নিরাপদ সড়ক : শক্তিশালী ব্যর্থ আন্দোলন
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
🕐 ৯:৫১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৭, ২০১৮
বাংলাদেশের সবচেয়ে অগোছালো খাতগুলোর একটি হলো পরিবহন খাত। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে সদ্য পাস হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন। এই আইনের কয়েকটি ধারায় পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থহানি হয়েছে এ অজুহাতে দুইদিনব্যাপী পরিবহন ধর্মঘট পালন করেছে শ্রমিকরা। বাংলাদেশে নানা নামে পরিবহন শ্রমিকদের অসংখ্য সংগঠন রয়েছে। শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বা প্রধান কোন না কোনভাবে একজন মন্ত্রী।
কিন্তু সারাদেশে শ্রমিকদের দুইদিনব্যাপী ধর্মঘটের বিষয়ে মন্ত্রী যদি কিছুই না জানেন, তাহলে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব থেকে তার পদত্যাগ করা উচিত। কয়েকদিন আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশবাসী একযোগে আন্দোলনের কাতারে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সড়কের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ আন্দোলন এখন পুরোপুরি ব্যর্থ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনটিকে ব্যর্থ বলছি এই অর্থে যে, আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে কেবল সড়ক পরিবহন আইনটি পেয়েছি, আর কিছু পাইনি। জাতিকে জাগিয়ে তোলা, মানুষের বিবেকের দ্বার খুলে দেওয়া ও সচেতন করার মতো কাজগুলোর কিছুই এই আন্দোলন দিয়ে করা যায়নি।
পরিবহন শ্রমিকদের মন-মানসিকতার কোনো উন্নয়ন হয়নি। ঠিক আমাদের মতো সাধারণ পথচারীদের অবস্থা আরও খারাপ। যে মা তার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মা এখন রাস্তার মাঝখানে চলাচল করতে দ্বিধাবোধ করেন না। আইন অমান্য করে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ান, রাস্তা পারাপার হন। আন্দোলনের সময়কার সামাজিক মিডিয়াতে নানা বিবেকপ্রসূত স্ট্যাটাস কোনো কাজে আসেনি। বরং এগুলো ছিল একেবারে আবেগী কথা। আমি তখনই অনুমান করেছি, এগুলো দুই একদিন পর থেমে যাবে। আসলে কোনো জায়গায় আমাদের কোনো শিক্ষা হয়নি। এ আন্দোলনের দ্বারা শ্রমিক, চালক, মালিকপক্ষ, সাধারণ জনগণ কারো কোনো শিক্ষা হয়নি। বিশ্বের অনেক দেশেই পরিবহন মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি করার জন্য আলাদা সংগঠন আছে। কিন্তু আমাদের দেশে মালিক শ্রমিক মিলে ঐক্য পরিষদ রয়েছে। এই রকম অদ্ভুত সংগঠন বিশ্বের আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। অর্থাৎ মালিক পক্ষের সাথে বারগেইনিং করার মতো সংগঠন এখানে অনুপস্থিত। তবে এ অবস্থার প্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন।
তিনি বলেছেন, শ্রমিকদের ভুল বুঝিয়ে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। যারা রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে এই সব নৈরাজ্য তৈরি করাচ্ছে, তারা আসলে আইনের কিছুই জানেন না। সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত যেই করুক না কেন, সাক্ষী প্রমাণও বড় কথা নয়। বরং বিচারকের নিকট ঘটনাটি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে এই আইনের সর্বোচ্চ দণ্ড প্রয়োগ করা যেতে পারে। ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা এমন প্রায়ই ঘটছে। জঙ্গিরা গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করছে। তাহলে বলতে হবে জঙ্গিরা যেভাবে গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে মানুষ মারছে, এগুলা দুর্ঘটনা। আমরা যখন নিরাপদ সড়ক নিয়ে আলোচনা করি, তখন কী কী লাগবে অর্থাৎ আমাদের চাহিদার বিষয়গুলোকেই আলোচনায় প্রাধান্য দিয়ে থাকি। পরিবহন খাতে দক্ষ শ্রমিক, শিক্ষিত চালক, লোক, বৈধ লাইসেন্স, গাড়ির কাগজ ইত্যাদি লাগবে। কিন্তু সেই দক্ষ, শিক্ষিত লোক পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা কি আমরা কোথাও রেখেছি? পরিবহন শ্রমিকদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, শিক্ষার ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি। তাহলে ভালো চালক তৈরি হবে কিভাবে? বস্তির ছেলেরা গাড়ির হেলপারি করতে করতে এক সময়ে চালক বনে গেছে। সড়ক পরিবহন আইনে উল্লেখ আছে, চালকের এইট পাস হতে হবে। কিন্তু শ্রমিকরা বলছেন ফাইভ পাস। কিন্তু এগুলো হলো আমাদের চাহিদা।
যারা চালক তারা হেলপারি করতে গিয়ে গাড়ি চালানো শিখেছে। একাডেমিক কোনো অর্জন নেই। যেমন গাইতে গাইতে গায়েন। কিন্তু তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্র কিংবা সমাজের। দুঃখজনক আমরা তাদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারিনি। সমাজে গাড়ির হেলপার এবং চালকদের কোনো সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয় না। কাজেই দরিদ্র ও নিরক্ষর শ্রেণির লোকজনই সেখানে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে। কাজেই পরিবহন শ্রমিকদের বিবেক-বিবেচনা নিম্নমুখী হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাদের কাছে কিছু প্রত্যাশা করা ভুল। পরিবহন ধর্মঘট ডাকার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু অন্যের গাড়ি চালানোর অধিকার খর্ব করার অধিকার তাদের নেই। মানুষের গায়ে কালি দেওয়ার বিষয়টিও দুঃখজনক। কিন্তু আমরা কেবল বস্তিবাসী হেলপার চালকদের দোষ দিচ্ছি। একই সাথে আমাদের রাষ্ট্রেরও সমস্যা আছে সেটাও আমাদের মানতে হবে। এখন আর জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসবে না। কাজেই সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের এখন কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় বিশ্বস্ত কোনো জায়গা থেকে তাদেরকে আশ্বস্ত করা দরকার এই বলে যে, আইনে কোনো ভুলভ্রান্তি থাকলে নির্বাচন পরবর্তী সরকার মীমাংসা করবে। বর্তমান সরকার জোর দিয়ে বলতে পারে, আমরা যদি আবার ক্ষমতায় যাই, তখন আইনটি সংশোধন করবো। কাজেই শ্রমিকদের এই ধরনের ধর্মঘট থেকে বিরত থাকা উচিত। এবং ভবিষ্যতে যেন ধর্মঘট ডাকার অজুহাত তৈরি না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
আমি মনে করি, এই আইনের মধ্যে সব কিছু অন্তর্ভুক্ত করা দরকার ছিল। মালিক যদি জেনেশুনে লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালান, তার শাস্তির বিধান রাখা উচিত ছিল। আবার আমরা যারা সাধারণ পথচারী রাস্তার মাঝখান দিয়ে দৌড়াচ্ছি, রাস্তা পারাপার হচ্ছি তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা থাকার দরকার ছিল। অর্থাৎ চালক, মালিক, পথচারী সবাইকে আইনের অধীনে আনা দরকার। অনেক দুর্ঘটনাই কেবল চালকের কারণে ঘটছে না। বরং পথচারী, রাস্তাসহ নানা কিছুই দায়ী থাকে। ইউরোপে একটি কুকুরও রাস্তার মাঝখান দিয়ে যায় না। কুকুর দাঁড়িয়ে থাকে। লাইট দেখলে রাস্তা পার হয়। একটি দেশ বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ সব দিক দিয়ে সর্বস্থানে যায়। কাজেই পথচারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। সিটি কর্পোরেশনের উচিত ছিল মানুষের চলাচলের রাস্তা ফুটপাট দখলমুক্ত রাখা।
