ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সমাজের চিত্রণ, মানবতার বার্তা

আবু আফজাল সালেহ
🕐 ৪:০০ অপরাহ্ণ, মে ২০, ২০২২

সমাজের চিত্রণ, মানবতার বার্তা

কবিকে হতে হয় অন্তর্মুখী। চিন্তা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে কবিতা। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টোটাই। কথাশিল্পীকে হতে হয় বহিঃমুখী। বাইরের চিত্রণ কথাশিল্পে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কথাশিল্পী ইমরুল কায়েসের ২২টি ছোটগল্প নিয়ে ‘বউনটী’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। ভাবনা প্রকাশ থেকে। ১১০ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। অমর একুশে বইমেলা ২০২২-এ প্রকাশিত বইটি। আল নোমান’র প্রচ্ছদ আর সুলাইমান সাদীর পৃষ্ঠা বিন্যাস চোখে পড়ার মতো।

কেরামত মাঝির নিশিরাণী, ফাদার তেরেসা, মাস্ক, কলকি, ভেলা, জামাই জব্দ, বউনটী, অথবা শকুন্তলা, জল জোছনার গল্প, অচিন বন্দরে নোঙর, বাকবাকুম, চা চামেলী, হলিউড সেলুন ইত্যাদি শিরোনামীয় গল্প এ বইতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফ্ল্যাপে প্রবাসী কথাসাহিত্যিক সালেহা চৌধুরী লিখেছেন, ‘বইটিতে পেয়েছি চিত্রময় ভাষা, করোনাকালের যন্ত্রণা; দেহাতি প্রান্তিক মানুষ ও জীবন...।’ এছাড়া ‘বউনটী : একটি ধূলিচিত্রের ক্যানভাস’ শিরোনামীয় ভূমিকাটাও তার লেখা। গল্পগুলো আলোচনা করলে আলোচিত বইটি স¤পর্কে তার এ মূল্যায়নের যথার্থতা প্রমাণিত হয়। গল্পগুলির প্লট নির্মাণে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। করোনা বিশ্বব্যাপী গ্রাস করছে, আমাদের ফাঁক-ফোকর বা দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে।

মানবতা ও আমাদের স¤পর্কে যে কৃত্রিমতা রয়েছে, সম্পর্ক স্বার্থের ওপর নির্ভর করে থাকে তা করোনাকাল দেখিয়ে দিয়েছে। এসবের নানাবিধ খুঁটিনাটি বিষয় উঠে এসেছে ইমরুল কায়েসের আলোচিত গ্রন্থের বিভিন্ন গল্পে। করোনাকালীন বিভিন্ন নতুন বা অপরিচিত শব্দ উঠে এসেছে গল্পে। সাহিত্যে এ প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। লেখক দক্ষ নাবিকের মতো এগিয়ে এলেন।
জোতদারের জীবন আছে, উঁচুস্তরের জীবনের কথা আছে। অফিসিয়াল ডেকোরামের কথাও উঠে এসেছে কোনো কোনো প্লটে। আমরা জানি, সাহিত্য হচ্ছে সমাজের দর্পণ। লেখক গল্পের অবতারণা করতে মাছির মতো অসংখ্য চোখ রেখেছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরে, খাঁজে খাঁজে। চরিত্রায়ণে বাংলার প্রধান দু-ধর্মের লোক ও কৃষ্টি কালচার তুলে ধরা হয়েছে।

অচ্ছ্যুত থেকে অফিসার, রাজনীতি সবই উঠে এসেছে গল্পের পরতে পরতে। আঞ্চলিক সংলাপ, শব্দাবলি ও বাক্যের প্রয়োগ দেখা যায় বেশ কিছু গল্পে। ‘ঘরের বাহিরতন আইয়েক আবুইল্লা! আইয়্যে দ্যাখ, আইজকে ঢাহা ফকফকা (কলকি)’, ‘কস কি? সর দেহি’ (অচিন বন্দরে নোঙর) ইত্যাদির মতো আঞ্চলিক সংলাপ দেখা যায় আলোচিত গ্রন্থটির বিভিন্ন গল্পে। চাঁদ, গামছা, কলকি, নাং ইত্যাদি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশের কথা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন গল্পে। সামগ্রিক চিত্রায়ণ পাঠককে ঠকাবে না বলে মনে করি। ‘প্রতিদিন সকালে কলেজে যাওয়ার পথে বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে এসে অজানা কারণে বাইসাইকেলের গতি কমে যেত’ (স্মৃতির ঘ্রাণ), ‘বাপের বাড়ি থাকি নাকি একটা তিন বছরের ছোট চেংড়ার সাথে পালাইছে!’ (বউনটী), ‘(শ্যামলা) অচ্ছুত নীচু জাতের হিঁদুর মেয়ে। শুধু শরীরের গন্ধ আর ভাঁজের দাম আছে; মনের কি একপাই দামও নেই!’

(নাং) ইত্যাদি সংলাপ ও কথোপকথনই বলে দেয় সমাজের চিত্রণ ভালোভাবেই করতে পেরেছেন ইমরুল কায়েস। গল্পগুলোর মূল ফোকাস বা বার্তা হচ্ছে মানবতা। ঘটনার পরপরা পাঠককে মুগ্ধ করবে। বিভিন্ন গল্পের এমনকি একই গল্পে সংলাপে বৈচিত্র্য পাঠককে বিভোর করতে সক্ষম। প্রথম প্যারা ভালো বা হৃদয়গ্রাহী হলে পাঠককে গল্প শেষ করতে প্রলুব্ধ করবে।

প্রাসঙ্গিকতাও কিন্তু সাহিত্যের সফলতার একটি অনুষঙ্গ। আমরা দেখি, প্রথম গল্পের (কেরামত মাঝির নিশিরাণী) প্রথম দিকে গা-ছম-ছম আবহ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। অন্যগল্পগুলোতেও প্রথম দিকের অংশ পাঠককে পড়ার জন্য প্রলুব্ধ করবে। এখানেই লেখকের সাফল্য। ছোটগল্পের প্রতিটি শব্দ খুব হিসাব করতে হয়। শব্দচয়নের দক্ষতার ওপর গল্পের মান নির্ভর করে। অনেক শব্দ আছে যা ছোট ছোট বাক্যের কাজ করে থাকে। কিন্তু অযথা সম্প্রসারণ বা সংলাপ ছোটগল্পের চরিত্র নষ্ট করতে পারে। এক্ষেত্রে কথাশিল্পী ইমরুল কায়েস যথেষ্ট প্রশংসার দাবি করতে পারবেন বলে মনে করি। ‘বউনটী’র প্রতিটি গল্পে সুসংগঠিত প্লট নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন লেখক ইমরুল কায়েস। প্লট নির্মাণে লেখক প্রশংসার দাবিদার বলে মনে করি। কৌশলী বিশেষণ ও ক্রিয়ার ব্যবহার গল্পের অন্তঃপ্রাণ হয়ে ওঠে। আলোচিত গল্পকার এক্ষেত্রে সফল বলে মনে করি। গল্পগ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

আবু আফজাল সালেহ : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক, চুয়াডাঙ্গা

 
Electronic Paper