‘উল্টোপথে’ রেল?
নাজমুস সালেহী
🕐 ১০:৩০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৩, ২০২২
কয়েক বছর পর পর বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি করে টাইম টেবিল তৈরি করে। এই টাইম টেবিল হলো ট্রেন পরিচালনার গাইড লাইন। একটা ট্রেন যাত্রা থেকে শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত কয়টি রেলস্টেশনে থামবে। কোন সেকশনে ট্রেন কত মাইল বেগে চালাতে হবে, শেষ গন্তব্যে যাত্রা শুরুর কত ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে, এসব নির্দিষ্ট করে লেখা থাকে টাইম টেবিলে। এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনের দূরত্ব কত কিলোমিটার এই পথটুকু কত ঘণ্টায় যেতে হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া থাকে এই গাইড লাইনে।
প্রত্যেক এল এম (লোক মাস্টার) বা ট্রেন চালকরা এসব মেনে চলতে বাধ্য। এর কোন রকম ব্যত্যয় হলে ট্রেন চালকদের শাস্তির বিধান আছে। এখন থেকে ১০ বছর আগে তৈরিকৃত বাংলাদেশ রেলওয়ের ৪৭তম টাইম টেবিল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়া যেত মাত্র সাড়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে। একই ভাবে রাজশাহী যাওয়া যেত সাড়ে ৫ ঘণ্টা থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে। আবার খুলনায় যেতে সময় লাগত সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত যেতে সময় লাগত সাড়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। এগুলো রেলের ২০১১ সালে বানানো ট্রেন পরিচালন গাইড টাইম টেবিল পর্যালোচনা করে বলছি। ২০১১ থেকে এবার ফিরে আসি ২০২২ সালে। প্রায় ১ যুগ। বর্তমানে ট্রেন পরিচালিত হচ্ছে ৫২তম টাইম টেবিল অনুযায়ী। যা তৈরি করা হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। ২০২০ সালের টাইম টেবিলে চালকদের নতুন যে নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ট্রেনের গতি কমেছে।
অর্থাৎ ১০ বছর আগে যেখানে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ যেতে সময় লাগত সাড়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা এখন সময় লাগে সাড়ে ৭ থেকে প্রায় ৮ ঘণ্টা। মানে এপথে এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় বেড়েছে। একই ভাবে সিলেট, চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী সব রুটেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা করে বেড়েছে যাত্রা টাইম। নতুন টাইম টেবিলে রেলের কর্মকর্তারাই বাড়িয়েছেন ট্রেনের যাত্রা সময়, মানে ট্রেনের গতি কমিয়ে ট্রেন চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ট্রেনচালকদের। কোনো কোনো রুটে কমেছেও ট্রেনের রানিং টাইম। তবে তা মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিট।
কী আশ্চর্য! এক যুগ আগে যে গতিতে চলতো ট্রেন তা আরও কমল। অথচ এই এক যুগই রেলের জন্য স্বর্ণালি সময়। এই সময়েই রেলের উন্নয়ন হয়েছে সব চেয়ে বেশি। বলা যায়, এই ১২ বছর রেলের নব যৌবন। কেননা স্বাধীনতার পর টানা ৪০ বছর রেল ছিল সবচেয়ে অবহেলিত প্রতিষ্ঠান। কোনো সরকারই রেলের দিকে ঘুরে তাকায়নি। রেলের লোকসানের পাল্লা ভারি হয়ে যাওয়ায় বিএনপি সরকারের আমলে এক সাথে ১০ হাজার রেল কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দেয়া হয়। এসময় একেবারেই হুমকির মুখে পড়ে রেল। তখন নানা মহলের আলোচনা সমালোচনায় রেলকে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়ার একটা পরিকল্পনা চলমান ছিল। সে সময় রেলে বিনিয়োগকে লোকসান হিসেবে বিবেচনা করে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। দীর্ঘ দিন কোনো বরাদ্দ না থাকায় একেবারেই ধ্বংস হয়ে পড়ে রেল। আইসিইউতে থাকা রেলকে টেনে তুলতে এগিয়ে আসে আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন করে শুরু হয় রেলের অগ্রযাত্রা।