০ বছরে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে আন্তরিক কর্মযজ্ঞ দেখা গিয়েছে। ইতিপূর্বে ১৯৯৬ সালে এই আওয়ামী লীগ সরকারই তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এপিসি বা Armoured Personnel Carrier, MIG-২৯ যুদ্ধবিমান, অত্যাধুনিক Class-৪ ফ্রিগেট ও অন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে। পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ওয়ার কলেজ, আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ, BIPSOT বা Peace Keeping ইনস্টিটিউট, BUP, Science & Technology ইনস্টিটিউট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জনবল বাড়ানোর জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, একটি পদাতিক ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস ব্রিগেড ও বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের ব্যাটালিয়নসহ অন্য উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর নতুন Armoured Personnel Carrier কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ফোর্স কমান্ডার বা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে পদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সৈনিকদের কল্যাণের জন্য গ্যারিসনে বা তার আশপাশের পরিবারের সঙ্গে বসবাসের কোটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। অফিসারদের হাউজিং প্লট দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে অনেক আগেই। ২০০৯ সালে বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় জঘন্যতম ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে যেসব সেনা কর্মকর্তা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের জন্য সরকারের নানাবিধ প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। অন্যদিকে হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ‘দ্রুত বিচার আইনে’ বিচারকার্য সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে মেধাবী ও কর্মে নিযুক্ত সেনা কর্মকর্তার প্রতি বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন সম্মানজনকভাবে সমাপ্তি লাভ করেছে। কক্সবাজারে বিমানবাহিনীর ঘাঁটি উদ্বোধন করা হয় ২০১১ সালের এপ্রিলে। ২০১৪ সালের ১১ জুন ৩টি MI ১৭ হেলিকপ্টার ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২৭ জুন ১৬টি এফ সেভেন (বিজিআই) বিমান ক্রয়ে চুক্তি হয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে সারফেইস টু এয়ার মিসাইল (SHORAD) সংযোজিত হওয়ার পর পরীক্ষামূলক ফায়ারিং অনুষ্ঠিত হয় সে সময়। বিমানবাহিনী একাডেমিতে ৪ তলাবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু ভবন কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সেইফটি সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে বিমানবাহিনী কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। এ ছাড়া জাপানের সুনামি দুর্গতদের জন্য ত্রাণসামগ্রী জাপানে পৌঁছে দিয়ে বিমানবাহিনী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত এখন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ চূড়ান্তকরণ ও সাংগঠনিক কাঠামোতে জনবল সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে টেবিল অব অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ইক্যুইপমেন্টের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও আধুনিকায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সেনাবাহিনীতে চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাংক-এমবিটি ২০০০, অত্যাধুনিক রাডার, সেলফ প্রপেলড গান এবং নতুন হেলিকপ্টার সংযোজন করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নকল্পে আওয়ামী লীগ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে ঋণ চুক্তি অনুযায়ী সমরাস্ত্র ক্রয় করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বৈশ্বিক মানে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে জুলাই ২০১৩ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে মেডিকেল কোরে মহিলা সৈনিক ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সাংগঠনিক এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সিলেটে একটি পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে রূপান্তর করে একটি  মেকানাইজড পদাতিক ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
০৩.
