ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও ঐতিহাসিক নির্বাচনের স্মৃতিকথা

‘আর্তের সেবায় আওয়ামী লীগ’

তোফায়েল আহমেদ
🕐 ৯:৫৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১১, ২০১৮

১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেক পরিবার তাদের আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, ভাইবোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল। প্রতিবছর যখন ১২ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে আসে, তখন বেদনাবিধুর সেই দিনটির কথা স্মৃতির পাতায় গভীরভাবে ভেসে ওঠে।

সেদিন আমি ছিলাম জন্মস্থান ভোলায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে আসন্ন নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত ছিলাম আমার নির্বাচনী এলাকায়। কয়েকদিন ধরেই গুমোট আবহাওয়া ছিল। বৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে ছিল ঝড়ো বাতাস। এরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মিয়া, মাওলানা মমতাজুল করিম, মোস্তাফিজুর রহমান মিয়া ও রিয়াজউদ্দীন মোক্তারসহ অন্য নেতাদের নিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকাসহ ভোলায় ব্যাপক গণসংযোগ করি।

’৬৯-এর উত্তাল গণআন্দোলনে যে গণবিস্ফোরণ ঘটে তাতে ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাসীন হন। এ সময় মার্শাল ল’র মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ জুন মাস থেকে ঘরোয়া রাজনীতি দেয়। ‘৭০-এর ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। ’৭০-এ জানুয়ারির ১ তারিখ রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহৃত হয়। তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ডাকসুর ভিপি।

ছাত্রলীগের উদ্যোগে আমার নেতৃত্বে সেদিন প্রথম জনসভা করি পল্টনে। তখনই বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই ভোলা যাবি। সব এরিয়া সফর করবি। আমি তোকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিব।’ একথাটা ভীষণভাবে আমার হৃদয়কে আলোড়িত করে। এপ্রিল মাসে ভোলার ৭টি উপজেলায় নির্বাচনী সভা করি। ভোলার যেখানেই গিয়েছি হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে।

আমি ছিলাম ভোলা-১ আসনে এমএনএ পদপ্রার্থী। প্রতি মাসে ভোলায় যাই। রাজনৈতিক গণসংযোগ ও নির্বাচনী জনসভা করি। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ নির্বাচন যখন ঘনায়মান ঠিক তার ২৫ দিন আগে ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হলো দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। আমি তখন ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত। ১২ নভেম্বরের তিন-চার দিন আগ থেকেই বিভিন্ন জায়গায় বিরাট বিরাট জনসভা করেছি। ১০ তারিখ আমার জনসভা ছিল তজুমদ্দিনে। তখন তজুমদ্দিন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন টুনু চৌধুরী। জনসভা শেষ করে টুনু চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা পরে তজুমদ্দিন উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, মোশারফ হোসেন দুলালের বাড়িতে রাত কাটাই এবং ১১ তারিখ লালমোহনে মঙ্গল শিকদারে জনসভা করতে যাই।

সেখানে বিশাল জনসভায় যখন বক্তৃতা করছি তখন শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি এবং প্রচণ্ড ঝড়। এর মধ্যেই জনসভা শেষে প্রবীণ নেতাসহ জিপে করে ভোলায় ফিরে আসি। ১২ তারিখ আমার জনসভা ছিল তজুমদ্দিন দাসের হাট। আমি যখন শাহজাদা ভাইয়ের জিপে করে দৌলতখান হয়ে-তখন দৌলতখান হয়ে তজুমদ্দিন যাওয়া যেত-রওনা করেছি তখন দৌলতখান যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। সবাই আমাকে নিষেধ করল আপনি এই জনসভায় যাবেন না। কিন্তু আমি তো রিকশা করে মাইক পাঠিয়েছি। আমার লোক চলে গেছে দাসের হাটে। আমার মা সংবাদ পেয়ে-শ্রদ্ধেয় মা যিনি আমার জীবনের প্রেরণার উৎস-তিনি নিষেধ করলেন আমি যেন জনসভা বাতিল করি। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম। ফিরে রাতে শ্বশুরালয়ে অবস্থান করছি।

