ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ফররুখ আহমদ : নিবিড় অনুভবের কথামালা

ড. ফজলুল হক সৈকত
🕐 ২:৫৭ অপরাহ্ণ, জুন ১২, ২০২২

ফররুখ আহমদ : নিবিড় অনুভবের কথামালা

বাঙালির ঐতিহ্য এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের চেতনাধারণ ও লালনকারী কবি ফররুখ আহমদ (জন্ম : ১০ জুন ১৯১৮; মৃত্যু : ১৯ অক্টোবর ১৯৭৪)-এর চিন্তা, সমকালে এবং উত্তরকালে কীভাবে আমাদের জন্য আগ্রহ ও প্রেরণার বিষয় হয়ে উঠেছে, তা অনুধাবন করতে হলে কবির প্রতিবেশের ভেতর দিয়ে আত্মার আলোড়ন ও বেড়ে ওঠার সমগ্রতার ছবি পাঠ করাটা অত্যন্ত জরুরি। আবেগ ও বাস্তবতাকে স্বীকার করে ফররুখ ক্রমাগত যে অর্পিত কাজের বয়ান ও বয়ন অব্যাহত রেখেছেন, সে বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এখন সময়ের প্রয়োজন।

কবি ফররুখ রিপন কলেজে ও স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালে ফ্যাসিবিরোধী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেন হে বন্য স্বপ্নেরা কবিতাগুচ্ছ। কিন্তু ১৯৪১ সালে তার চেতনাজগতে পরিবর্তন আসে ১৯৪০ সালে গৃহীত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে। সে বছর স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন কলকাতা সিটি কলেজেÑ প্রকাশ করেন ‘কাব্যে কোরআন’ শিরোনামে মোহাম্মদী ও সওগাত-এ বেশকিছু সুরার স্বচ্ছন্দ অনুবাদ। একথা প্রায় সর্বজনবিদিত যে, ভারতবর্ষে মুসলমানদের উত্থানের দশকে (১৯৩৭-১৯৪৭) সাহিত্যে পাকিস্তান-চেতনা প্রচারের জন্য দু’টি সংগঠন গড়ে ওঠে একটি কলকাতায়, অপরটি ঢাকায়। ১৯৪২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’; তাদের তত্ত্ব বা দর্শন প্রচারে ব্যবহৃত হয় মাসিক মোহাম্মদী। লক্ষ্য : জাতীয় রেনেসাঁর উদ্বোধক পাকিস্তানবাদের সাহিত্যিক রূপায়ণ, হিন্দুদের থেকে পৃথক মুসলমানদের জীবনভিত্তিক আরবি-উর্দু শব্দবহুল বাংলা সাহিত্য রচনা এবং ভাষা সংস্কার করে নতুন ভাষা নির্মাণ। ধর্ম গৃহীত হয় সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হিসেবে।

খাজা নাজিমুদ্দিনের (১৮৯৪-১৯৬৪) নেতৃত্বে মুসলিমলীগ ক্ষমতারোহণের বৎসরে (১৯৪৩) ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’। পাক্ষিক পাকিস্তান ছিল ওই সংসদের মুখপত্র। পরে, পাকিস্তান-পর্বে, সরকারি মাহে-নও সাময়িকপত্রটি পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৩৭-১৯৪৭ কালপর্বে ফররুখ আহমদের কবিতায় মুসলিম পুরাণের প্রয়োগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ফজলুল হকের পতনের পর নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা (১৯৪৩-১৯৪৫)Ñ এই সময়-পরিধিতে রচিত ফররুখের কবিতাফসল হলো ‘সাত সাগরের মাঝি’ (রচনা : ১৯৪৩-৪৪)। এই গ্রন্থের ‘সিন্দবাদ’, ‘বার দরিয়ায়’, ‘দরিয়ায় শেষরাত্রি’, ‘আকাশ-নাবিক’, ‘স্বর্ণ-ঈগল’, ‘পাঞ্জেরি’, ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘তুফান’, ‘নিশান’ প্রভৃতি কবিতাÑ মুসলিম লীগ ও পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির অতীত ইতিহাস ভূগোলে প্রস্থানের সাক্ষ্য বহন করে। নজরুলের কবিতার জাতীয়তাবাদী বীর কামাল পাশা বা আনোয়ার নয়, আরব্যোপন্যাসের সিন্দবাদ হয়েছে তার কাব্যের নায়ক।

কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ ব’য়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ!
(‘সিন্দবাদ’:সাত সাগরের মাঝি; ফররুখ আহমদ রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, ১৯৯৫)

রবীন্দ্র-পরবর্তী, রবীন্দ্র-স্বতন্ত্রাভিমুখী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল ও কাজী নজরুল ইসলাম ১৯১৮-১৯২৬ কালপর্বে ভূগোলের নতুন পথে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে অভিযাত্রী হয়েছিলেন। এই ধর্মীয়চেতনা, মূল্যবোধ, আধাত্ম্যভাবনা এবং সৃষ্টিরহস্যের প্রতি গভীর নিমগ্নতা পরবর্তীকালে পরিপুষ্টি লাভ করে ফররুখ আহমদের কবিতায়। বিশেষ প্রেরণায় অবগাহন এবং সত্য-অনুসন্ধানে নিষ্ঠাবান ফররুখের কবিতার অন্যতম প্রধান প্রবণতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। যদিও ব্রিটিশ শাসনের অভিশাপ এবং পরাধীনতা থেকে মুক্তি এবং জাতীয় সংকট থেকে উত্তরণই তার কবিতার মূল সূর। সমকালে, ১৯৪০ সালে কবি আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪)-এর নববসন্ত প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার যে নব-আধুনিকতা-পর্বেও সূচনা, তার মাত্র ৪ বছর পর ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি এক নতুন সংযোজন ও ভিন্নতর প্রেরণা। আবার দেশভাগের সময়Ñ ১৯৪৭ সালে প্রবল আশাবাদী কবি আহসান হাবীব (জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯১৭; মৃত্যু : ১০ জুলাই ১৯৮৫)-এর রাত্রিশেষ পরাধীনতামুক্তির নতুন বার্তা বহন করে। কাজেই, দেখা যাচ্ছে সমকালীন বাংলা কবিতার ধারা ও রূপান্তর-পক্রিয়ার সঙ্গে ফররুখের সম্পর্ক স্বাভাবিক ও সুনির্দিষ্ট। পরে, বায়ান্ন-উত্তরকালে তার কবিতায় প্রহরান্তের পাশফেরা আরো স্পষ্টভাবে লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। সমকালীন সমাজ-উপলব্ধি এবং জ্ঞানের ভিত্তিভূমিতে নিজেকে স্থাপন কিংবা সমর্পণের সকল প্রস্তুতি ফররুখের মধ্যে ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তিন বছর আগে, ১৯৪৪-এ (আজাদ, ২০০৫, ২৮) বাংলা ভাষাকে সমর্থন করে ফররুখ আহমদ লিখেছেন :

দুইশো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন
বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকেই করিয়াছি নিকা,
বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়েছে আশার চামচিকা
উর্দু নীল আভিজাত্যে (জানে তা নিকট বন্ধুগণ)।
(‘উর্দু বনাম বাংলা’:মাসিক মোহাম্মদী, জৈষ্ঠ্য ১৩৫২; পরবর্তীকালে অনুস্বারগ্রন্থভুক্ত)
মুহূর্তের কবিতার (১৯৬৩) সনেট শতকে বিশেষত ‘কোকিল’, ‘ফাল্গুনে’, ‘বৈশাখী’, ‘ময়নামতীর মাঠে’, ‘গাথা ও গান’, ‘দীউয়ানা মদিনা’, ‘সোনার গাঁও’, ‘ধানের কবিতা’, ‘নদীর দেশ’, ‘সিলেট স্টেশনে একটি শীতের প্রভাত’ প্রভৃতিতে ফররুখের নব-উদ্বোধন বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য এবং বাংলাদেশ চেতনা প্রবলভাবে আভাসিত।