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে বের করে আলাদাভাবে গঠন করা হয় রেল মন্ত্রণালয়। পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের পর ২০১১-১২ অর্থবছরে পরিচালন খাতে বরাদ্দ ছিল এক হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। ৫ শতাংশ বেড়ে পরের বছর তা হয় এক হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এর পর বাড়ে ১৩ দশমিক ২৯ শতাংশ। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ৭১ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ৭৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ৯৮ দশমিক ৬২ শতাংশ, ১২২ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং ১৩৫ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৭৯ কোটি ৯০ লাখ টাকায়। আর উন্নয়ন খাতে ২০১১-১২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল দুই হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। বাড়তে বাড়তে রেলের বরাদ্দ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে রেলকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। মানে প্রতি বছরই উন্নয়ন কিংবা পরিচালন দুই ক্ষেত্রেই রেলের বরাদ্দ বাড়ছে বহুগুনে। রেলের হিসাব বলছে গত ১০ বছরে রেলের উন্নয়নে খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর রেলে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ চলছে ৪২টি উন্নয়ন প্রকল্প, যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। বিপুলপরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে, আবার উন্নয়নে খরচ হয়েছে বিশাল অঙ্কের টাকা।
আবার ফিরে আসি টাইম টেবিল প্রসঙ্গে এক যুগে এত বিনিয়োগের পরও কেন গতি বাড়ল না ট্রেনের? কেন নতুন সময় বাড়ল গন্তব্যে যাওয়ার। বিনিয়োগের সুফল কোথায়? এখনও তো ট্রেনের ছাদেই দেখি মানুষ। ট্রেনের ভেতর তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। এখনও টিকিট কেটেও আসন পর্যন্ত ভিড়ের কারণে যেতে পারে না মানুষ। এখনও ট্রেনের জন্য ঘèার পর ঘণ্টা প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। এখনও টিকিটের জন্য হাহাকার। তাহলে এত টাকা বিনিয়োগের ফল কী? যাত্রীসেবার মানও তো বাড়েনি। সব ট্রেনই ময়লা অপরিচ্ছন্ন, স্যানিটেশনের অবস্থাতো আরও খারাপ। এত টাকা বিনিয়োগের মূল লক্ষ্যই তো যাত্রীদের ভোগান্তি কমিয়ে কম সময়ে স্বাচ্ছন্দ্যময় যাত্রা। এগুলোর একটাও তো হয়নি, বরং বেড়েছে বহুগুণ। যাত্রী হয়নি আর যাত্রা বিলম্ব কিংবা শিডিউল বিপর্যয়ে ভয়াবহ অবস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ের। তাহলে বিনিয়োগের বিপুল অর্থ কোথায় গেল? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন মিলিয়ে নিই কিছু হিসাব নিকাশ।
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রেলের ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি, বর্তমানে তা কমে হয়েছে ২৬৩টি। মোট ইঞ্জিনের ৮০ শতাংশেরই মেয়াদ পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। মেয়াদোত্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ ইঞ্জিন দিয়েই চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ১৯৬৯-৭০ সালে রেলের যাত্রীবাহী বগি ছিল ১৬৪৩টি, বর্তমানে তার সংখ্যা ১৭৬৪টি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বগি বেড়েছে মাত্র ১২১টি। সেই সময় জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি, আর বর্তমানে ছাড়িয়েছে ১৮ কোটি। