ঢাকা, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪ | ২২ আশ্বিন ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নতুন মোড়কের পুরাতন বিষে আকৃষ্ট হচ্ছে তরুণ সমাজ

মিঠুন বৈদ্য
🕐 ৫:১১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২৩

নতুন মোড়কের পুরাতন বিষে আকৃষ্ট হচ্ছে তরুণ সমাজ

ধূমপানের আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই তামাকজাত পণ্যের বিকল্প হিসাবে ই-সিগারেটের প্রতি আসক্ত হচ্ছেন। অথচ, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-সিগারেট বরং সিগারেটের চেয়ে আরও বেশি ক্ষতিকর। জনস্বাস্থ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বর্তমান সরকার সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের পাশপাশি নানামুখী কৌশলপত্র ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

সরকার কর্তৃক গৃহীত এসকল পদক্ষেপের ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যু এবং বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ও এই সংখ্যার ঊর্ধ্বগতি খুবই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগসমূহ নীরব মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে। তামাকের ব্যবহার এসকল অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচিত। পরিস্থিতি মোকাবেলায় তামাকের ব্যবহার কমাতে বর্তমান সরকার নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ সংশোধনের খসড়ায় ই-সিগারেটের উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করা হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

বাংলাদেশের জনগণকে তামাকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এই লক্ষ্য পূরণে আইন সংশোধনের পাশাপাশি সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে তামাকের ব্যবসা এবং ব্যবহার ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আগাম প্রস্তুতি হিসাবে কোম্পানিগুলো নতুন অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছে। এই নতুন অস্ত্রের নাম হলো হিট-নট-বার্ন বা ই-সিগারেট।

সিগারেট, বিড়ির মতো ক্ষতিকর দ্রব্য নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায়, এখন তামাক কোম্পানিগুলো ই-সিগারেট নামক নতুন পণ্যে তরুণদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে। ই-সিগারেট তামাকজাত দ্রব্যের মতই ক্ষতিকর। বাংলাদেশে এ পণ্যের ব্যবহার এখনও খুবই সীমিত। বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী বিদেশী তামাক কোম্পানিগুলো সুকৌশলে তরুণদের ই-সিগারেট ব্যবহারে নানা প্রচারণা চালাচ্ছে। ফলে, বিভিন্ন বয়সী মানুষ বিশেষ করে তরুণরা ই-সিগারেটকে অনেকটা ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটানসহ বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক দেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এটি নিষিদ্ধের এখনই উপযুক্ত সময়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে:
১। সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেট থেকে নিকোটিন বেশি পরিমাণে নির্গত হয়। এতে আসক্তি বাড়ে।
২। নিকোটিন ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। ভ্যাপ জুসে রাসায়নিক উপাদান বেশি থাকায় এটি সেবনে ফুসফুসের আরও বেশি ক্ষতি হয়। তাই এখনই সরকারের উচিত এর বাজারজাত নিষিদ্ধ করা।
৩। যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগুলোর ফ্লেভার বা স্বাদ প্রধান ভূমিকা পালন করে।

ক্ষতি কমানো ও ধূমপান ত্যাগের উপকরণ হিসেবে সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ইলেক্ট্রনিক সিগারেট বাজারজাত করা হলেও এটি আসলে একটি নেশা সৃষ্টিকারী পণ্য। গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র ০.০২ শতাংশেরও কম মানুষ ই-সিগারেট ব্যবহার করে ধূমপান ছাড়তে পেরেছেন। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট অনুযায়ী, ই-সিগারেট ব্যবহারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। জাপানে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকারক। ই-সিগারেটের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ভারতসহ বিশ্বের ৪২ দেশ তাদের দেশে ই-সিগারেটকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে এবং আরও ৫৬ দেশ এই পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ই-সিগারেটের ধোয়া নির্গমনে সাধারণত নিকোটিন এবং অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয় যা ব্যবহারকারী এবং অব্যবহারকারী উভয়ের জন্যই ক্ষতিকারক। ই-সিগারেটের ব্যবহার পরবর্তীতে অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি করে। নিকোটিন ছাড়া এতে সরাসরি ব্যবহৃত কেমিক্যালের মধ্যে থাকে প্রোপাইলিন গ্লাইকল, গ্লিসারল ও বিভিন্ন ফ্লেভার। এছাড়া, ই-সিগারেটে ব্যবহৃত কিছু লিকুইডে গাঁজার মূল উপাদান (THC) এবং ভিটামিন ই অ্যাসিটেটের প্রমাণ মিলেছে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ব্যবহার করলে হৃদরোগ এবং ফুসফুসের রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এমনকি ই-সিগারেট ব্যবহারের ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি পাঁচগুণ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, তরুণ সমাজকে নেশামুক্ত রাখতে হলে ই-সিগারেট সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি এই পণ্য উৎপাদনে বিদেশী বিনিয়োগ নিষিদ্ধের জোর দাবি জানাই।

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট

 
Electronic Paper