ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর ২০২৪ | ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পরাণ : সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি

চামেলী খাতুন
🕐 ৮:২৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৭, ২০২২

পরাণ : সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি

মানবমন অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির; মন কখন কী চায় বলা দুরূহ; তবুও কিছু ক্ষেত্রে মানুষ খুব বোকামিতে পূর্ণ এবং সরল সমীকরণে প্রবাহমান। সেটা হল প্রেম ও নেশা। দুটোই মারাত্মক এবং ক্ষণস্থায়ী। পারিপার্শ্বিক এবং ব্যক্তিগত অবস্থার প্রেক্ষিতে মানুষ নেশায় আসক্তি আনে এবং সেখান থেকে বেরও হতে চায়; একইভাবে বাছবিচারহীন প্রেমের টানে নিজের অবস্থান ভুলে যায়; কিন্তু এ দুটোর অবস্থান বড্ড অপরিণামদর্শী এবং ভঙ্গুর মানদণ্ডে লিপ্ত।

যেখানে অন্তরের সাথে অন্তরের মিলন সেখানে প্রকৃত অনুভূতি বোঝা মুশকিল। যেকোনো একদিকে হিসেবের গড়মিল হলে সম্পর্ক ক্ষয়ে যায়, তার মৃত্যু হয়, এজন্য প্রেমের সম্পর্ক কূল হারায়, সেখানে ফাটল ধরে, তার রূপান্তর ঘটে। মানুষ মূলত নেশা ধরে অন্য আসক্তি থেকে মুক্ত হতে। সেই আসক্তিতে ঘাটতি জাগলে সেটা আর আগের মতো নেশা জাগায় না। অতএব, ইচ্ছে করলেই এই দুটো অভ্যাস ছাড়ানো যায় কিংবা ছেড়ে যায়। বর্তমান যুবসমাজের একটা অংশ অবুঝ ভালোবাসার নেশায় মত্ত; নেশার ঘোরে তারা প্রেম খোঁজে। এ ঘর থেকে ওঘর কিংবা এই হৃদয় থেকে ঐ হৃদয়ে! আসলেই কী তারা প্রেম খুঁজে পায়? আসলেই কী তারা ভরসার আশ্রয়স্থলে পৌঁছতে পারে?

বিন্দু মাত্রও দ্বিধা রেখে কোনো সম্পর্কে জড়ানো ঠিক না। তাহলে পড়ন্ত বিকেলে একমুঠো আলো-ছায়ার খেলায় সে সম্পর্ক হাঁপিয়ে ওঠে। তখন জীবন বিপন্ন হয়, বিপর্যস্ত হয় সমাজ সংসার। আবার সেখান থেকে মুক্ত হতে তড়িঘড়ি করে মানসিক কষ্ট লাঘবে অন্য সম্পর্কে জড়িত হওয়াও অসুস্থ অনুভূতি এনে দেয়। ভীষণ অবসন্নতা ভর করে যাপিত জীবনে। সেই সম্পর্ক থেকে বের হতে সে আবার ভুল করে বা ভুল হতে থাকে কিংবা পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে।

‘পরাণ’ সিনেমাটি দেখলাম। ভালো লাগলো এই ভেবে যে মোটামুটি সব শ্রেণির মানুষকে হলমুখী করেছে মুভিটা। এখানে সমাজের একটা চরম নৃশংসতা কিন্তু অতি বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত জীবনে সমস্যার অন্ত নেই। যেখানে অনন্যার মতো দেখতে সুন্দরী কন্যা তাদের পরিবারে সংকটের কারণ। আর শিকড়হীন মানবসন্তান, যাদের জীবনে কোনো পিছুটান নেই তারা যেকোনো অপকর্মে লিপ্ত হতে পারে। রোমান, লিংকন, তোজোরা তারই প্রতিচ্ছবি। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনন্যার পিতা-মাতা অসহায়; সমাজ, প্রশাসন তাদের সমস্যা শুনতে চায়নি; তার সমাধানে এগিয়ে আসেনি।

দুর্বল আইনের শাসন, সমাজে ডেইজি সরকাররা সামাজিক কর্মকাণ্ড, মানবকল্যাণের নামে নিজেদের স্বার্থে নেশায় আসক্ত করে ফেলে এক শ্রেণির যুবসম্প্রদায়কে। নেশায় মত্ত হয়ে তারা এমন কোনো মন্দ কাজ নেই, যা তারা করে না। এভাবে গডফাদারদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে জীবন বলি দেয় রোমানরা। ওরা সামাজিক হতে গেলে, সুস্থ জীবন গড়তে চাইলেই যত বিপত্তি ঘটে।

অনন্যাকে ঝোঁকের মাথায় ভালোবেসেছে রোমান। ঝোঁক এইজন্য বলবো যে, রোমানরা নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারে না; সমাজ-সংসারে তাদের জায়গা কোথায় এটা না জেনেই শুধু মনের জোর, পেশিশক্তি দ্বারা সবকিছু জয় করতে চাই। আর পরিবারের মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা পূর্ণ করতে উচ্চাভিলাষী অনন্যার মতো নারী ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়, আবার সিফাতের মতো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, মেধাবী ছেলেদের কব্জা করে সুখী সংসার পাততে চায়। বন্ধুবাৎসল হয়েও তোজো লোভ-লালসার বশবতী হয়ে রোমানকে খুন করতে দ্বিধা করে না।

আর তাদের জীবনে এই সংকট নিয়ে এসেছে ক্ষমতাধরেরা; বিষিয়ে ফেলেছে দ্বিধাগ্রস্ত সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মেরুকরণে। তারা সেজন্য লোভে পড়ে,তারা সুযোগ নিতে যায় এবং তারই ধারাবাহিকতায় প্রচণ্ড ভুলের সাগরে পা রাখে।অনন্যা নামের মেয়েটির কী করা উচিত ছিল তা এখানে বড় কথা নয়; পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, প্রশাসন তাকে কোন দিকে ধাবিত হতে বাধ্য করল সেটাই বড় কথা।

অতএব, ‘পরাণ’ ছবিটি আমাদের চারপাশের বিভ্রান্ত যুবসমাজের প্রতিচ্ছবি। এখানে প্রত্যেকটি চরিত্রই পরিস্থিতির শিকার! ঘটনার আবর্তনে ঘটনার জন্ম হয়েছে। কাহিনীর সূত্র ধরে এখানে গল্প আছে, অনুধাবনের সিঁড়ি আছে; অন্তরালে ছবিটি চিন্তার খোরাক যোগাবে আশা করি।

লেখক : কবি

 
Electronic Paper