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ বাড়লেও বগি বেড়েছে মাত্র ১২১টি। ১৯৭০-৭১ সালে রেলেপথ ছিল সারাদেশে মোট ২৮৫৮ কিলোমিটার। বর্তমানে দেশে মোট রেলপথ রয়েছে ৩০১৮ কিলোমিটার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে রেললাইন বেড়েছে মাত্র ১৬০ কিলোমিটার। মোট রেললাইনের প্রায় ৫০ শতাংশ লাইনই মিটারগেজ। আর ৭০ শতাংশ লাইনই সিঙ্গেল। বিদ্যমান রেললাইনের ৬৩ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ, আর টিকে থাকা রেল সেতুগুলোর ৯০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব লাইন ও সেতুর উপর দিয়ে চালকদের ট্রেন চালাতে হয় সর্বোচ্চ ৩০-৪০ কিলোমিটার গতিতে। কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ গতিবেগ মাত্র ২০ কিলোমিটার। এত বিনিয়োগের পরও এই অবস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ের। বিপুল বিনিয়োগ হলেও তা হয়েছে পরিকল্পনাহীন, ফলে তার সুফল এখনও পাওয়া যাচ্ছে না।
হয়ত সুদুর ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে এসব বিনিয়োগের সুফল। তবে যাত্রী চাহিদার কথা মাথায় রেখে হচ্ছে না বিনিয়োগ, ফলে বাড়ছে না রেলের সেবা। নাম সর্বস্ব লোক দেখানো প্রকল্পই যেন রেলের প্রবণতা। সমস্যা সমাধানের পথে না হেঁটে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত জটে আটকে যাচ্ছে রেল। তাইতো বিনিয়োগের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেলের লোকসানের পাল্লাও। প্রতিবছরই বাড়ছে রেলের লোকসানের পাল্লা। ১০ বছরে এত বিনিয়োগের পরও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির গড় লোকসান প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। কারণ হলো বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেই টাকা ফেরত আসছে না। কারণ বেশিরভাগ উন্নয়নই কাজে লাগছে না জনগণের। কী প্রয়োজন তা ঠিক না করেই যেন এলোমেলো মেজাজে চলছে রেলওয়ে। ফলে আসছে না কাক্সিক্ষত সুফল। এই মুহূর্তে রেলের দরকার প্রচুর সংখ্যক নতুন বগি ও ইঞ্জিন।
কারণ আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ ইঞ্জিনের অভাবে দ্রুত চালানো যাচ্ছে না ট্রেন। আবার বগির অভাবে বাড়ছে না নতুন ট্রেনের সংখ্যা, ফলে সামান্যসংখ্যক ট্রেনই চলছে। জনসংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে নেই ট্রেন, ফলে মিটছে না বর্ধিত যাত্রীর চাহিদা। তাই টিকিটের সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। ভিড় বাড়ছে কাউন্টারের সামনে। চাহিদার তুলনায় অল্প ট্রেন বাকি লোক তাই বাধ্য হয়েই উঠছে ট্রেনে ছাদে। অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে গাদাগাদি করেই চলছে ট্রেন যাত্রা। এই মুহূর্তে ইঞ্জিন আর বাগি বাড়লেই তো যাত্রীদের চাহিদার যোগান হয়ে যায়। তাইনা? মনে করেন, বগিও বাড়ানো হলো কেনা হলো পর্যাপ্ত ইঞ্জিনও। এতে বাড়ল নতুন ট্রেনের সংখ্যা। কিন্তু এই বাড়তি নতুন ট্রেনটি পরিচালনা করার সক্ষমতা কি আছে রেলের? নাই।
কেননা আগেই বলা হয়েছে আমাদের বেশিরভাগ রেল লাইনই মিটার গেজ ও সিঙ্গেল লাইন। মিটারগেজ একটি মাত্র লাইন হওয়ায় একটি ট্রেনকে থামিয়ে অন্যটিকে চলাচলের সুযোগ দিয়ে চলতে হয় আমাদের। নতুন করে ট্রেন চালাতে গেলে তখন প্রতিটি ট্রেনের সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় বাড়বে, মানে সব ট্রেনই তখন গন্তব্যে যাবে দেরিতে। তাহলে বগি বাড়িয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। যদি পাশাপাশি দু’টি লাইন করার উদ্যোগ না নেয়া হয়। পাশাপাশি দু’টি লাইন হলে একটি ট্রেন যাবে অন্যটি আসবে, কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করবে না। এতে মিলবে কাক্সিক্ষত সুফল। আবার ইঞ্জিন নতুন কিনেও তো লাভ হচ্ছে না, কেননা