ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘দিন : দ্য ডে’ : বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের উত্তরণ

হারুন পাশা
🕐 ৭:৫৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২২

‘দিন : দ্য ডে’ : বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের উত্তরণ

বাংলাদেশি চলচ্চিত্র বনাম ‘দিন : দ্য ডে’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। দুই সময়খণ্ডে সেসব উল্লেখ করা গেলে দাঁড়ায় : ১৯৭২-২০০০ এবং ২০০০-২০২১। ১৯৭২-২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে বিষয় হিসেবে জায়গা পেয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক অনুষঙ্গ, প্রেম এবং কখনও মুক্তিযুদ্ধ। আরেকটু ভেঙে বললে যৌথ পরিবারের ভেতরে থাকা সম্পর্ক, ভাঙন, ছোটো-বড়োর শ্রদ্ধা, স্নেহ, পরিবারের সদস্যদের ডেডিকেশন। মাঝপথে হুমায়ূন ফরিদী, রাজিব, সাদেক বাচ্চু, এটিএম শামসুজ্জামান, নাসির খান বা রীণা খানের কূটনামিতে দর্শকের খারাপ লাগলেও দিলদার কিংবা টেলি সামাদ ওই সময়টুকুতে হাসিয়ে আমাদের মন ভালো করে দিত। সিনিয়র অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন রাজ্জাক, আনোয়ার, আলমগীর, জসীম প্রমুখ।

সালমানশাহর মৃত্যুর পর রিয়াজ ও শাকিল খানকে দিয়ে প্রেমপ্রধান চলচ্চিত্র নির্মাণে পরিচালকগণ মনোযোগী হন। মান্না এবং রুবেল অভিনয় করতে থাকেন এ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রে। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দর্শক সিনেমা দেখেছে আনন্দের সাথে। সিনেমা হল ছিল দর্শকে ভরপুর। টিকিটের টাকা জোগাড়ের জন্য কেউ কেউ চুপ করে সুপারি বিক্রি করেছে। আবার কেউ কেউ নিজের খোঁয়াড় থেকে হাঁস-মুরগি চুপ করে বিক্রি করে হলে সিনেমা দেখতে গেছে। বাস্তবতা থেকে এই উদাহরণ নেওয়ার কারণ হলো সিনেমা দেখার ঝোঁক বোঝানো। এরকম উন্মাদনা ছিল দর্শকের মাঝে।

এরপর ২০০০-২০২১ পর্যন্ত এক দীর্ঘ গ্যাপ। এই সময়খণ্ডে দর্শক সিনেমা হল থেকে গন্তব্য ফেরাতে থাকে। গ্রামে গ্রামে ডিসলাইন ঢুকে যাওয়া আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা সিনেমা হলেও প্রভাব পড়তে থাকে। তাছাড়া আমাদের সিনেমাগুলো তখন দেখার উপযোগী ছিল না। সিনেমার নিম্নমানের স্ক্রিপ্ট বা গল্প, নগ্নতা আর অশ্লীলতা, কাটপিস ঢুকানো দর্শককে টানতে পারেনি। এ সময় সিনেমায় ধর্ষণের দৃশ্য ছিল মাত্রাতিরিক্ত। এর মাঝে কিছু কোয়ালিটিফুল সিনেমা তৈরি হলেও তা ছিল না আপামর জনতার সাধ আর সাধ্যের অনুকূলে। বেশিরভাগ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

‘২০২২’ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বছর। কেননা এ বছরে হলগুলোয় আবারও দর্শক ফিরেছে। তারা সিনেমা দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। দর্শকের মাঝে আগ্রহ জন্মাতে ‘দিন : দ্য ডে’-র ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বড়ো বাজেট, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, ভালো গল্প, চমৎকার দৃশ্যায়ন-সহ প্রচারণার কারণে সিনেমা মুক্তির আগেই দর্শকদের কৌতূহলী করেছিল। মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহেও হলগুলোয় চলেছে এই চলচ্চিত্র। পারিবারিক আর সামাজিক অনুষঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে দেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ধারণ করে নির্মিত হয়েছে ‘দিন : দ্য ডে’। এ সময় ‘পরাণ’ বা ‘হাওয়া’ সিনেমা রিলিজ হলে দর্শক এ মুভি দুটিও হলে গিয়ে দেখেন। প্রণোদনার নেপথ্যে থেকে গেছে ‘দিন : দ্য ডে’। বাংলাদেশের মানুষ সিনেমা দেখতে চায়। তারা সিনেমাপ্রেমী। তাদের চাওয়াটাকেই জয় করেছে ‘দিন : দ্য ডে’। যার গল্প মৌলিক আর সামষ্টিক কল্যাণের।

