ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কবি জাকির আবু জাফরের কাব্য সাম্রাজ্য

খোঁপা খুললেই কবির কবিতার সৌরভ

মুহাম্মদ কামাল হোসেন
🕐 ৭:৫৭ অপরাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২২

খোঁপা খুললেই কবির কবিতার সৌরভ

‘তোষামোদ এর শিরোপা মেটায় বিশ্বস্তের দায়
বোধ বিশ্বাস ঐতিহ্যও বিক্রির তালিকায়।
সেবক বাহক দানবীর আরো কত প্রশংসা ঢের
অথচ যতটা চাষবাস হয় সবটাই স্বার্থের!
ঘৃণার বাজারে হরদম দেখি হৃদয়ের দাম কম
সত্যের চেয়ে মাসোহারা আর তোষামোদ উত্তম।’
-আধুনিক/কবি জাকির আবু জাফর

বদলে যাচ্ছে সবকিছু। সময় বদল হচ্ছে পেন্ডুলাম, জীবন বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষের চিন্তাধারা ও মনস্তাত্ত্বিক ভাববিকাশ। বাদ নেই কবিতাও। একদম খোলনলচে বদলে যাচ্ছে। কবিতার প্যাট-প্যাটার্ন দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে। সময়ের নাড়ি চিরে বর্তমান সময়ের কবিরা ধারণ করে যাচ্ছেন তাদের নিজস্ব কালচিত্র। কবিতার গতি-প্রকৃতি ও বাঁকবদলে সেই অনাদিকাল থেকে প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলে আসছে। বাংলা কবিতার বয়স প্রায় হাজার বছর হতে চলল। চর্যাপদ থেকে হাজার বছরের এ পথচলায় আশ্চর্যময় সব বাঁক-বক্রতা নিয়ে এগিয়েছে বাংলা কবিতা। কবির গভীরতম অনুভূতি, কবিতার গঠনশৈলী, ভাষার প্রবহমানতা, কবিতার উদ্দেশ্য, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিপার্শ্ব এবং প্রকাশ ভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যসহ নানাবিধ কারণে মঙ্গল-কাব্য, পুঁথি-কাব্য, বৈষ্ণব পদাবলির মাধ্যমে পেয়েছে বহু বর্ণিল রূপ।

তবুও থেমে নেই আমাদের আজকের কবিরা। প্রতিনিয়ত বাঁক বদলের খেলায়, ভাঙনের নেশায় মেতে উঠেছেন তারা। কবিতার বিশেষায়িত আধুনিকায়নে ভূমিকা রাখা আজ সমকালীন সময়ের তেমনি একজন জনপ্রিয় কবির আলোচনা করব। তিনি কবি জাকির আবু জাফর। নব্বইয়ের দশকের সাড়া জাগানো আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবিদের মধ্যে অন্যতম কবি জাকির আবু জাফর। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে তার সরব উপস্থিতি ও দৃপ্ত পদচারণা।

তিনি টেলিভিশনে চমৎকার উপস্থাপনা ও দারুণ আবৃত্তির জন্যও সমান জনপ্রিয়। সমকালীন কবিদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়, মেধাবী ও আলোচিত অন্যতম একটি নাম। আপাদমস্তক কবিতার মানুষ হলেও তিনি বহুমাত্রিক প্রতিভার একজন জাত শিল্পী। সব্যসাচী ব্যক্তিত্ব। কবিতা ছাড়াও তিনি একাধারে কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক। লেখালেখি সেই কিশোরকাল থেকে। আধ্যাত্মবাদ ও মানবতাকে সমুন্নত রেখে তিনি নাশিদ ও প্রার্থণামূলক গান রচনার ক্ষেত্রেও তার উচ্চকিত মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তার কালজয়ী অসংখ্য জনপ্রিয় গান এখনো এদেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। যেখানে প্রেম, মানবতা, ও ধর্মীয় মূল্যবোধের জীবনদর্শন প্রতিপাদ্য মুখ্য বিষয় হিসেবে চিত্রিত করা হয়ে উঠেছে। তার কবিতায় মানবতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ যেমন ফুটে উঠেছে, তদ্রুপ আধ্যাত্মিকতা ও প্রেম-প্রকৃতি শৈল্পিক এবং নান্দনিকতা সমানভাবে প্রস্ফুটিত।