মধ্যরাতে শুরু হয় তুমুল ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস। সকালবেলা আমি এবং মোশারফ হোসেন শাহজাহান নদীর পাড়ে গিয়ে অবাক ও বিস্মিত হলাম। শুধু কাতারে কাতারে মানুষের মৃতদেহ। অসংখ্য লোকের মৃতদেহ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। আমরা দিশেহারা হয়ে গেলাম। এখনো স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে শিবপুর ইউনিয়নে রতনপুর বাজারের পুকুর পাড়ে শত শত লোককে দাফন করার দৃশ্য! এত মৃতদেহ যে, দাফন করে আর কুলাতে পারছি না। যতদূর যাই শুধু মানুষের হাহাকার আর ক্রন্দন। এই শিবপুর ইউনিয়নে একটা বাড়ি যেখানে ৯০ জন লোক ছিল। কিন্তু বেঁচে ছিল মাত্র তিনজন। সবাই মৃত্যুবরণ করেছে।

যখন তজুমদ্দিনের খবর পাই তখন শুনি যে, ৪০ শতাংশ লোকের মৃত্যু হয়েছে। যে দাসের হাটে জনসভা করার কথা ছিল সেখানে কিছুই নেই। আমার মাইক যে বহন করেছিল তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। দাসের হাটে বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন তারা সবাই সর্বস্বান্ত। চিত্তবাবু নামে এক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার গুদাম ঘরে চাল, ধান, সুপারি ছিল। তিনি একেবারে রিক্ত। আমি দাসের হাট, তজুমদ্দিন গিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অবাক হলাম।

ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে ১০ লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তখন নির্বাচনী গণসংযোগে সাতক্ষীরায় অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে লোক মারফত ৫ হাজার টাকাসহ বার্তা পাঠালেন, আমি যেন সর্বত্র দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং শুকনো খাবার বিশেষ করে চিঁড়া, মুড়ি ইত্যাদি মানুষের কাছে পৌঁছে দিই। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ত্রাণ কাজ করেছিলাম ’৭০-এর এই দিনগুলোতে। আমার শ্বশুরের গদিঘরে টেলিফোন ছিল। বঙ্গবন্ধু নম্বর সংগ্রহ করে আমাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিলেন, ‘তুই দুর্গত এলাকার প্রত্যেকটা জায়গায় ক্যাম্প কর এবং লিখে রাখ ‘আর্তের সেবায় আওয়ামী লীগ’। অনেক মানুষ রিলিফ নিয়ে যাবে কিন্তু এই দুর্গত অবস্থায় তারা মানুষের কাছে রিলিফ পৌঁছাতে পারবে না। কিছুটা বিলি করে বাকিটা তোর কাছে দিয়ে আসবে। তুই সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিবি।’ আসলে হয়েছেও তাই।

আমি ১২ তারিখের পর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পানি, শুকনো খাবার, কেরোসিন তেল পৌঁছে দিয়েছি। হাবিবুর রহমান তালুকদার নামে একজন পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষ ছিলেন। যাকে আমি ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতাম। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন এবং আমাকে তার ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার একটি লঞ্চ ছিল। সেই লঞ্চে করে আমি নদীর পাড়ে পাড়ে মানুষের সেবা করেছি। আমি যখন রাস্তা দিয়ে যেতাম হাটবাজার ভেঙে মানুষ ছুটে আসত।

সন্ধ্যাবেলায় এমন হতো যে, মানুষ আমার মুখের ওপর হারিকেন ধরত আমাকে একনজর দেখার জন্য। মানুষজন বলত, ‘ছেলেটাকে একনজর দেখি।’ ভোলার আঞ্চলিক ভাষায় বলত, ‘ছ্যামরাকে দেখি। ছ্যামরাকে দেখলে সওয়াব হবে। আমাদের জন্য ও এত কাজ করে।’ মানুষ এভাবে মাথায় তুলে আমাকে তাদের হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছিল। ১৪ তারিখ বঙ্গবন্ধু ভোলায় ছুটে এলেন। ভোলায় বঙ্গবন্ধু আমার শ্বশুরালয়ে উঠলেন। সেখান থেকে হাবিবুর রহমান তালুকদারের লঞ্চে করে বঙ্গবন্ধুকে আমরা দুর্গত এলাকায় নিয়ে গেলাম। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, লাখো মানুষের মৃতদেহ আর সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষের পাশে তিনি দাঁড়ালেন। তাদের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিয়ে তাদের সমব্যথী হলেন।