অবিভক্ত বঙ্গে ক্রমশ ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ উঠে এলে যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটি ভারতবর্ষে মুসলিম চেতনায় ভিন্নমাত্রা তৈরি করল তা ব্যক্তি-মুসলমান বা সমকালের মুসলিম-মানসকে একটি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করল যেখানে স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা কিংবা মর্যাদার বিষয়টি অনুপুঙ্খভাবে জড়িত। কাজী নজরুল ইসলাম মুসলমানদের ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করেছেন আধুনিক দৃষ্টিচেতনা থেকে। সেখানে জাতিত্বের পরিচয় বিধৃত থাকলেও সার্বজনীন মানবতাবোধ কিংবা অসাম্প্রদায়িক চেতনাটাই বিশেষরূপে কাজ করেছে। ফররুখ কবি-ভাষাটি নির্মিত হয়েছে একদিকে তিরিশোত্তর কাব্যধারার উত্তরাধিকার হিসেবে যেখানে প্রেমেন্দ্রমিত্রের ভাবচেতনা কাজ করেছে অন্যদিকে নজরুলীয় রোম্যান্টিকতা যিনি অনিবার্যরূপে কবিতায় ধারণ করেছেন সমাজ-রূপান্তরের প্রস্তুতি ও যুদ্ধজয়ের স্বপ্নকে। সমকালে ফররুখ আহমদ এভাবেই কাব্যধারায় নিবেদিত ছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি আত্মস্থ করেছেন বাংলা কবিতার সমকালীন মূলধারা।

আপন-ভুবনের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষের আশাহত হবার বেদনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিতি পেয়েছে ফররুখের মানবতাবাদ। মানবপ্রেমের কবি তাই এদেশের শ্যামল-নির্মলতায় আঁকতে চেয়েছেন উদাস ক্লান্ত মন্থরতা আর ধেয়ে চলার বিবাদসমূহের হিসেব-নিকেশ। শয়তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে মানুষের জয় যেমন চিরন্তন, তেমনি শোষকের সঙ্গে শোষিতের বিবাদেও শেষত লাভবান ও জয়ী হয় শোষিতরা। ফররুখ লিখেছেন :

আমি চলি ইন্সানের শেষহীন সম্ভাবনা নিয়ে।
তোমার সুতিক্ত দ্বন্দ্ব তীব্রতর হোক, তবু জেনো
এখানে মাটির বুকে সর্বশেষ জয় মানুষেরি।
(‘ইবলিস ও বনি আদম’: কাফেলা)

ঐতিহ্য, সমাজ-বাস্তবতা, ভাষা-প্রকরণ, বিষয়-বৈচিত্র্য ও প্রকাশশৈলী প্রভৃতিতে ফররুখ অনন্য ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি সত্য ও মিথকে, সামাজিকতা ও মানবিকতাকে, কাব্যের কাঠামো ও প্রকাশরীতিকে আয়ত্ব করেছিলেন শিল্পের দায় থেকে। আমরা জানি, ‘এ বিশ্ব-সভ্যতার তাবত জ্ঞানের যে বিকাশ তার সূত্রগুলো; তার সোপানগুলো থরে থরে নানা প্রতীক আর নানা ধাঁধার আড়ালে সাজানো রয়েছে মিথের গভীরে। পৌরাণিক সেই চরিত্রগুলোর নানা প্রতীকের অন্তরালে লুকোনো সেই অভিজ্ঞানের হদিস যিনি পেয়েছেন মিথের বর্ণাঢ্য কাহিনীগুলো তার কাছে আর নিছক রূপকথা মনে হবে না।’ (সুজন, ৭) সেখান থেকে তিনি গ্রহণ করবেন প্রেরণা, শক্তি, সামর্থ্য আর সাফল্য-ব্যর্থতার সমাচার। নিজস্ব ভুবন সাজিয়ে তুলবেন সেই আলোকের প্রভায়। কবি-সাহিত্যিকরা মিথের; ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যের আর মানব-বিজ্ঞান ও ইতিহাসের উপাদান ব্যবহার করেছেন নানান কৌশলে ও প্রয়োজনে।

কবি এজরা পাউন্ড বীরের আদর্শ খুঁজেছিলেন জেফারসন ও হেনরি অ্যাডামসের মধ্যে; ফররুখ আহমদ আরব-বীরদের মধ্যে অনুসন্ধান করেন দুঃসাহসী মুসলমানের প্রতীক। সিরাজাম মুনিরায় আরব্যোপন্যাসের জগৎ নয় ইসলামের ইতিহাসচেতনা প্রবল; ত্যাগ, সেবা ও সংযমের আদর্শ কবি খুঁজে পেয়েছেন সিরাজাম মুনিরা, আবু বকর সিদ্দিক, ওমর-দরাজ দিল, ওস্মান গনি, আলী হায়দার, গাওছুল আজম, খা’জা নকশ্বন্দ, সুলতানুল হিন্দ ও মোজাদ্দিদ আলফেসানীর মধ্যে। ইসলামের সূর্যের রশ্মি সম্পাতিত করার মাধ্যমে দূরীভূত করে দিতে চেয়েছেন মুসলমানদের জীবনের সমূহ অন্ধকার ও অনগ্রসরতা। তার চিন্তার প্রকাশ থেকে খানিকটা পাঠ নিচ্ছি :

