এ যুদ্ধ রুধিবে কে
দুলাল চন্দ্র দে
🕐 ৪:০৪ অপরাহ্ণ, মে ২০, ২০২২
রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের দুই মাসের অধিককাল অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। হামলা পাল্টা হামলায় যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে রাশিয়ার কৃষ্ণসাগরীয় নৌ শক্তির অন্যতম প্রতীক ‘মস্কোভা’ যুদ্ধ জাহাজ অজ্ঞাত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ডুবে যাওয়া নিয়ে উত্তেজিত রাশিয়া আক্রমণের তীব্রতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে ইউক্রেনের যেটুকু ধার করা শক্তি বজায় ছিল তাও প্রায় একপ্রকার দুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনের কৌশলগত বন্দর শহর মারিয়োপোল বলতে গেলে এখন রাশিয়ার কব্জায়। এই শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে অবস্থিত স্টিল প্ল্যান্টের অভ্যন্তরে/ পাতাল কুঠুরিতে বহু সংখ্যক ইউক্রেনীয় সৈন্য স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকটা মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অবস্থান করছে। রুশ সৈন্যরা উক্ত এলাকা ঘেরাও করে আত্নসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দিলেও তারা তাতে রাজি হয়নি। ফলে আত্নসমর্পণ কিংবা মৃত্যুবরণ এ দুয়ের মাঝখানে তাদের ভাগ্য ঝুলে রয়েছে। এদিকে রুশরা দুরন্ত গতিতে দনবাস অঞ্চল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে অগ্রাভিযান অব্যাহত রেখেছে। ক্রিমিয়া পূর্ব থেকেই রাশিয়ান অধিকৃত অঞ্চল। এখন দোনেৎস্ক, লুহানক্স-সহ পুরো সাগর তীরবর্তী এলাকা রাশিয়ার করপুটে চলে আসবে।
মূলত রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্যও ছিল তাই। সমগ্র ইউক্রেন করায়ত্ত করার ইচ্ছা তাদের কখনো ছিল না। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রকারান্তরে বারকয়েক তা উল্লেখ ও করেছেন। ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করার কারণেই এ যুদ্ধের সূত্রপাত। বাল্টিক সাগর উপকূলবর্তী একের পর এক রাষ্ট্র যেভাবে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ন্যাটোর লেজ ধরে রাশিয়াকে ঘেরাও করে ফেলেছে তাতে রাশিয়া নিজেই অনিরাপত্তায় ভুগে কাহিল হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনও রাশিয়ার আক্রমণের ভয়ে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে রেখেছে যা আগামী জুনে অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা। এ সকল রাষ্ট্রের ন্যাটোভুক্ত হওয়া মানেই এটা তাদের রক্ষাকবচ বলে একটা পরম স্বস্তির বিষয় হয়ে উঠে। কারণ ন্যাটোর সংবিধান অনুযায়ী কোনো সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে সমগ্র সংস্থা আক্রান্ত হয়েছে মর্মে ধরে নেওয়া হয় এবং এক যোগে সকলেই শত্রু পক্ষকে প্রত্যাঘাত করতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। এই কারণেই ন্যাটোভুক্ত কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে কেউ গায়ে পড়ে বড় একটা ঘাটাতে যায় না। সোভিয়েত যুগের ওয়ারশ জোটভুক্ত অনেক দেশই বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য পদ গ্রহণ করেছে। রাশিয়ার বড় প্রশ্ন হল ওয়ারশ জোট বিলুপ্তির পর ন্যাটো জোটের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।
আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাশিয়াকে ঘেরাবন্দি করে যে ঘায়েল করার চেষ্টায় লিপ্ত। এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সরল অঙ্কটির মর্ম বুঝতে পেরে ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির পূর্বেই চতুর পুতিন আক্রমণ করে বসেছে। ওদিকে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকেও ন্যাটোভুক্তি থেকে বিরত থাকার জন্য হুমকিধামকি দিয়ে রেখেছে এবং সীমান্তে দস্তুরমতো সেনাবাহিনী মোতায়েন করে রেখেছে। ইউক্রেনের বেলায় পুতিনের হিসেবে একটু ভুল ছিল বলে মনে হয়। কারণ রাশিয়া যে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে ইউক্রেন দুগ্ধপোষ্য শিশু নয় যে আগে থেকে তা তারা বুঝতে পারেনি।