তার ইসলামী সংগীত কিংবা গীতি কবিতা বিশ্বাসী চেতনায় হৃদয়বৃত্তি এবং প্রকৃতির নিপুণ সৌন্দর্যকে ধারণ করে হয়েছে প্রাণস্পর্শী ও বর্ণিল স্বাদে সমৃদ্ধ। কবি জাকির আবু জাফরের সংগীতের বিষয়বস্তুতেও রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্যময়তা। তার কবিসত্তার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিষয়ে আলাদা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য বৈকি। কবিতার ফেরিওয়ালা কীর্তিমান শব্দচাষি সাহিত্যের যেসব শাখায় হাত দিয়েছেন দু’হাতে সোনা ফলিয়েছেন। প্রত্যেক কবিরই একটি নিজস্ব বলয় বা আঙিনা থাকে। থাকে নিজস্ব খোলা আকাশ। যেখানে সে স্বাধীনচেতায় দাপিয়ে বেড়ান। বাঁক-বক্রতায় কবিতার ধারা পরিবর্তন করেন। এই বাঁক পরিবর্তনও তার সারাজীবনের সাহিত্যসাধনার এক অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্যেরই রূপায়ন মাত্র।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য গগনে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ডামাডোলের সময়ে ১৯৭১ সালের ১ জুলাই নদী ও পলি বিধৌত জনপদ ঐতিহ্যবাহী ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার দক্ষিণ-পূর্ব চর চান্দিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি জাকির আবু জাফর। তার পিতার নাম মুহাম্মদ ওবায়দুল হক ও মাতার নাম সালেহা খাতুন। বাবরি দোলানো চুলের সুন্দর মুখশ্রীর সদালাপী মানুষটি শৈশবে নিজ গ্রামেই শিক্ষাজীবন শুরু করেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক গণ্ডি টপকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিষয়ে বিএ অনার্স ও এমএসএস সম্পন্ন করেন। বাংলা কবিতায় যিনি ইতিমধ্যে বহুমাত্রিক প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছেন।

আমাদের স্বদেশীয় কবিতাকে করেছেন সমৃদ্ধ, দিয়েছেন নিজস্ব ধারা ও অনন্ত যৌবনা। একদম নিজস্ব সুর, স্বর, প্রজ্ঞা ও স্বকীয় চিন্তাধারার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় ইতিমধ্যে একটি বলিষ্ঠ স্বাতন্ত্র্য স্বর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। সমকালীন কাব্য ধারায় আত্মস্থ ও লীন হয়ে মধ্যবিত্তের গভীর জীবনবোধ ও সত্তার সংকটময় পরিস্থিতি তার কাব্যভূমে প্রকটিত হয়েছে যা তাকে স্বতন্ত্র কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। মানব-জীবনের বহু-বিচিত্র বিষয়াদি তিনি হাজির করেছেন কবিতার ক্যানভাসে। মানুষের প্রবণতাগুলিকে আলোড়িত করবার জন্য কবি জাকির আবু জাফরের সার্বক্ষণিক যে ব্যাকুলিত আকুলতা, তার সরল-স্বাভাবিক-প্রত্যাশিত ভাবনাগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে তার কবিতা-বুননের কৌশলে আর পরিবেশনশৈলীর অভিনব রূপে ও মহিমায়।