এই নিরন্ধ্র শর্বরীর অন্ধকারে তীব্র দ্যুতি হানি
তমিস্রা-বিমুক্ত নভে জাগাও নূতন সূর্যোদয়!
বলিষ্ঠ সিংহের মত শক্তিমান,
একান্ত নির্ভয়
জীলান সূর্যের রশ্মি যাক্ আজ খররশ্মি দানি।
(‘গাওছুল আজম’: সিরাজাম মুনিরা)

ফররুখের আজাদ করো পাকিস্তান (১৯৪৬) কাব্যগ্রন্থে শোনা যায় পাকিস্তানবাদের যুদ্ধবাদী স্বও : ‘সাম্নে চল্ : সাম্নে চল্/ তৌহেদেরি শান্ত্রী দল/‘সাম্নে চল্ : সাম্নে চল্’ (‘ফৌজের গান’)। অনুস্বার (রচনা : ১৯৪৪-৪৬) ও বিসর্গ (রচনা : ১৯৪৬-১৯৪৮) কাব্যগ্রন্থের সামাজিক বাস্তবতার ধারায় মুখ্য হয়ে উঠেছে ব্যঙ্গবিদ্রুপ-প্রবণতা। এসব ব্যঙ্গকবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অসংগতি, ধনতন্ত্র-বিদ্বেষ ও পুঁজিবাদী শোষণের রূপ। পাকিস্তানচেতনার সাহিত্যধারা অনুযায়ী মুসলমানের মুখের ভাষা অর্থাৎ আরবি-ফারসি-উর্দু মিশ্রিত ভাষায় কাব্য রচনা করেন কবি ফররুখ আহমদ। পুরাণচেতনায় তিনি বেছে নেন পুঁথি ও আরব্যোপন্যাসকে। ছন্দের ক্ষেত্রে মুক্তক অক্ষরবৃত্তে নির্মাণ করেন পাকিস্তানবাদী বাস্তবতার আশা-নীল জগৎ। ইসলামি আদর্শ, মুসলিম ঐতিহ্য ও পাকিস্তানের জাতীয়চেতনার ভিত্তিতে যে আবেগ কবির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, তা সমকালে ছিল অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং উদ্দীপনা-ভরা। আর, তার এই চেতনার অন্তরালে রয়েছে বিরাট-ব্যাপক ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক বাস্তবতা। যে ভারতবর্ষে প্রায় ৫ শত বছর মুসলমান শাসন-ব্যবস্থা চালু ছিল, সেখানে জীবন-প্রবাহে এবং ভাষা-প্রয়োগে ইসলামিচেতনা এবং আরবি-ফারসি মিশ্রিত ভাষার প্রভাব অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই সত্যটুকুকে অস্বীকার করলে ভারতের ইতিহাস এবং দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কৃতিকে অস্বীকার করা হয়। কাজেই সমাজসচেতন ও ঐতিহ্যলগ্ন কবিতা-কারিগর ফররুখের চিন্তাপ্রকাশের ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি আমাদেরকে আরো মনোযোগী এবং শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। খণ্ডিত মূল্যায়নে ‘ইসলামি পুনর্জাগরণের কবি’ বলার চেয়ে ‘জাতীয় সংকট-উত্তরণের কবি’ বলাটাই বেশি প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক হবে।