এজন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার থেকে শুরু করে প্রত্যেককে এই আইনের আওতায় আনা দরকার। একটি গোষ্ঠীকে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিলে তারা হয়তো সঠিক পথে আসবে, কিন্তু অন্যরা আসবে না। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফুটওভার ব্রিজ পড়ে আছে, ব্যবহার নেই। মানুষ ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে। এমন অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার জন্য জরিমানা করা দরকার। সঙ্গে দুই-চারদিন জেলও দেওয়া দরকার। যাতে পরিবর্তন আসে। এই সবও আইনে থাকা উচিত ছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ-ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে। আমাদের দেশে প্রায় ৩৯ লাখ গাড়ি আছে। বিআরটিএ ঘুষ দুর্নীতিসহ মোট লাইসেন্স দিয়েছে ১৯ লাখ। ৩৯ লাখের মধ্যে অর্ধেক গাড়ি লাইসেন্স ছাড়া কিংবা নীলক্ষেতের তৈরি লাইসেন্স দিয়ে চলছে। এজন্য গাড়ির মালিকপক্ষ উদ্যোগ নিয়েছেন কি? মালিক তার গাড়ি কাকে দিয়ে চালাচ্ছেন? তার লাইসেন্স আছে কিনা, সবকিছু ঠিক আছে কিনা। ভেবে দেখেছেন কিনা সন্দেহ আছে। কাজেই কেবল চালকদের দোষ দিলে হবে না। অন্যপক্ষকে দায়িত্ব নিতে হবে। যাই হোক সড়ক পরিবহন আইনটির দরকার ছিল। তবে শেষ সময়ে এসে সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের এইভাবে ধর্মঘট করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
সামাজিকভাবে গাড়ির চালককে মর্যাদা প্রদান এবং সম্মানিত করা দরকার। মানতে হবে গাড়ি চালানো একটি দায়িত্বশীল পেশা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্যদের মতো গাড়ি চালকদের গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তার হাতেই মানুষের জীবন মরণ। কাজেই তাদের সম্মান দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ভালো শিক্ষিত ছেলেরা যাতে পরিবহন খাতে যুক্ত হন, সেদিকে নজর দিতে হবে। কারণ আমাদের দেশের শিক্ষিত ছেলেরা ইউরোপ আমেরিকায় গিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা নিউইয়র্কে গাড়ি চালাচ্ছেন।
আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন আনা একান্তভাবে কাম্য। গাড়ি চালানোকে একটি কাজ হিসেবে নিতে হবে। পরিবহন সেক্টরে লোকজন আসবে, তাদের সামাজিকভাবে মর্যাদা দেওয়া দরকার। তাদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ডিপ্লোমাসহ নানা সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা থাকা উচিত। দেশে প্রায় ২০০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়। একটার পর একটা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে। কিন্তু তার আগে প্রত্যেকটি উপজেলায় ভোকেশনাল শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার। বিআরটিসির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। এখন যদিও চাপে পড়ে কিছুটা বেড়েছে। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করতে পারে। ব্যাপক লোকজনকে গাড়ি চালনায় প্রশিক্ষিত করে প্রতিরক্ষা খাতে এবং অন্যান্য খাতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
এক্ষেত্রে তাদের বেতন ভাতাও বাড়াতে হবে। যেভাবেই হোক পরিবহন খাতে পরিবর্তন আনতেই হবে। রাস্তায় মন্ত্রী এমপি যে হোক না কেন সবাইকে আইন মেনে গাড়ি চালাতে হবে। যদি রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তি কোনো অপরাধ করেন, তাহলে তার শাস্তি আরও বেশি হওয়া দরকার। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান হওয়া উচিত নয়। দৃষ্টি বাইফোকাল হওয়ার দরকার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গায় আসীন হয়ে দুই টাকা চুরি করলে আর চোর যদি এক হাজার কোটি টাকা চুরি করে তাহলে সেই ক্ষমতাশীল ব্যক্তির বেশি শাস্তি হওয়া উচিত। রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তি এবং নীতিনির্ধারকদের নূন্যতম অপরাধও মাফ করা উচিত নয়।
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়