চট্টগ্রামের মিলিটারি একাডেমি ও নেভাল একাডেমি দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এদের গুরুত্ব কী? মিলিটারি একাডেমির কঠোর প্রশিক্ষণ বর্তমান তরুণদের অনেকেই সহ্য করতে পারছে না। বাড়ি ফেরত আসছে। লেখাপড়ায় তাত্ত্বিক দিক থেকে তারা এগিয়ে আছে; কিন্তু কষ্টকর শারীরিক শ্রমে একটুতেই কাতর হয়ে পড়ছে। রাইফেল কাঁধে দৌড়ানো আর সাঁতার কাটার মতো সহজ কাজেও তাদের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। এ জন্য স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের শারীরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুস্থ সবলভাবে গড়ে তোলা দরকার। দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরিতে মিলিটারি একাডেমির অবদান অনস্বীকার্য। মিলিটারি একাডেমির মতো নেভাল একাডেমি সম্পর্কেও সাধারণ জনগণ খুব কমই ধারণা রাখে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে স্বৈরশাসকের একাধিপত্যের কারণে দেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্বন্ধে বিরূপতা জন্মে জনমনে। একইসঙ্গে ভীতিবোধ ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো যে আমাদের দেশ এবং জনগণের অর্থে পরিচালিত হয় এ ধরনের সচেতনতা আমাদের মধ্যে এখনো আসেনি।  
বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি যাত্রা শুরু করে ১৯৭৬ সালে। এটি এক ধরনের সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে এটি অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি অফিসার ক্যাডেট ও সরাসরি ভর্তিকৃত অফিসারদের মৌলিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। ক্যাডেটরা এ একাডেমিতে ১৮ মাসের প্রশিক্ষণের শুরুতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে সেনা ও বিমানবাহিনীর ক্যাডেটদের সঙ্গে ১০ সপ্তাহের সম্মিলিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। একাডেমির প্রশিক্ষণ শেষে মিডশিপম্যান হিসেবে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশে তারা ৬ মাসের জন্য যুদ্ধজাহাজে গমন করে। অতঃপর তারা বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে অ্যাঃ সাঃ লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করে। পরবর্তী সময়ে প্রায় এক বছর বিভিন্ন ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় নেভাল একাডেমিতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সমাপ্তির পর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের অধীনে বিজ্ঞানে স্নাতক (বিএসসি-পাস) ডিগ্রি অর্জন করে। তবে প্রকৌশল ও বিদ্যুৎ প্রকৌশল শাখার অফিসাররা বুয়েট অথবা এমআইএসটিতে অধ্যয়নের পর গ্র্যাজুয়েশন লাভ করে। ক্যাডেট প্রশিক্ষণ ছাড়াও এ একাডেমিতে সরাসরি নিয়োগকৃত অফিসারদের বেসিক কোর্স, জুনিয়র স্টাফ কোর্স, কমন কোর্স এবং কম্পিউটার কোর্স পরিচালনা করা হয়। ক্যাডেটরা দেড় বছর এ ক্যাম্পাসে অবস্থান করে, কখনো তারও বেশি। তবে প্রশিক্ষণের সফল পরিসমাপ্তি ও কমিশনিং অনুষ্ঠানের পর তারা মাতৃভূমির সেবায় আত্মনিয়োগ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় ‘সাবমেরিন’ ক্রয়ের পর দেখা গেছে, বর্তমানে নৌ শক্তি কেবল যুদ্ধের জন্য নয় বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে মিলিয়ে নেভাল একাডেমিকে সাজাতে হবে। কেবল জলোচ্ছ্বাসের ভয়ে জিনিসপত্র ৩০ ফুটের উচ্চতায় রাখার মধ্যে সীমিত থাকা উচিত নয়; আধুনিকায়ন দরকার। লোকবলও বাড়াতে হবে। মিলিটারি ও নেভাল একাডেমিতে বিপুলসংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি উৎসে পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তা ছাড়া এখান থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করছেন প্রতিবছর।
০৪.
জাতিসংঘ সনদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা এবং সপ্তম অধ্যায়ে শান্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সংঘর্ষে লিপ্ত দুপক্ষের সম্মতি এবং মতৈক্যের ওপর ভিত্তি করে শুরু হয়। শান্তিরক্ষা বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কর্তৃক অনুমোদিত একটি শান্তিচুক্তি বা শান্তি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের মধ্যে ৫৪টিতে ১,১৮,৯৮৫ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন। শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সদস্যসংখ্যা ৮,৯৩৬ জন যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে এ দেশের সেনাবাহিনীর ১৫ জন সদস্য জাতিসংঘের পতাকাতলে একত্র হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তি মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কঙ্গো, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্তান, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর প্রভৃতি স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নাম। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর মোট ৯৬ জন সদস্য শহীদ হয়েছেন; পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন ১৪ জন। অন্যদিকে ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আয় হয়েছে ২০ হাজার ৪৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। মূলত, বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কারণ বিশ্বে সব প্রান্তের দুর্গত, নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এ শান্তিরক্ষীদের হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছে।
০৫.
১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিত হয়েছিল জনতার সঙ্গে। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অর্থাৎ জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি উদ্দীপক বিভাব। জাতির প্রয়োজনে অর্পণ করা কঠিন দায়িত্ব পালনে সশস্ত্র বাহিনীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অনন্য। দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালোবাসা এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেম। শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।’ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক এ জন্য প্রয়োজন। পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার আধুনিকায়ন করে যেতে হবে। কারণ, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। এ ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমন্নতি বিধানের জন্য সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
 
ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

 
Electronic Paper