ভাগ্যবান কবি ফররুখকে খ্যাতির জন্য প্রবীণতার সীমানা ছুঁতে হয়নি কিংবা পেরুতে হয়নি মরণের মহাপ্রাচীর। সমকালে এবং প্রখর তারুণ্যে তিনি ঈর্ষণীয় কবি-স্বীকৃতি ও সাফল্য পেয়েছেন। পাঠকের কাছে, অনুজপ্রতীমদের কাছে তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন আদর্শ। ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভায় তিনি সমকালের সকল সাফল্যের বারান্দায় হেঁটেছেন দাপটের সঙ্গে। সাধনা এবং চর্চাতো ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তবে, প্রতিভাটা যে বিধাতাপ্রদত্ত, সে কথা অস্বীকার করা চলে না। প্রসঙ্গত, নোবেল বিজয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের কথা আমরা এখানে টানতে পারি। সৃষ্টিকর্তার সহানুভূতি যে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছেন, তা তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। তার প্রতিভা যে ‘গড-গিফটেড’ তার অনুভব রয়েছে ‘গীতাঞ্জলি’র ৫৬ সংখ্যক কবিতায়। তিনি বলছেন : ‘তব সিংহাসনের আসন হতে/এলে তুমি নেমে/মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে/দাঁড়ালে, নাথ, থেমে।’ কবির বাণীর মধ্য দিয়ে স্রষ্টা যেন নিজেকে প্রচার করে চলেছেন এমন আভাস পাওয়া যাবে ‘গীতাঞ্জলি’র ১০১ সংখ্যক কবিতায়ও : ‘আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি/রচিয়া তুলিছে বিচিত্র এক বাণী।/তারি সাথে, প্রভু, মিলিয়া তোমার প্রীতি/জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি,/আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে/আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান।/হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ।/কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।’

নিবিড় পাঠে লক্ষ্য করা যাবে যে, ফররুখের কবিতায় আছে আনন্দধারার অবিরাম প্রবাহ। তিনি লালন করেছেন জাতীয় চেতনা। ফররুখের কবিতার তাত্ত্বিক বিবেচনা হয়তো কম হয়েছে। কিন্তু যদি তার কবিতার কাঠামো, সমকালীন ও উত্তরকালীন প্রাসঙ্গিকতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন ওঠে, তাহলে নিশ্চিতভাবে উত্তীর্ণ কবি। কবিতার বিশ্লেষণ আজ আর কেবল সমাজ-পরিসরে সীমাবদ্ধ নয় এর সাথে যুক্ত হয়েছে বহুবিধ নিরীক্ষা। কবিতার বিবেচনায় এখন উত্তর-উপনেশিকতা, বিনির্মাণতত্ত্ব এমনকি ফর্মালিজমও প্রাসঙ্গিক বিষয়। আর আছে সমাজ-ভাষা এবং সমাজ-মনস্তত্ত্বের মতো কঠিন কিছু বিষয়াদিও। তাই, ফররুখের কবিতাকে কেবল ঐতিহ্যের অনুসারি কিংবা নবজাগরণের ডালায় ভরে না রেখে উত্তরকালীন সমালোচনায় পাল্লায় তুলে দেখতে হবে। তার ভাষা ও প্রকরণ, কাঠামো ও পরিবেশনা আমাদের কালে কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে রইল, তা হালকাভাবে দেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে ফররুখ-প্রতিভার প্রতি একপ্রকারের অবিচারই করা হয় বৈকি! কোনো কোনো ক্ষেত্রে, তার পরিসীমা কতটুকু তা নিরূপন না করেও বলা চলে, কবি ফররুখ আহমদের ভাষা, কাঠামো এবং প্রকাশভঙ্গি বর্তমান প্রজন্মের কবিদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সাহিত্য-সংগঠন ফররুখের চেতনাকে লালন করে চলেছে নীরবে ও প্রকাশ্যে। ফররুখের ভাষা যেন উত্তরকালে একটি প্রজন্মের সাহিত্যভাষার মর্যাদা পেয়েছে।

আমরা যখন ফররুখ-সাহিত্য পাঠ করি, তখন বোধহয় অজান্তেই নীরবে কিংবা প্রকাশ্যে নিবিড় অনুভবশক্তি আর জ্ঞানভুবনের আহ্বান শুনতে পাই। এখন প্রয়োজন, ফররুখের কবিতাকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্য-পরিসরে সম্প্রসারণ এবং বিশ্ব সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে তার উত্তরকালীনতা ও আন্তর্জাতিকতার প্রাসঙ্গিকতা-বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ।

লেখক : অধ্যাপক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থপ্রণেতা।

 
Electronic Paper