লাইনের অধিকাংশ আর রেলসেতুর বেশির ভাগই নড়বড়ে আর নাজুক। এমন লাইনে নতুন ইঞ্জিন তো ফুল গতিতে চলতে পারবে না। যেমন হয়েছে সদ্য আমদানি করা ৩০টি ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে। উন্নত ইঞ্জিনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার হলেও চালানো হচ্ছে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে। কেননা নাজুক রেললাইনে এর চেয়ে বেশি গতিতে চালানো যাচ্ছে না। তাহলে দরকার রেললাইন সংস্কার। পুরানো গুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ।
এসবের প্রতি খুব একটা গুরুত্ব নেই রেলের। তাইতো ১০ বছরে বিপুল বিনিয়োগ হলেও এর সুফল পাচ্ছে না জনগণ। যখন যেটা দরকার তেমন পরিকল্পনা না নিয়ে রেল চলছে ভিন্ন পথে। নানা রকম বিলাসী প্রকল্প রেলের বিনিয়োগের পাল্লাকে ভারি করছে বটে কিন্ত তা যাত্রীবান্ধব হচ্ছে না। ডিজেল চালিত ট্রেনই আমরা ভালোভাবে চালাতে পারি না, সেই সময় ভাবছি বুলেট ট্রেনের কথা। বুলেট ট্রেনের মতো একটা অবাস্তব প্রকল্প নিয়ে শুধু এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়েই নষ্ট করা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। অথচ এই মুহূর্তে বগির সংকটে ট্রেনের মধ্যে ভিড়ে ভোগান্তির শিকার যাত্রীরা।
বগি না কিনে অহেতুক খরচ বাড়ানো হচ্ছে ডিজিটাল ওয়াশিং প্ল্যান্ট বানিয়ে যা সেবাও দিতে পারছে না ঠিকমতো। নতুন কোচ কেনার চেয়ে অচল ডেমু ট্রেনকে সারিয়ে তোলার নামে খরচের দিকে নজর বেশি তাদের। ৪৭ হাজার জনবল ঘাটতি রেলের, লোকবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। রেলের লোকশেডগুলো জনবলের অভাবে মেরামত হচ্ছে না ইঞ্জিন কিংবা বগি, ফলে সময়মতো চালানো যাচ্ছে না ট্রেন। রেলের চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, নীলফামারির সৈয়দপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের কারখানাগুলো জনবলের অভাবে বন্ধের পথে তবুও নিয়োগ নেই। ফলে বাড়ছে সামান্য খুচরা যন্ত্রাংশ কিনতেও বিদেশ নির্ভরতা। সেদিকে নজর না দিয়ে তারা ব্যস্ত কৃষি ট্রেন কিনতে। কৃষি ট্রেনের নামে সম্ভাব্যতা যাচাই আর কনসালটেন্ট নিয়োগে খরচ হয়েছে শত কোটি টাকা। যাত্রীবাহী ট্রেনের অভাবে ছাদে উঠছে লোক আর রেল অফিসাররা আছে কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য ট্রেন কেনায় ব্যস্ত।
যদিও তারা নিজেরাই বোঝেন এই কৃষি ট্রেন লোকসানের পাল্লাকে ভারি করবে প্রতিদিন, লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। ঝুঁকিপূর্ণ বর্তমান লাইনকে গতিময় করতে যে প্রকল্প নেয়া দরকার তা না নিয়ে অপ্রয়োজনীয় নন লাইন নির্মাণে তারা ব্যস্ত। হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন লাইন তৈরি হয়েছে ঠিকই কিন্ত বগি আর ইঞ্জিনের অভাবে চালোনো যাচ্ছে না ট্রেন। আবার অনেক নতুন লাইনে নেই যাত্রী চাহিদা ফলে আসছে না কাক্সিক্ষত আয়। আর যে সব বিদ্যমান লাইন সংস্কার জরুরি যেখানে যাত্রী চাহিদা বিপুল যেখানে সম্ভাবনা আছে বিপুলপরিমাণ অর্থ আয়ের সেসব লাইন সংস্কারে কেন জানি উদাসী রেল কর্তারা। ফলে টাকা খরচ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সুফল পাচ্ছে না জনগনণ।