দেশপ্রেম ও ‘দিন : দ্য ডে’: এই চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইতিবাচকতায়। ইন্ডিয়ান চলচ্চিত্রগুলোয় যেমন নিজ দেশের সাফল্য বা কীর্তি প্রকাশ পায় ‘দিন : দ্য ডে’-তেও এরকমটাই এসেছে। যা এর আগে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। এটা নতুন সংযোজন। ছবির শেষ দৃশ্যে খলনায়ক খালেদ যখন বলে বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ আর গুগলে সার্চ করলে খুঁজে পাওয়া যায় না তখন নায়ক এজে যে উত্তর দেয় তাতে কিংবা পুরো চলচ্চিত্রেই দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সঙ্গে নিজ দেশকেও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এজের একটা সংলাপ এরকম ‘বাংলাদেশ আয়তনে ছোটো হতে পারে, বাংলাদেশের বুকে অনেক জায়গা’, ...‘বাংলাদেশ মানুষকে ভালোবাসে...’।

‘দিন : দ্য ডে’-তে সামষ্টিক বা বৃহৎ চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। এ চলচ্চিত্রের কাহিনি সস্তা প্রেম কিংবা ক্লিশে জীবনবাস্তবতায় ঘুরপাক খায়নি যা সচরাচর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে দেখা যায়। চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করেছে ‘দিন : দ্য ডে’। এ সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে ইন্টারপোল ধারণারও সংযোজন ঘটলো। এজে ইন্টারপোলের সহযোগিতায় ক্রিমিনাল ধরতে আফগানিস্তান যায়।

‘দিন : দ্য ডে’ : দৃশ্যায়ন ও ফ্ল্যাশব্যাক: ‘দিন : দ্য ডে’র চিত্রায়ণে রয়েছে বাংলাদেশ-সহ ইরান, তুরস্ক আর আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশের দৃশ্য। সিনেমায় থাকা সমুদ্র আর প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন অংশের উপস্থাপন মুগ্ধকর। সিনেমার সুবাদে এই দেশগুলো দর্শকের দেখার সুযোগ হয়ে যায়।

সিনেমা চলতে চলতে কাহিনি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় জাম্প করে ফেললে ফ্ল্যাশব্যাকে পরিষ্কার করা হয়েছে। ফলে কাহিনির সংকট তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি খুব বেশি ঘটেনি। এখানে বলে রাখি এ সিনেমায় অভিনয় করেছে বাংলাদেশ, ইরান ও লেবাননের আর্টিস্টরা।

পেশাগত ভাবনা ও ‘দিন : দ্য ডে’: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দেখানো নায়কদের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশি থাকে না। নায়ক হয় কলেজে পড়ে, না-হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। দর্শকের চিন্তার জায়গা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাদের দৌড় পৌঁছায় না। কোনো কিছু ছোটো করার জন্য এ প্রসঙ্গ টানছি না। বাস্তবতা আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। কেননা সিনেমা বা নাটক মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব চিন্তাগত, আচরণগত, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা কিংবা সংকীর্ণতার।

এর আগের চলচ্চিত্রগুলোর কোনো কোনোটাতে দেখা গেছে বাড়িতে আর্থিক অনটন নিয়ে ঝগড়া হলে পরিবারে ছোটো ছেলে চাকরি খুঁজতে বেরুত। আমরা দেখতাম সে যেসব প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে চাকরি খুঁজতে সেসব প্রতিষ্ঠানের গেটে লেখা ‘কর্ম খালি নাই’। সেসব প্রতিষ্ঠান থাকত কোনো না কোনো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। নায়ক যে চাকরি খুঁজতে যায় তা চতুর্থ শ্রেণির। স্টাটিং বেতন পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। প্রথম শ্রেণির কোনো চাকরির খোঁজ দেখানো হয় না। নায়ক প্রথম শ্রেণির চাকরি করে না। কোনো পেশাকেই ছোটো করছি না, বলছি কেবল আমাদের চিন্তা আর প্রকাশের সর্বোচ্চটার কথা।

‘দিন : দ্য ডে’- তে আমরা দেখতে পাই নায়ক এজে পুলিশের চাকরি করছে। তার ডিপার্টমেন্ট সোয়াট। এজে আন্তর্জাতিক সংস্থার পুলিশ অফিসার হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসগোষ্ঠি দমন করতে অভিযানে অংশ নেয়। দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। যা বাংলাদেশের অন্য চলচ্চিত্রের নায়কদের থেকে ভিন্ন পেশাগত দিক থেকে। যেখান থেকে দর্শক পেশাগত ভাবনায় অনুপ্রেরণা পাবে।