অথচ অনেক পূর্ব থেকেই যুদ্ধ লড়ার অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ সবকিছুরই প্রস্তুতি ছিল তলে তলে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার গোয়েন্দা রিপোর্টে কিছুটা দুর্বলতা ছিল বলে অনুমিত হয়। নতুবা এত বড় পরাশক্তির দাপটের কাছে ইউক্রেনের এতদিন টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। হোক বিদেশি সাহায্যপুষ্ট। ভালুকের থাবার নিচে ইঁদুর ছানা যে দৌড়ের খেল দেখাচ্ছে তাতে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পুতিনের কপালে কয়টা চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তা গুনে দেখার বিষয় বটে। তদুপরি ‘মস্কোভা’ ডুুবিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি বাস্তবিক পক্ষে বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ দিকে এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক বেদম উপভোগ্য বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি।
কৃষ্ণসাগরের অতন্দ্র প্রহরী মস্কোভা ধ্বংসের উৎসব পালনে রসজ্ঞ জেলেনস্কি মত্ত হয়ে উঠলে ও পুতিন ঠিকই বের করে ফেলেছেন এর নেপথ্যের রহস্য। টেসলা, টুইটার ও ব্যক্তিগত স্যাটেটলাইটের কর্ণধার আমেরিকার ক্রোড়পতি এলন মাস্কের স্টার লিংক স্যাটালাইটের বদৌলতেই যে এই ধ্বংসাত্মক কাণ্ড ঘটেছে এ ব্যাপারে রাশিয়া সন্দেহ পোষণ করে। রাশিয়ার অন্ধের মতো এলোপাথাড়ি বোমাবাজির জবাবে ইউক্রেনের মেপে মেপে প্রতিরোধাত্মক পদক্ষেপে রাশিয়ার অগনিত ট্যাংক, রকেট লাঞ্চিং প্যাড, হেলিকপ্টার যুদ্ধ বিমান ও ড্রোন ধ্বংস হয়ে গেছে। এত নিখুঁত আক্রমণের বাহাদুরিটা কার প্রাপ্য তা জেলেনেস্কি না জানলেও বাইডেনের অজানা নয়।
কেজিবির এককালীন প্রধানের বিষয়টি বুঝতে এত বিলম্বের হেতু বোধগম্য নয়। কারণ যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিনের মাথায় এলন মাস্ক মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, তিনি চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই রাশিয়ার বারটা বাজিয়ে দিতে সক্ষম। এখন এলন মাস্কের স্যাটালাইটের বিষয়ে পুতিনের সিদ্ধান্ত কী তা ভবিষ্যতই জানে।
পুতিনের বর্তমান মানসিক অবস্থা বেগতিক। ন্যাটোর প্রায় সকল রাষ্ট্রই সৈন্য, অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে। সেদিক থেকে এ যুদ্ধে একলা পুতিন ন্যাটো জোটের বিরুদ্ধে লড়ছে বিশেষ করে আমেরিকার বিরুদ্ধে। তদুপরি অগনিত অবরোধের ফলে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এ সবের কারণে পুতিনের মাথায় কখন যে কি জেদ চেপে বসে তার ঠিক নেই। এমনিতেই পুতিন প্রায় নিঃসঙ্গ। তার আশপাশে সমমানের এমন কোনো নেতা নেই যে তিনি তার কাছে মনের কথা অকপটে খুলে বলতে পারেন। পক্ষান্তরে ন্যাটোর বড় বড় রাষ্ট্রের নেতারা একসঙ্গে বসে ছক কষতে পারেন, একজোট হয়ে অন্তরের সাহস বজায় রাখতে পারেন। মুখ্যত তারা সকলেই সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যে হারে বেশুমার বোমার ব্যবহার হচ্ছে তাতে মানব সংহার ছাড়াও অর্থনীতি বিশেষ করে প্রকৃতির উপর বিশাল একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। করোনা যাব যাব করে এখনো চোখ রাঙাচ্ছে। প্রকৃতির রোষানলে পড়ে মানুষের ভাগ্যে কী যে লেখা আছে কে জানে।
এ বিপদ সংকুল সময়ে আমেরিকার উচিত পুতিনের সঙ্গে অতি সত্বর আলোচনা করে সমাধান বের করা। বিশ্ব মোড়লের দাবিদারকেই এগিয়ে আসতে হয় সর্বাগ্রে। তা না করে সবাই ঘিরে ধরে রাশিয়াকে পিষে মারবে এমন চিন্তা করলে বিশ^ পরিস্থিতি শতাধিক হিরোশিমা নাগাসাকির পরিণতির দিকে ধাবিত হবে। সপ্তরথির চক্রব্যূহ থেকে পুতিনের বের হওয়ার একমাত্র উপায় কি পরমাণুর প্রয়োগ? ওদিকে চাইনিজ ড্রাগন লোভাতুর থাবা মেলে তাইওয়ানকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়ার মহড়ায় লিপ্ত। মহাপ্রলয় শুরু হলে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যাবে না যে কে কার আগে পারমাণবিক বোমার বোতাম টেপাটেপি করবে। সভ্য জগতের নেতাদের এ ক্ষেত্রে ভব্য আচরণ পৃথিবীবাসী মানুষের একান্ত কাম্য। পৃথিবীকে কটাক্ষ করলে কোনো রাষ্ট্রই প্রাকৃতিক আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাবে না। বড় বড় নেতার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সারা বিশে^র শান্তিকামী সাধারণ মানুষের উচিত এখনই এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।
দুলাল চন্দ্র দে : লেখক ও কলাম লেখক