কবি জাকির আবু জাফরের কাব্যের বিষয়বস্তু বহু বর্ণিল বৈচিত্র্যতা পরিলক্ষিত হলেও একটি বড় অংশ বিস্তৃত মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানা সংকট ও টানাপোড়নের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের চালচিত্র। তার সংবেদনশীল কবি চিত্তের সংশ্লিষ্টায় সমকালীন যুগযন্ত্রণা, সামাজিক অস্থিরতা, মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রাম, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা, শ্রেণিবৈষম্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে অসাম্য ও অসঙ্গতি তার নিখুঁত তুলির আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। কখনো কখনো তার কাব্যে তীর্যক ব্যাঙ্গাত্মক বাক্যাবরণে সমাজের জুলুম- নিষ্পেষণ, অন্যায় ও অসঙ্গতির চিত্র প্রতিভাত হয়েছে। তার কবিতার ভাষা শৈলী শান্ত সমাহিত নিটোল মুগ্ধ কোমল ও অন্তরজাত নীরব রুদ্রতাহীন মায়াময় এক সুস্থিতি। সময়ের স্রোতে যে জীবন, যৌবন, ধন ও মান সব কিছু ভেসে যায় তারই এক সত্য বিবরণ আমরা পেয়ে যাই তার বর্ণনার সরলতার ভেতর দিয়ে।

মধ্যবিত্তের জীবনে নানা টানাপোড়েন ও সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এই শ্রেণির মানুষের জীবন সংগ্রাম, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাময় জীবনের তীব্র আশাবাদের প্রতিচ্ছবি তার কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে সহানুভূতিশীল চিত্তের প্রাখর্যে। মানুষের জীবন নিয়ত সংগ্রামশীল। প্রাপ্তির আশা ও প্রত্যাশাই গন্তব্যে পৌঁছানোর অনুঘটক। আশাই জীবন, জীবনের শ্রী, বেঁচে থাকার প্রেরণা ও কর্মোদ্দীপণার মূলমন্ত্র। মূলত জাকির আবু জাফরের কাব্যে মধ্যবিত্তের জীবন ও সংকটে নতুনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা এবং তীব্র আশাবাদের যে প্রতিফলন প্রত্যক্ষীভূত হয়েছে সে দিকটাই আজকের আলোচ্য বক্ষ্যমাণ কাব্যগ্রন্থে দিকপাত হয়েছে। জীবনের অশেষ স্বপ্ন ও সম্ভাবনা কখনোই পূর্ণতা পায় না; অপূর্ণতার ক্লান্তিবোধে ক্ষণিক বিরতি হলেও আবারও মানুষ নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। এভাবেই প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার দ্বৈরথে অস্থির মানবচিত্ত অনন্তকালাবধি কেবল অতৃপ্তই থেকে যায়।

সম্ভাবনাময় স্বপ্নের প্রাপ্তিতে অস্থির মানব মন আবার উদগ্রিব হয়ে ওঠে। বইমেলা কেন্দ্রিক লেখালেখি নিয়ে আমার ব্যস্ততম সময় কাটলেও দীর্ঘদিন ধরে কবিতার নিবেদিত যোদ্ধা এই অন্তপ্রাণ জাকির আবু জাফরকে পাখির চোখ করেছি। কবিতার এই মানুষটিকে নিয়ে যখনি লিখতে বসেছি, কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব- প্রায় খেই হারিয়ে ফেলেছি। শুধু কবিতা প্রসঙ্গে হলেও এককথা ছিল, কিন্তু যে মানুষটি বহুমাত্রিক প্রতিভা ও স্বকীয় চিন্তাধারার মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ সব্যসাচী লেখক ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাকে নিয়ে আলোচনা করার মতো যে যথেষ্ট মালমসলা বা রসদ রয়েছে- সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রিয় মানুষটির চমকপ্রদ ও ভিন্নধর্মী একটি কাব্যগ্রন্থ গভীর আগ্রহের ফলশ্রুতিতে অবশেষে আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম ‘খোঁপা খুললেই রাতের নদী’। নিঃসন্দেহে নামের মধ্যে ভিন্নতা ও শৈল্পিক রুচি লক্ষণীয়।

