ঢাকা, শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৮ আশ্বিন ১৪৩০

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
🕐 ১:১৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ০৭, ২০২২

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় লিখেছিলেন ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবনী বিশ্লেষণে জাতীয় কবির এই কবিতার যথার্থ প্রতিফলন আমরা পাই।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রেষ্টতম অর্জন হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর এসব লাড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলনের নেপথ্যের প্রেরণাদাত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবন ছায়ার মতো অনুসরণ করে তার প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অফুরাণ প্রেরণার উৎস হয়েছিলেন বাংলার মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার ডাকনাম ছিলো রেনু। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। এক ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাংলার মানুষের কাছে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো বটেই বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবনে ছায়ার মতো পাশে ছিলেন তিনি। সে কারণেই একটি জাতির মনে স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বপন করে এর স্বাদও এনে দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পেছন থেকে কাজ করেছেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ যেন একই সূত্রে গাঁথা, তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো আলোচনা হলেই স্বাভাবিকভাবে সেখানে বঙ্গমাতার প্রসঙ্গ চলে আসে। পরিবারিক সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যে নারীর অবদান অনস্বীকার্য তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু বার বার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দি জীবনযাপন করেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন।

বিশেষ করে আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কিছু কুচক্রীমহল স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল। তখন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বেগম মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্থান বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যেও ছিল তার সঠিক দিকনির্দেশনা। আন্দোলনের উত্তম সময়গুলোতে নিজ বাড়িতে পরম মমতায় নির্যাতিত নেতাকর্মীর আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ন করতেন, সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে ব্যবস্থা নিতেন। আশাহত নেতাকর্মীরা খুঁজে পেতেন আশার আলো, আন্দোলনের জ্বালানি আসত বেগম মুজিবের আশাজাগানিয়া বক্তব্য থেকে। শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন তিনি।

মায়ের স্মৃতিচারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আর্জন হয়, তার পেছনে প্রেরণা দেওয়ার কেউ না কেউ থাকেন। তা না হলে কখনো কোনো নেতাই সফলকাম হতে পারেন না। ঠিক তেমনি আমার বাবার রাজনীতির পেছনে আমার মায়ের বিশাল অবদান রয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে আমার মা দৃঢ়চেতা ছিলেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার মা ছিলেন গেরিলা। বাবা কারাগারে থাকা অবস্থায় গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাবার নির্দেশনায় নেতাকর্মীদের কাছে খবর পৌঁছে দিতেন। যা কোনো দিন ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা জানতে পারেনি। তার মানে আমার মা ছিলেন আসল গেরিলা।’

বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিজেকে এবং নিজের সন্তানদের গড়ে তোলেন। শুধু সহধর্মিনী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী ছিলেন বেগম মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে জীবন দিতে হয় বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সকল সদস্যকে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ে একটা কনভেনশন হলের নামকরণ করা হয়েছে। যা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন পেয়েছে। যার নাম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন সেন্টার। যেখানে বর্তমানে ফিল্ড হাসপাতালের কাজ চলমান। বর্তমান উপাচার্য হিসেবে বঙ্গমাতার নামে একটা কনভেনশন হলের নামকরণ করার প্রস্তাব করতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলার জনগণ তাকে ‘বঙ্গমাতা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহীয়সী এ নারীর জন্মদিনে তার প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

 
Electronic Paper