ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জনস্বাস্থ্য নয়, বাজেটে তামাক কোম্পানির অগ্রাধিকার

ইকবাল মাসুদ
🕐 ১:৩২ অপরাহ্ণ, জুন ১৩, ২০২২

জনস্বাস্থ্য নয়, বাজেটে তামাক কোম্পানির অগ্রাধিকার

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ক্ষতি কমিয়ে আনতে তামাকের বহুস্তরভিত্তিক ব্যবস্থা লোপ করা থেকে শুরু করে সুনির্দিষ্ট হারে কর আরোপের প্রতিফলন নেই এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে। সিগারেটের নিম্নস্তরের দশ শলাকার দাম ৩৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫৭ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম সামান্য বাড়তে পারে। জর্দা, বিড়ি ও গুলের দাম অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। মধ্যমস্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৬৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।

উচ্চস্তরে ১০২ টাকা থেকে ১১১ টাকা এবং প্রিমিয়াম বা অতি উচ্চ স্তরের ১০ শলাকার দাম ১৩৫ টাকা থেকে ১৪২ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন এবং সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক আগের মতো ৬৫ শতাংশ রাখার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রত্যাশা থেকে অনেক দুরে প্রস্তাবিত বাজেট। জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় এই বাজেট কোনো সুফল বয়ে আনবে না। সাধারণত বাজেটের সময় সরকার এমনভাবে কর ধার্য করার চেষ্টা করে যাতে নিম্ন আয়ের মানুষের অর্থনৈতিক চাপ কম হয়। কিন্তু বিড়ি-সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্যের জন্য এই নিয়ম প্রযোজ্য হয় না।

বর্তমানে সিগারেট বাজারের ৭৫ শতাংশই নিম্নস্তরের দখলে। প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরামূল্য মাত্র ১ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করার কারণে এই স্তরে সিগারেটের দাম বাড়বে মাত্র ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ১০ শতাংশ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির তুলনায় যথেষ্ট নয়। অর্থমন্ত্রীর এই প্রস্তাবনা তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতের নাগালের মধ্যে থাকছে তামাকপণ্য এবং জনস্বাস্থ্যের হুমকি হিসেবেও থাকছে। তামাক কোম্পানিতে সরকারের সামান্য মালিকানা থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোম্পানির মালিকেরা তামাকপণ্যের প্রত্যাশিত কর আরোপ করতে দেয় না। এই অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তামাক কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক বোঝাপড়ার কারণে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের অশুভ চক্র কাজে লাগিয়ে কর না বাড়িয়ে এবং কর ফাঁকি দিয়ে বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করে থাকে।

প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটের আকার জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। বিভিন্ন খাতে মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) স্বাস্থ্য খাতের জন্য মোট ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এবার ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে মোট বরাদ্দ হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। এরমধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বরাদ্দ ২৯ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ পাচ্ছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কারণ দিন দিন মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার মধ্যে অসংক্রামক রোগ অন্যতম। আর এই অসংক্রামক রোগের সূতিকাগার তামাকপণ্য।

এবছর প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর্তৃক সংগৃহীত কর থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে, মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বাজেটে এ হার ছিল ৬ দশমিক ২। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে এ ঘাটতি মেটানো হবে বলে জানানো হয়েছে। বর্তমান সময়ে প্রতিদিন অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির নতুন হিসাব কষতে হচ্ছে। করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত উৎপাদন, বিপণন এবং সর্বোপরি কর্মসংস্থানের ঝুঁকি তুলে ধরে জাতিসংঘ বলেছে, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি ৩.২% সঙ্কুচিত হবে।

কিন্তু ১৫ মে ২০২০ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের (এডিবি) প্রকাশিত নতুন সমীক্ষায় দেখা গেল, তা হতে পারে ৫.৮ থেকে ৮.৮ লক্ষ কোটি ডলারের লোকসানে। যা গোটা পৃথিবীর জিডিপির ৬.৪% থেকে ৯.৭ শতাংশের সমান। যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনাজনিত ক্ষতির পরিমাণ এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পূর্বাভাস’ প্রতিবেদনের তুলনায় দ্বিগুণ প্রাক্কলন করেছে। বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষয়ক্ষতি হতে চলেছে, তা বিবেচনায় না নিয়ে সরকার বাজেট পেশ করেছে। বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক মন্দার বিষয় মাথায় রেখে সরকার তামাকপণ্যের কর বৃদ্ধি করে সহজে এই পরিস্থিতি উত্তরণের সুযোগ পেত। তামাকপণ্যের কর বৃদ্ধিতে যেমন অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা করা যেত তেমন জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নও ঘটানো সম্ভব হতো।

কারণ বাংলাদেশ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব) তামাক ব্যবহার করে; ১০৯টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ধূমপায়ীর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯তম, কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। এর ফলে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে প্রায় ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। সরকার যদি তামাক কর বাড়ায় তবে সিগারেট ব্যবহারকারীর অনুপাত ১৫ দশমিক এক শতাংশ থেকে ১৪ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ হবে। এতে ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক সিগারেটের ব্যবহার ছেড়ে দেবেন ও ৯ লাখ তরুণ সিগারেট ব্যবহার শুরু করা থেকে বিরত থাকবেন। এছাড়া আট লাখ ৯০ হাজার অকালমৃত্যু রোধ করা যাবে।

আর সিগারেট বিক্রি থেকে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে। কর আরোপের দুর্বলতার কারণে আমাদের দেশে এখনো তামাকপণ্য অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিগারেটের ব্যবহার প্রায় একই রকম রয়েছে। বাংলাদেশে তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল, যা তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণের পথে একটি বড় বাধা। বিশে^র বিভিন্ন দেশে কর আরোপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভাবে তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। আর আমরা তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ থেকে অনেক দূরে। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ অর্জনে কর কাঠামোকে অবশ্যই সহজ করতে হবে এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়ণের লক্ষ্য নিয়ে যথাযথ পদ্ধতিতে তামাক কর বাড়ালে তামাক ব্যবহার কমবে এবং তরুণ প্রজন্ম তামাক গ্রহণে নিরুৎসাহিত হবে। ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে চান প্রধানমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেট তার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে কী না তা নিয়ে সংশয় থেকে গেল।

লেখক : পরিচালক, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন
সদস্য, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

 
Electronic Paper