যেকোন বইয়ের নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নামকরণ যদি বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যুক্তিযুক্ত না হয় তবে বইটি পড়ার পর পাঠকের বিভ্রান্ত হবার সমূহ আশঙ্কা থাকে। তাই নামকরণের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। সাধারণত বিষয়বস্তু, মূল বক্তব্য, কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা সাংকেতিক বা প্রতীকী তাৎপর্যের ওপর ভিত্তি করে কবিতার নামকরণ করা হয়ে থাকে। ‘খোঁপা খুললেই রাতের নদী’ নামকরণে কবি প্রতীকী অর্থের ওপর নির্ভর করেছেন। ‘বৈচিত্র্যময় মানবজনম, সম্পর্ক, প্রেম, ভাবাবেগ ও জীবন ঘনিষ্ঠ দর্শনকে কবি এক সরলরৈখিক চিন্তাধারায় চমৎকারভাবে ভাষারূপ দিয়েছেন প্রতীকী নামকরণের এই মলাটবদ্ধ বইটিতে। বইটি পড়ার সময় মনে হয় বাংলা কবিতার অভিযাত্রায় এ এক অজানা অভিঘাত, নয়া অভিজ্ঞতা। বইয়ের কবিতায় বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষের ভেতর বাহিরের চিন্তাভাবনা, বোধ, অনুভূতি, প্রেম বিরহ, প্রতিদিনের ছবি, মানুষে মানুষে সর্ম্পক কবি ফুটিয়ে তুলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। কবিতায় এনেছেন যেন এক নতুন পথ। চলুন এবার ঘুরে আসা যাক কবিতার বইয়ের পাতা থেকে-

‘দহনের জল তুমি মোহময় বৃষ্টির আগুন
অৎস্র ভোরের প্রেমময় মুখ
অথবা আরাধ্য আঁধারে আবৃত রাতের শিশির
সূর্যের আঁখির মতো আশ্চর্য উদ্ভাস
প্রাণের গভীরে ঢালো জ্যোতির শ্রাবণ।’
(তারই রহস্য তুমি)

রহস্যঘেরা স্রষ্টা ও সৃষ্টির অপার সৌন্দর্যে কবির আকুতি ভরা দারুণ কিছু কথামালা দিয়ে সাজানো এই কবিতাটি দিয়ে বইটির যাত্রা শুরু হয়েছে। বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে বাছাইকৃত চমৎকার ৩৮টি কবিতা। কবিতাগুলো মানুষের জীবন, বোধ ও অস্তিত্বের সঙ্গে কতটা প্রাসঙ্গিক পড়লেই বুঝা যায়। কবিতার মধ্য দিয়ে কবি বর্তমান প্রতিক্রিয়াশীল অস্থির সময়টাকে যেন ধারণ করেছেন। এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা প্রতিদিন। কেউ বলতে পারব না আগামীকাল কি হবে আমাদের জীবনে? আমরা স্বীকার করি আর নাইবা করি, আমাদের সকলের মধ্যে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ও মানসিক অশান্তি কাজ করছে। প্রতিটি দিন আমাদেরকে পার করতে হচ্ছে এক ধরনের অবসাদ ও প্রতিবন্ধকতার ভিতর দিয়ে। হঠাৎ করে মনে হচ্ছে জীবন এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে। সব সময় কি যেন এক অজানা ভয় মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। করোনা বা কোভিড-১৯ সেই আশঙ্কাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কবি যেন সেই সময়ের আভাস আগেই পেয়েছেন। কবি লিখেছেন-