বাংলাদেশি সিনেমার দর্শক ও ‘দিন : দ্য ডে’: গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দর্শক ছিল গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক কিংবা দোকানদাররা। নিম্নমানের চলচ্চিত্র দিয়ে নিম্নশ্রেণির দর্শক টানাই চলচ্চিত্রগুলোর উদ্দেশ্য ছিল। সর্বশ্রেণির দেখার উপযোগী ছিল না। ‘দিন : দ্য ডে’ এই দূরদর্শা কাটিয়েছে। এই চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর উচ্চপদস্থ থেকে নিম্নপদস্থ সবাই দেখেছে। সর্বশ্রেণির দর্শকের উপযোগী করে যে সিনেমা নির্মাণ করা যেতে পারে তা দেখালো ‘দিন : দ্য ডে’।

‘দিন : দ্য ডে’-র ট্রেইলার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ফেসবুকে বাংলা শব্দের সঙ্গে ইংরেজি শব্দ যোগ করে পোস্ট ও ছবির ক্যাপশন দিতে দেখেছি। একটা চলচ্চিত্রের নাম যে ফেসবুকারদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা দেখা গেল ‘দিন : দ্য ডে’-র ক্ষেত্রে। নামটা তারা মন আর মগজে ভালোভাবেই রপ্ত করেছে।

‘দিন : দ্য ডে’-র দর্শন; বেঈমান বা বিশ্বাস সঘাতকের জায়গা নাই এই দর্শনই ‘দিন : দ্য ডে’-তে প্রকাশ পেয়েছে। এজে আবু খালেদকে ধরার জন্য মাজদির ছেলেকে সঙ্গে করে খালেদকে ধরতে যায় সেখানে মাজদির ছেলের প্রেমিকা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের লোকেশন আবু খালেদকে জানিয়ে দেয়। অর্থের কাছে সে সম্পর্ক আর বিশ্বাসকে বিক্রি করে দিয়েছিল। কিন্তু খালেদ তাকে অর্থ না দিয়ে লোকজন লাগিয়ে মেরে ফেলে। সিনেমায় আরও যারা বিশ্বাস ভেঙেছে তাদের প্রত্যেককে মরতে হয়েছে কোনো প্রকার প্রাপ্তি ছাড়াই।

সন্ত্রাসীদের কাছে বন্ধুত্ব আর নৈতিকতার কোনো মূল্য নেই, মূল্য আছে স্বার্থ এবং পুঁজির। এ দর্শনও প্রকাশিত। আবু খালেদ তার দীর্ঘদিনের বন্ধু মাজদিকে মরে ফেলে বিপদ আসন্ন জেনে ও নিজের স্বার্থ উদ্ধারে। অথচ মাজদি বিশ^াস রেখেছিল যে তার বন্ধু তাকে উদ্ধার করবে। ফলাফল হয়েছে উলটো।

দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্য: পত্রিকা থেকে জেনেছি অনন্ত জলিল যৌথ প্রযোজনার এ সিনেমাটি বাংলাদেশের অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার এ আমন্ত্রণে শিল্পীরা সাড়া দেয়নি। কেউ কেউ বলেছেন তাদের দাওয়াত দেয়নি, অনন্ত মিথ্যাচার করেছে। আবার অনন্ত জলিল বলেছে তিনি মিথ্যা বলেননি।

তাদের হিসাব-নিকাশ হয়তো ভিন্ন ভিন্ন তাই আসেননি দেখতে ‘দিন : দ্য ডে’। এ সিনেমা না দেখা তাদের জন্যই দুর্ভাগ্য। কেননা উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে রয়েছে সিনেমায় নতুনত্ব। বাংলাদেশির প্রচলিত সিনেমা থেকে এটি একদমই আলাদা যা উপরে উল্লেখ করেছি। এই সিনেমা দেখলে নতুন বিষয় আর কৌশলে সিনেমা বানানোর ধারণা যেমন পরিচালক পেতেন তেমনি অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও জানতেন কীভাবে নিজেদের বদলাতে হয়। অনন্ত জলিল আর বর্ষা পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী নয়। তাদের অভিনয়ে দুর্বলতা আছে। উচ্চারণে সামান্য প্রবলেম আছে। এসব মেনে নিলেও নতুন কিছু করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে অনন্ত এবং বর্ষা। আপনাদের এত ভালো অভিনয় তারপরও তো সিনেমাকে মুক্তি দিতে পারছেন না পুরোনো ফ্রেম থেকে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ধরে একই রীতিতে নির্মাণ করে আসছেন কাহিনি। সস্তা প্রেম আর সেকেলে ও একই জীবনবাস্তবতায় আটকিয়ে রেখেছেন সিনেমার গল্প। যা এখন অচল। সচল কিছু করেন বৃহৎ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। সচলতা ও সামর্থ্যরে কথা বলেছে ‘দিন : দ্য ডে’। সমাপ্ত বাক্যে বলব, বাংলাদেশও যে পারে উঁচুমানের সিনেমা তৈরি করতে তা দেখালেন অনন্ত জলিল এবং বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের উত্তরণ লক্ষণীয় ‘দিন : দ্য ডে’-তে।

লেখক : সাহিত্যিক ও সম্পাদক

 
Electronic Paper