যখন মনপুরায় গেলাম দেখি, বহু লোকের ভিড়ে একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে তার স্রেফ একটা লুঙ্গি। আমি লঞ্চ থেকে নেমেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি আমার প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন শাহজাদা ভাই। ১০ তারিখে তিনি মনপুরা গিয়েছিলেন আমার নির্বাচনী প্রচারকার্য চালানোর জন্য। যখন মনপুরা থেকে ফিরে এলাম তিনি তখন থেকে গেলেন। আমি উনাকে অনুরোধ করেছিলাম আমাদের সঙ্গে ফেরার জন্য।

কিন্তু উনি বললেন, ‘আমি ইলেকশন পর্যন্ত থাকব।’ গিয়ে দেখি উনার কিচ্ছু নেই। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে টেনে আদর করলেন। লঞ্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর যে পায়জামা-পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট ছিল সেগুলো তিনি শাহজাদা ভাইকে দিলেন। তার পর সেখান থেকে ফেরার সময় বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আর আমার পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভবপর নয়! আমাকে তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠিয়ে দাও।’ যে বিশেষ লঞ্চে বঙ্গবন্ধু ভোলা গিয়েছিলেন সেই লঞ্চে করে ঢাকায় ফিরে এলেন।

উপকূলীয় দুর্গত এলাকা ভোলা, রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ সফর শেষে হোটেল শাহবাগে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুর্গত এলাকা আমি সফর করে এসেছি। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। এভাবে আমরা মানুষকে মরতে দিতে পারি না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এখনো দুর্গত এলাকায় আসেননি। আমরা যে কত অসহায় এই একটা সাইক্লোন তা প্রমাণ করেছে।

আরও একবার প্রমাণিত হলো যে, বাংলার মানুষ কত অসহায়! একবার পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। আরেকবার এই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রমাণিত হলো। সুতরাং আমরা এভাবে আর জীবন দিতে চাই না। আমরা স্বাধিকারের জন্য, আমাদের মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করতে চাই।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি তখন আর্তের সেবায় উৎসর্গিত। উদয়াস্ত কাজ করছি। ভোলাসহ দুর্গত এলাকার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রতিনিয়ত আমার খোঁজখবর নিতেন। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এলেন ভোলায়। আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে গাড়িতে তুলে নিলেন। ১৪ দিন পর অর্থাৎ ২৬ নভেম্বর সি প্লেনে চেপে ভোলায় এলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। নামলেন চকিঘাটে। আমি চকিঘাটে গেলাম। চকিঘাট থেকে তিনি দৌলতখান গেলেন।

চারদিকে হাজার হাজার লোক। প্রেসিডেন্টের গাড়িতে ছিলেন সাহেবজাদা ইয়াকুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক, আর ছিলেন গভর্নর আহসান। আমাকে প্রথমে ঘটনাস্থলে যেতে দিতে চাইছিল না। মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে তাদের দাবির মুখে আমাকে যেতে দেওয়া হয়। পরে সাহেবজাদা ইয়াকুব আমাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বললেন, ‘হি ইজ মিস্টার তোফায়েল আহমেদ।’

জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘হু ইজ তোফায়েল? স্টুডেন্ট লিডার তোফায়েল!’ তিনি বললেন, ‘ইয়েস, স্টুডেন্ট লিডার তোফায়েল।’ ইয়াহিয়া খান আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের জন্য কী করতে পারি?’ আমি ইংরেজিতেই উত্তর দিয়ে বলেছিলাম, তবুও তো আপনি এসেছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দুর্গত এলাকায় এসেছেন ঘটনার ১৪ দিন পর। আপনি এখনো নদীতে ভাসমান ও রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের মৃতদেহ দেখতে পাবেন। এই হলো আমাদের বাঙালিদের অবস্থা।

তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন।’ বললাম, আমি কেন ঘোষণা দেব? আপনার কর্মকর্তারা রয়েছেন। আপনি যা দান করবেন তা তাদের বলেন ঘোষণা করতে। তখন প্রবেশনারি অফিসার সাদাত হুসাইন, যিনি পরে কেবিনেট সেক্রেটারি হয়েছিলেন, তিনি একটি জিপের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তানের মহামান্য প্রেসিডেন্ট আপনাদের জন্য ২৫ হাজার টাকা সাহায্য হিসেবে বরাদ্দ করেছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনসাধারণ চিৎকার দিয়ে উঠল-‘না’ ‘না’ ‘না’।