‘মানুষের পাশে যখন মানুষ থাকে
যখন মানুষ মোছে মানুষের শোক
যখন মানুষ বিলায় মানুষের সুখ-
মনে হয় ভালো আছি।
সূর্যের বুকের মতো বিবেক জাগ্রত দেখি যখন
জোছনার হৃদয়ের মতো কোমল দেখি যখন
এবং যখন দেখি সবুজ পল্লবের মতো ছড়ানো মানবিক মন-
মনে হয় ভালো আছি।’
(মনে হয় ভালো আছি)
আরেকটি কবিতায় সমগ্র বিশ্বের মজলুম, নির্যাতিত-নিপীড়িত সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে কবিকে দেখতে পাই। যেখানে অবহেলিত মানুষের আর্তনাদ ও দুঃখ বঞ্চনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।

ইঙ্গিত দিয়েছেন এক ভয়াল সময় ও রূঢ়-নির্মম পৃথিবীর দিকে। কবিতাটা এমন-
‘মানুষ সর্বস্ব উজাড় করে মানুষের
মানুষই মানুষের নৃশংস হন্তারক
সর্বত্র পাতানো মারণাস্ত্রের নির্মম বিষ
সর্বত্র স্বপ্নলুটেরা জেঁকে আছে ক্ষমতার বুকে
বাজারগুলো ভরে গেছে মানুষের কষ্ট আর বেদনার জলে
মানুষের দুঃখগুলো যেনো থরে থরে সাজিয়েছে দোকানিরা
তেল ভরা ড্রাম যেনো শোকের কন্টেইনার
পৃথিবীর মহানগরগুলো ভরে গেছে জালিমের বিষ্ঠা
মসনদ আঁকড়ে আছে অধিকার লুণ্ঠনকারী স্বপ্ন ডাকাত দল
মানুষের পৃথিবীতে নিতান্ত অবহেলিত মানুষ
মানুষের দুনিয়ায় ভীষণ বিধ্বস্ত মানুষ।'
(মানুষের পৃথিবীতে)

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতাই বাছাই করা এবং অনবদ্য। প্রতিটি কবিতা নিঃসন্দেহে বিশদ আলোচনার দাবী রাখে। একফ্রেমে সবগুলো কবিতার আলোচনা করা কোনক্রমে সম্ভব নয়। বইয়ের নাম ভূমিকার ‘খোঁপা খুললেই রাতের নদী'’ কবিতাতে এক প্রেমিক মনের কবিকে দেখতে পাই। যার হৃদয়ে উত্তুঙ্গ প্রেম ক্ষরিত হয়েছে। কবি জাকির আবু জাফর বরাবরি মানব হৃদয়ের আর্তি, আকুতি চিরন্তন প্রেম-ভালোবাসা-সুখ-দুঃখ নিয়েই দীর্ঘ জীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তার কবিতা জীবনধর্মী। পাঠক একান্তভাবে নিজেকে খুঁজে পান তার ক্ষুরধার লেখনীতে। অসহায় মানুষদের জীবনচিত্র, হৃদয়ের কামনা বাসনা যা অতি সাধারণ মানুষের চোখে ধরাই পড়ে না সেই সাধারণ বিষয়গুলোকে তিনি যত্নের সাথে অসাধারণ করে পাঠকদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছেন। এই কবিতায় তিনি লিখেছেন-

‘প্রকৃতির মতো বিস্তীর্ণ বিশাল তোমার হৃদয় পৃথিবী
মনের বহর যেনো সমুদ্রময়ী সম্ভার
তোমার গহনে জাগ্রত উষ্ণতার এক কল্লোলিত প্রাণ
জীবনের সব আঙিনায় তারই প্লাবন
তারই ঢলের সর্বগ্রাসী ঢেউ
খুঁজে পাই সেই ঘ্রাণ সেই স্নিগ্ধ নির্ভার আরাম
মগ্নতার মহলে ডুবে যাও যখন
হয়ে ওঠো নৈঃশব্দের নির্জন বুক
জেগে থাকা জোছনার মতো সুখ বিছায় স্বপ্নের ডানা
রাত্রির শরীর বেয়ে নেমে আসো বুকের ভেতর
আমার আকাশজুড়ে হয়ে ওঠো নক্ষত্রের মুখ
দিনকে আঁচল টেনে বেঁধে দাও খোপার ভেতর
খোঁপা খুললেই নেমে আসে রাতের নদী।’
(খোঁপা খুললেই রাতের নদী)

কবিতা হলো অভিজ্ঞতা ও চেতনাপ্রবাহ থেকে জন্ম নেয়া বোধের সঙ্কলিত রূপ। কবিতা শুধু মানব জীবনের নান্দনিক সঙ্গী নয়, এটি মানুষের রুচি ও সুকোমল সংস্কৃতি চর্চার বাহন, সৌন্দর্য ও শিল্পবোধের ধারক। বুদ্ধি, নির্মাণ-কৌশলকে অভিনব করে তুলতে সহায়ক, কিন্তু কাব্যের ভিত্তি রচনায় এর কোনো প্রভাব নেই। কবিতাকে যদি আমরা কালের কথকতা বা সময়ের অভিঘাত হিসেবে বিবেচনা করি সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ব্যাতিরেকে কবিতা সম্পর্কে ভিন্ন কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না। বুদ্ধি সমস্যা কিংবা অবস্থাদৃষ্টে কেবল কৌশল বাৎলে দিতে পারে, সেখানে প্রাকৃতিকতা মুখ্য থাকে না। জগৎ-জীবন থেকে কবি কী কী নেবেন আর কী কী বর্জন করবেন, সেটা নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে শিল্পদৃষ্টি ও কবির ভাবনাজগৎ। বোদ্ধা পাঠক কবিতার মধ্যে দুটো জিনিস প্রত্যাশা করে- একটি হচ্ছে চিন্তার সূক্ষ্মতা এবং অন্যটি প্রকাশের অভিনবত্ব। এর যে কোনো একটি দিয়ে সাময়িক মন জয় হলেও তা বেশি দিন আকৃষ্টতা ধরে রাখতে পারে না।

কবি জাকির আবু জাফরের কবিতায় আমরা দুটো জিনিসই দেখতে পাই। বর্তমানে কবিতার বক্তব্য বা চিন্তাসূত্রের চেয়ে এর নির্মাণ নৈপুণ্য নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে। এটা মূল্যায়নের কতটা যৌক্তিক প্রক্রিয়া যে, ভাবনার চেয়ে কাঠামো-কলকব্জা নিয়ে গবেষণা-

পর্যালোচনা বেশি হচ্ছে! মানব মনের চৈতন্যকে প্রকাশে কবি প্রতিনিধিত্ব করেন, সেখানে ভাবনাই যদি অমুখ্য থাকে তো এসব জড় কঙ্কাল সহসাই মুখ থুবড়ে পড়বে স্বাভাবিক! ভাবসূত্রকে যথেষ্ট প্রাঞ্জল ও অর্থপূর্ণ করার পর পর অবশ্যই কবি তার শৈলী ও সৌন্দর্য নিয়ে বসবেন। চিন্তার যেমন বিনির্মাণ ও বিবর্তন রয়েছে, তেমনি প্রকাশ ভঙ্গিরও নতুনত্ব কবিতাকে নান্দনিক ও সম্পন্ন করে তোলে। কবিতার মধ্যে গল্প থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে, তবে ভাবনার একটি বিবৃতি তো থাকেই, সেক্ষেত্রে পাঠকের ভাবনা ও কল্পনাকে উন্মোচিত করতে কবিতায় প্রবেশের একটি সুগম পথ থাকতে হয়।

কবিতার বিবৃতি যেহেতু খুব সংহত ও নৈর্ব্যক্তিক, সেহেতু দ্বার রুদ্ধ থাকলে সেই কাব্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে নিশ্চিত। কবি জাকির আবু জাফর কবিতা ও সাহিত্যের ভেতর তিনি জীবন ও জগতকে মন্থন করেন। স্বপ্নের সঙ্গে স্বপ্নের জোড়া দেবার এক অসাধারণ ক্ষমতা জাকির আবু জাফরকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। কবিতার আনন্দই তার কাছে বড় আনন্দ। তার আনন্দ ঘিরে আছে মানব মানবী থেকে শুরু করে সমগ্র সৃষ্টি জগৎব্যাপী। প্রকৃতি ও প্রেম যেন তার আত্মার গভীর থেকে উৎসারিত এক চির বহমান স্রোতস্বিনী। যেন বয়ে যায় হৃদয়ে হৃদয়ে সৃষ্টির পরতে পরতে। প্রাণের স্নিগ্ধতার উৎসবে। প্রকৃতি প্রেম এক সত্ত্বায় দাঁড়িয়ে আছে তার কবিতায়। কবি জাকির আবু জাফরের কাব্যভাবনায় প্রেম-মানবতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পাঠক একান্তভাবে নিজেকে খুঁজে পান তার ক্ষুরধার লেখনীতে। অসহায় মানুষদের জীবনচিত্র, হৃদয়ের কামনা বাসনা যা অতি সাধারণ মানুষের চোখে ধরাই পড়ে না। সেই সাধারণ বিষয়গুলোকে তিনি অসাধারণ করে পাঠকদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছেন। হৃদয়ভরা মানুষের প্রতি ভালবাসা, প্রেম, আর অকৃত্রিম সহানুভূতি নিয়ে ফেরি করে চলেছেন কবিতার এই ফেরিওয়ালা। বুঝিয়ে দিচ্ছেন জীবনের অর্থ। মানুষের ভালবাসায় প্রতিনিয়ত সিক্ত করছেন নিজেকে। ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল দানবীয় সভ্যতার এই ক্রান্তিকালে, দরিদ্রের হৃদয়ের হাহাকার, ক্ষুধিতের আর্তনাদ, সুবিধাবঞ্চিতদের বুক ভরা কান্নায় যখন ভারি হচ্ছে বায়ু। সবলের বল নিত্যদিন যেখানে বর্ধিত হয়েই চলছে, মানবপ্রেম, সৃষ্টির প্রতি অগাধ ভালোবাসা যে সময়ে আবর্জনার স্তূপে ধুঁকে ধুঁকে মরছে আর বিকট চিৎকার করে উঠছে, কালের বিবর্তনে ঘোর অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব, মানবের ভেতরে জায়গা করে নিচ্ছে দানবসত্ব; সেই ক্রান্তিকালে কবির কলম জেগে উঠেছে।

সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে প্রেম, মানবতা ও মুক্তি আন্দোলনের কবি বললে অত্যুক্তি হবে না। কবিতা ও কথাসাহিত্যের সব শাখা মিলিয়ে প্রায় ৪৫টির মতো গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। যার মধ্যে কাব্যগ্রন্থ রয়েছে ১৩টি। তুমুলভাবে এখনও নিরলস লিখে যাচ্ছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই কীর্তিমান মানব পেয়েছেন আন্তর্জাতিক বাঙ্গালি সাহিত্য সম্মেলনের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘বাংলা সাহিত্য স্বর্ণ পদক-১৪২৫’ ও ‘দ্বীপজ একুশে পদকসহ’ বহু পুরস্কার ও সন্মাননা পদক। ২০১৮’র বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ ‘খোঁপা খুললেই রাতের নদী’। বইটি প্রকাশ করেছে বিশ^সাহিত্য ভবন। পরিশেষে আজকের আলোচনার ইতি টানব কবির কবিতা দিয়ে-

‘আমার কিছু ব্যক্তিগত কষ্ট আছে
কষ্টগুলো বলবো না আর তোমার কাছে
তুমি বরং সুখের জলে কাঁপন তোলো
নিভৃতিতে নিমগ্নতার দুয়ার খোলো।’

লেখক : গল্পকার ও ঔপন্যাসিক
ছোট শরীফপুর, লালমাই, কুমিল্লা।

 
Electronic Paper