এ জয়ের মাহাত্ম্য মাঠের বাইরেই বেশি
শায়েখ আরেফিন
🕐 ৬:৩৮ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২২

বিশ্বকাপ ফুটবল যাত্রা শুরু করে ১৯৩০ সালে। নারী/মহিলা বিশ্বকাপ ফুটবলের যাত্রা ছ’দশক পরে, ১৯৯১ সালে চীন থেকে। পুরুষদের বিশ্বকাপের আগে নর বা পুরুষ শব্দ বসানোর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু নারীদের বিশ্বকাপের আগে নারী বা মহিলা শব্দ বসাতে হয়। যা হোক, পুরুষতন্ত্রের এই ভাষিক রাজনীতি আজকের বিষয় নয়। চীন-বিশ্বকাপে দল ছিল ১২টি; এশিয়া থেকে অংশ নেয় চীন ছাড়াও এশিয়ার অন্য দুই দেশ জাপান ও চাইনিজ তাইপে। নারী বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসর বসে ’১৯ সালে ফ্রান্সে, যাতে অংশ নেয় দল ২৪টি দল। ’৯১-এর প্রথম বিশ্বকাপ শুরুর পরই বিশ্বে নারী ফুটবল ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হয় ফিফা; সদস্য দেশগুলোকে অনুপ্রাণিত করতে আর্থিক অনুদান দিতে শুরু করে। একপর্যায়ে নারী ফুটবলের চর্চা বাধ্যতামূলক করা হয়।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজন করে নারী ফুটবলের আনুষ্ঠানিক ম্যাচ। ১৯ বছর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটি দল আনা হয় প্রীতিম্যাচ খেলতে। ‘বাফুফে একাদশ’ নামে একটি দল গঠন করার লক্ষ্যে শুরু হয় অনুশীলন। উপস্থিত হয় অনেক বাধা-বিপত্তি। দেশের সবচেয়ে ‘প্রভাবশালী’ মসজিদ ‘বায়তুল মোকাররম’ থেকে শুক্রবার মধ্যাহ্নে বের হয় সশস্ত্র মিছিল; মিছিলের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্রও। তিনটি ম্যাচ হওয়ার কথা থাকলেও প্রবল হুমকি আর বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা স্টেডিয়ামে শেষ ম্যাচটি আর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু দমে যায়নি বাফুফে, দমে যাননি নারীরা। বাফুফে মহিলা উইং গঠন ক'রে ঘরোয়া ফুটবলের আয়োজন করার উদ্যোগ নেয়। ধীরে ধীরে, অনেকটা নিভৃতে গুছিয়ে ওঠে দেশের নারী ফুটবল। বাংলাদেশ এখন শ্রেষ্ঠত্ব দেখাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। বয়সভিত্তিক দলগুলো সাফ ও এএফসির বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জিতে চলেছে। সব বাধা পেরিয়ে দেশের নারী ফুটবল এখন জায়গা করে নিয়েছে অভাবনীয় উচ্চতায়। ফুটবল নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশের নারীরা।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের মাঠের প্রতিপক্ষের চেয়েও প্রবল প্রতিপক্ষ এ সমাজ। পুরুষতন্ত্র সহস্র বছর ধরে ধর্মের আবরণে নারীর ওপর আরোপ করে রেখেছে নানাবিধ ছক-কাঠামো ও অবশ্যমান্য রীতিনীতি। আবহমানকাল ধ'রে অস্তিত্বশীল এসব ধ্যান-ধারণার বেষ্টনী ভেদ করে এই নারীদের এগোতে হয়েছে। মৌলবাদপুষ্ট এ সমাজ চায় বোরকা-হিজাব। পোশাকের কারণে নারীকে বিরূপ, অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত। এমন একটি সমাজে খোলামাঠে জার্সি পরে ফুটবল খেলা নারীদের শুধু লাঞ্চনা-বঞ্চনা-হেয়প্রতিপন্ন হওয়াই নয়, মৃত্যুঝুঁকিও ছিল, এখনো সুপ্ত অবস্থায় তা আছে।
মনে পড়ছে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের কিশোরীদের কথা। ২০১৬ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বে অপরাজিত থেকে ফুটবলাররা (৯ জন ফুটবলার একই স্কুলের) যখন দেশে ফিরে ঢাকা থেকে একটি সাধারণ গাড়িতে চ'ড়ে যাচ্ছিল তাদের গ্রামের বাড়ি কলসিন্দুরে, সেই বাসের মধ্যে অন্য যাত্রীরা তাদের উত্ত্যক্ত করে, আপত্তিকর মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়, একপর্যায়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। ঘটনাটি গণমাধ্যমে আসে। এরপর ওই কিশোরীদের জীবনকাহিনি প্রকাশ করতে থাকে গণমাধ্যম। স্কুলে যেতে বাধা দেওয়া, স্কুল থেকে বহিষ্কার করা, গ্রামে একঘরে করে রাখা, অভিভাবকসহ ছাত্রীদের জুতোপেটা করা ইত্যাদি প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের এই অদম্য ফুটবল দল।
আরও একটি দিক না বললেই নয়, দারিদ্র্যের সাথে স্বাস্থ্যহীনতার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ফুটবলাররা সবাই দারিদ্র্যের সাথে লড়ে বড় হয়েছেন। ফলে খেলোয়াড় হতে হলে যে পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন তাও তারা পাননি। এটিও ছিল মাঠের বাইরে তাদের আরেক সংগ্রাম। সাক্ষাৎকারে এক খেলোয়াড়কে একদিন বলতে শুনেছিলাম, তারা বাড়িতে থাকার চাইতে ক্যাম্পেই বেশি সময় থাকতে চানÑ ক্যাম্পে থাকলে প্রশিক্ষণটাও ভালো হয়, খাবারটাও ভালো পাওয়া যায়।
বিজয়ী এই নারীরা ঘরের কোণে আবদ্ধ থেকে নয়, উন্মুক্ত মাঠে দাপিয়ে, হিজাব-বোরকায় ঢুকে নয়, সংক্ষিপ্ত গেঞ্জি-প্যান্ট পরে, শৃঙ্খল মেনে নয়, শৃঙ্খল ভেঙে, সর্বোপরি, পুরুষতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রকে গ্রহণ করে নয়, অগ্রাহ্য ক'রে অর্জন করেছেন সাফল্য, সম্মান, স্বীকৃতি। যারা নারীর পোশাক নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করে এবং নারীকে বন্দি রাখতে চায় ঘরে, তাদের কাছে এই জার্সি প'রে উন্মুক্ত মাঠে খেলে বিজয়ী হওয়া একপ্রকার চপেটাঘাত, আর ফুটবলে একেকটি লাথি পশ্চাতে লাথি।
মাঠে প্রতিপক্ষ একটি, কিন্তু মাঠের বাইরে এ নারীদের প্রতিপক্ষ একাধিক, পুরোনো ও অধিকতর শক্তিশালী। তাই মাঠের জয় নিখাঁদ আনন্দের, আর মাঠের বাইরের জয় আনন্দের, প্রশান্তির, গুরুত্ববহ, মাহাত্ম্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। সাফ জয়ী ফুটবলারদের প্রাণঢালা অভিনন্দন!
লেখক : সমালোচক ও বিশ্লেষক
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