আমি দুই হাত তুলতেই মানুষজন সবাই শান্ত হয়ে গেল। ইয়াহিয়া খান চলে গেলেন। সেনাবাহিনী রিলিফ তৎপরতা আরম্ভ করল। তার পর ভোলায় এলেন ভোলারই কৃতী সন্তান মোকাম্মেল হক। এর পর আনিসুজ্জামান সিএসপি (পূর্ব পাকিস্তানের রিলিফ কমিশনার), সুলতানুজ্জামান খান, (খুলনার কমিশনার)-বরিশাল তখন খুলনার অধীনে-আইয়ুবুর রহমান ছিলেন বরিশালের ডিসি, তিনি এলেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আর্তের সেবা করেছি। মনে পড়ে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যেতাম মানুষ আমাকে ঘিরে ধরত। একবার একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

চকিঘাটায় আমি যখন গেলাম তখন বেলুচ রেজিমেন্ট সেখানে ডিউটি করে। দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার দূররানী। তার অধীনে ওখানে একটি ক্যাম্প স্থাপিত হয়। আমি যখন তাদের স্পিডবোটে উঠি আমাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওই স্পিডবোটের চালককে বেদম প্রহার করে। তখন বেলুচ রেজিমেন্টের সৈনিকরা আমাকে গুলি করতে উদ্যত হলে হাজার হাজার মানুষ দেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সৈনিকদের রুখে দাঁড়ায়।

আমার আসনসহ ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত উপকূলীয় এলাকার জাতীয় পরিষদের ১৭টি আসনে পূর্বঘোষিত ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। অবশ্য সুষ্ঠুভাবে ত্রাণকার্য পরিচালনার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ইতোমধ্যেই জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন পাই। মানুষ আমাকে বুকে টেনে মাথায় তুলে নিত। ভীষণভাবে আদর করত। এই স্মৃতি জীবনে ভোলার নয়। মানুষের জন্য কেউ যদি কিছু করে মানুষ যে তার জন্য কী করতে পারে তা চিন্তা করা যায় না।

আমার নির্বাচন হয় ১৭ জানুয়ারি ’৭১-এ। ৩ জানুয়ারি যে শপথ অনুষ্ঠান হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেখানে আমিও শপথগ্রহণ করি। যদিও তখনো নির্বাচিত হইনি।

স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম যান ভোলা। ’৭০-এ তিনি দেখে এসেছিলেন জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত ভোলা। ১৪ ফুট জলোচ্ছ্বাসে সবই ভেসে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছোট্ট একটি হেলিকপ্টারে করে ভোলা এসেছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সবকিছু স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। আলী মিয়া মাস্টার ছিলেন মনপুরার চেয়ারম্যান। তিনি আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। তার পরিবারে ২৭ জন সদস্য ছিল। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পর দেখা গেল তিনি একাই বেঁচে আছেন আর কেউ-ই নেই। কত প্রিয়মুখ আমি হারিয়েছি।

যার সঙ্গে গতকাল দেখা হলো আজ আর তাকে আমি পাইনি। ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, রামগতি, কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। প্রতিবছর ১২ নভেম্বর যখন ফিরে আসে তখন স্মৃতির পাতায় সেদিনের সেই দিনগুলোর কথা ভেসে ওঠে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি পোস্টার হয়েছিল সোনার বাংলা শ্মশান কেন? এই পোস্টারটিতে ’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের কথাই ব্যক্ত হয়েছিল। দুটি ঘটনা বাংলার মানুষকে পথ দেখিয়েছে। এক. ’৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ। যখন আমরা ছিলাম ‘অরক্ষিত’। আর ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস যখন আমার ছিলাম ‘অসহায়’। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন তার মূল লক্ষ্য ছিল শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেই দায়িত্বটা এখন বর্তেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্কন্ধে। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবছর আগে বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করত, ঘরবাড়ি হারাত। সেসব এখন আর নেই।

ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসনীয়। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার যে ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তা এখন সারা বিশ্বের জন্য মডেল হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আমাদের অনুসরণ-অনুকরণ করতে পারে। বাংলাদেশে এখনো প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়, কিন্তু যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আগে হতো এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলার স্বাধীনতার সফলতা।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী।
[email protected]

 
Electronic Paper