রেলসেতু গুলোর সংস্কার না করে রেল ব্যস্ত পাতাল রেলের স্বপ্নে। পাতাল রেলের প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে খরচ করছে কোটি কোটি টাকা। অথচ তারা জানে এই প্রকল্প এখন একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। তবুও সেদিকেই ছুটছে তারা। রেলের মোট জমি রয়েছে ৬২ হাজার একর। যার ৩২ হাজার একরই বেদখল রেলের। এসব জমি উদ্ধারে কোনো প্রকল্প নেই তাদের। এসব জমি উদ্ধার করে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগালে বাড়বে রেলের আয়। রেলের বহু জমি মানুষ দখল করে রেখেছে, রেল তার প্রকল্প বাস্তবায়নে যখন সেই জমি দরকার পড়ছে তখন নিজেদের জমিই আবার মানুষের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে কিনছে রেল। এভাবে নানা দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় বাড়ছে রেলের পরিচালনা ব্যয়। সে অনুযায়ী আয় বাড়ছে না ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতি বছর। শুধু যাত্রী পরিবহন করে বাড়ানো সম্ভব না রেলের আয়, একথা যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বহুদিন থেকে বলছেন, কিন্ত সেদিকে রেলের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
অর্থাৎ পণ্য পরিবহন বাড়নোর জন্য যে সব রেললাইন সম্প্রাসরণ দরকার সেগুলো না করে তারা ব্যস্ত অন্য কাজে। নতুন আইসিডি নির্মাণের জন্য চীনের টাকার যোগান থাকলেও ১০ বছরে তা শুরু করতেই পারেনি রেলওয়ে। এখন শুনছি চাঁদপুরে রেলের জমিতে জনগণের জন্য পার্ক নির্মাণ করবে রেলওয়ে। এই পার্কে বিনামূল্যে প্রবেশ করবে মানুষ। এই এলাকার বিনোদনের অভাব পূরণে বেশ ভূমিকা পালন করবে এই পার্ক। যে সময় মানুষ টিকিটের অভাবে রেললাইন অবরোধ করে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়, সেই সময় এমন বিলাসী প্রকল্পের কোনো দরকার আছে? রেল যাত্রীদের ভোগান্তি যেখানে চরমে উঠে নাভিঃশ্বাস অবস্থা তখন এমন আয়েশী প্রকল্পের জন্য কোটি টাকা বরাদ্দ নিদারুণ উদাসীনতা ছাড়া আর কী হতে পারে? বোঝা যাচ্ছে টাকাগুলো পরিকল্পনাহীনভাবে ব্যয় করার পাঁয়তারা চলছে। এতে হয়তো উন্নয়ন খরচ বেড়েছে জোর গলায় বলা যাবে, কিন্ত জনগণের কোনো কাজে আসবে কী?
৬৩ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ রেল লাইন সংস্কারের উদ্যোগ নাই অথচ রেলের প্রকল্প চলছে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালানো। রেলওয়ের কর্মকর্তাদের কে বুঝাবে যে এই লাইনে চলবে ইলেট্রিক ট্রেন। ইলেকট্রিক ট্রেন তো ভবিষ্যতের ট্রেন, কিন্তু বর্তমানের যাত্রীদের সেবা দেয়ার জন্য তো দরকার রেললাইন সংস্কার। এই মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে ১৩৩টি রেলস্টেশন, সেগুলোকে চালুর উদ্যোগ না নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিলাসী স্টেশন নির্মাণ করে খরচ করা হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। অনেক প্রয়োজনীয় স্টেশন সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেদিকে নজর নেই, অথচ বিপুলপরিমাণ বিনিয়োগ করে বানানো হচ্ছে বিলাসবহুল অপ্রয়োজনীয় স্টেশন। রেলকে ডিজিটাল করার কোনো উদ্যোগই নেই তাদের। নেই টিকিট বিক্রির নিজস্ব সার্ভার, নেই কোনো আইটি বিভাগ কিংবা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। অথচ এসব কাজের জন্য কনসালটেন্ট নিয়োগ করে খরচ করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
এসব করে বাড়ছে রেলের উন্নয়ন খরচ কিন্তু কমছে যাত্রী সেবার মান। এসব অহেতুক প্রকল্প বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে এর সুফল পাওয়া সম্ভব। যে পরিমাণ টাকা ১০ বছরে খরচ হয়েছে তাতে অন্তত কিছু সুফল পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা অপরিকল্পিত এমনকি অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় তার সুফল মিলছে না। বিগত ১০ বছরে মোটামুটি একটা শক্ত ভিত দাঁড় হয়েছে রেলের এর শতভাগ সুফল ঘরে তুলতে দরকার এখন পরিকল্পিত বিনিয়োগ আর পরিকল্পিত প্রকল্প। নতুবা অপরিকল্পিত উন্নয়নের গ্যাড়াকলে যাত্রী ভোগান্তি আরও বাড়বে। উন্নয়নের খরচ তো উঠবেই না, বরং বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ফতুর হবে রেল।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী