গান শুধু বিনোদনের বস্তু না
শ্রীকান্ত আচার্য
🕐 ৯:২৫ অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০১৮
সুরের ধারার ২৫ বছর পূর্তিতে এসেছিলেন বাংলাদেশে। বাংলা গানের প্রথিতযশা এই শিল্পী সাক্ষাৎকার দিতে গররাজি ছিলেন। পীড়াপীড়িতে সময় দেন পাক্কা আধা ঘণ্টা, কথায় কথায় যা গড়ায় দেড় ঘণ্টায়। খোলা কাগজ-এর কাছে তুলে ধরেন সুর-সংগীত ও জীবনাভিজ্ঞতার সারাৎসার। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জগন্নাথ বিশ্বাস
(আজ শেষ পর্ব)
সলিল চৌধুরী, সুধীন দাস, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, প্রতুল মুখোপাধ্যায়...এদের হাতে বাংলা আধুনিক গানের যে ধারা তৈরি হয়েছিল তাও কি শুকিয়ে গেছে?
দেখুন, বাংলা গানের ধারা সব সময় এক থাকবে না। এ কথা স্বীকার করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কথাই ধরুন, তিনি কিন্তু এক ধরনের গান তৈরি করেননি। সারা জীবন গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তা ছাড়া মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা এসব কিছু গানের ধারাকে প্রভাবিত করে। ২০ বছর আগে আমাদের যা ভালো লাগত সে অনুভূতিগুলো লেখায় এবং ভাবনাচিন্তায় প্রতিফলিত হতো। ২০ বছর পরেও সেই একই প্রতিফলন হওয়ার কথা নয়। এখন আপনি বা আমি এমন নতুন কিছু দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি যা আমাদের ভাবনাচিন্তা, লেখা, জীবনযাপনকে নাড়া দিচ্ছে। এ প্রভাব গান-বাজনাতে পড়াটাই স্বাভাবিক।
পৃথিবী এখন ছোট হয়ে আসছে। এক দেশের সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে অন্য দেশের ওপর। প্রযুক্তির প্রভাব পড়ছে। এবং এসবের মাধ্যমে যে ব্যাপক বিনিময় চলছে, অনেকটা ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে’র মতো, গানেও তার একটা ঢেউ এসে লাগছে। বাংলা গানের ধারাও তাই পাল্টে যাচ্ছে। গান তো কোনো স্থবির জিনিস নয়। ৫০ বছর আগের মতো তা কেন স্থির থাকবে।
মিউজিক, ক্রিয়েটিভ আর্ট, এসব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবেই। রবীন্দ্রনাথই তো বলেছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা বদলায় না তার মৃত্যু ঘটে। ব্যাকরণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর সংস্কৃত ভাষার মৃত্যু হয়েছিল। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বদলায় বলেই এটা জীবন্ত। সংগীতের ক্ষেত্রেও ব্যাকরণ বদলে যাচ্ছে। হয়তো বাংলা গানের মৌলিক প্রিন্সিপাল আগের মতোই আছে। তবে নিরন্তর ভাঙাগড়া আর নিরীক্ষা কিন্তু চলছেই। সে কারণেই হয়তো বাংলা গান এখনো সচল আছে। তা ছাড়া নতুন মানুষ নতুন সময়ের জন্য নতুন গান তৈরি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এভাবেই সংগীত আলাদা চেহারা নিয়ে, রাস্তা বদল করে। বাংলা গানকে যদি আমরা নদীরূপে কল্পনা করি, তাহলে বলতে হয় স্রোতের সঙ্গেই সে ঘাটে ঘাটে বাঁক বদল করতে করতে বয়ে চলছে। এখন এ ঘাটে এক রকম ঢেউ উঠেছে। পরে অন্য ঘাটে অন্য রকম ঢেউ উঠবে। পাড় ভাঙার শব্দও হয়তো শুনতে পাব কখনো। তবে ‘আপন বেগে পাগল পাড়া’র মতো বয়ে চলার গতি থামবে না। স্রোতাপন্ন এ চলমান অভিজ্ঞতাকে আমাদের মেনে নিতে হবে।
তবুও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। রবীন্দ্রনাথের মতো অলোকসামান্য প্রতিভার হাতে বাংলা গান আধুনিক হয়েছিল। এই পরিণত সময়ে সেই বাংলা গানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কি আরও বেশি ছিল না?
এখানে দুটি বিষয় আছে, আপনি লোককে এন্টারটেইন করার জন্য গান করছেন না আপনার ভেতর কোনো সৃষ্টির তাগিদ আছে? গান তৈরির ক্ষেত্রে এ দুই অ্যাটিচিউডের বিস্তর তফাৎ। রবীন্দ্রনাথ কি লোকের মনোরঞ্জনের জন্য গান লিখেছেন? অস্বীকার করছি না, লোকের অনুরোধে অনুষ্ঠানের জন্য তাকে অনেক গান রচনা করতে হয়েছে। অনুরোধ রাখতেও তিনি সৃষ্টির তাগিদ কিন্তু ভুলে যাননি। ভেতরে ছটফটানি সব সময়ই ছিল। গীতবিতানের প্রথম গানটির কথা মনে আছে...কান্না-হাসির দোল দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা...শেষ স্তবকে বলছেন...শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ^ভুবন-মাঝে/অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে...অর্থাৎ বেঁচে থাকার অজস্র অভিঘাত, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ কত কিছুর আঘাতে যে আমাদের হৃদয় তন্ত্রী বেজে ওঠে আর এমন একটা গান তৈরি হয়...আমি ঠিক জানি...এ উৎসার কেমন করে সম্ভব? কাউকে নাচিয়ে দেওয়া, মাতিয়ে দেওয়ার জন্য এ গান তৈরি হতেই পারে না। উনি প্রাণের তাগিদে লিখেছেন। কারও এন্টারটেইন করার জন্য লেখেননি। আমরা বোধ হয় ভুলেই গেছি, গান কেবল বিনোদনের বস্তু নয়। এর উদ্দেশ্য আরও মহৎ। রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, আত্মার সুর রচনা করবে মানুষই। এ আত্মিক দায়বোধের জায়গা থেকে এখনকার গান সরে গেছে। এখন মনোরঞ্জনের বিষয়কে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সবকিছু কেমন সুপারফিশিয়াল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বুঝতে হবে, গান কেবল বিনোদন নয়, আরও বেশি কিছু। একটা মানুষ যখন...আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...গায় তখন সুগভীর আবেগ আর মহত্তম প্রেরণা কাজ করে...এরকম গান সৃষ্টির জন্য সততার দরকার হয়। এ সময়ের বাংলা গানে আত্মিক সততার অভাব দেখা দিয়েছে। তাই সব সুপারফিশিয়াল হয়ে যাচ্ছে। গানটাকে ওপরে ওপরে এত গ্লামারাস করে তুলছি, ভেতরটা অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাচ্ছে। গানের কথা এবং কম্পোজিশনের ভেতরে প্রাণ নেই। কিছু গান বাদে কথা আর সুরের সেই ম্যাগনেটিজম, সেই ইউনিক টাচ খুঁজে পাই না। শপিংমলের চাকচিক্যের মতো বাহ্যিক গ্লামারে ভরে উঠছে বাংলা গান। সর্বত্র অপদার্থ এক বাণিজ্যিক চর্চার প্রতিযোগিতা। সবাই যেন ভঙ্গি দিয়ে ভোলাতে চাইছে। বাংলা গান শুনে এখন আর চোখে জল আসে না। বাংলা গান অগভীর হয়ে গেছে।
কবীর সুমন বোধ হয় একবার ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা গানে তেমন কিছু হচ্ছে না। তিনি নিজে ও আরও কয়েকজন একটু চেষ্টা করছেন। আপনার কি মনে হয় ?
আমাদের গান এবং সাহিত্য (কবিতা) খুব কাছাকাছি ছিল। আমাদের কবিতা এখনো বিশ্বমানের। এর দারুণ স্ফুরণ আছে। তুলনায় বাংলা গান যেন নিভে যাওয়া দীপ। মানের ক্ষেত্রে বাংলা গান তার জায়গাটা ধরে রাখতে পারল না কেন? রবীন্দ্রনাথের মতো অসামান্য প্রতিভাবানের কাছ থেকে আমরা তাহলে কী শিখলাম? এখন পর্যন্ত গানের লিরিকের কাব্যময়তা বিচার করলে রবীন্দ্রোত্তর যুগে সুমনদার মতো আর কেউ নেই। তার মতো গান স্বর্ণ যুগে মাঝে মাঝে কেউ হয়তো লিখেছেন, কিন্তু তারা সুমনদার মতো ধারাবাহিক ছিলেন না।
আমরা যে স্বর্ণযুগের কথা বলি, সে সময়ের অনেক গান শুধু সুরের কারণে জনপ্রিয় হয়েছিল। কথার সাহিত্যমান আহামরি কিছু ছিল না। অনেক গান আমার গাইতে গিয়ে মনে হয়েছে, বিশেষ করে প্রেমের গান, কেমন জোলো, একপেশে, আমি, তুমি, ন্যাকা ন্যাকা রূপ বর্ণনা বা ইমপ্রেসের ধরন....কিন্তু সুরটা ভালো ছিল বলে গানটা উতরে গেছে। আর যারা গেয়েছেন তারা ছিলেন অসামান্য শিল্পী। সুমনদার কণ্ঠে প্রেমের গান শুনেছি, সলিল চৌধুরী, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রেমের গান লিখেছেন।
কিন্তু সেসবের মধ্যে একটা ঋজু ব্যাপার ছিল। না মনো লাগে না যখন গাইছেন...বা আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমের/চাঁদ ফুল জোছনার গান আর নয়/ওগো প্রিয় মোর/খোল বাহুডোর/পৃথিবী তোমারে চায়...ব্যক্তি প্রেমের চেনা গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর কোলাহলে এসে দাঁড়ানো...এ ব্যাপারটাই তো কথার ব্যাপ্তিকে বিপুল সম্ভাবনার সামনে এনে ফেলছে।
তবে আমার মনে হয়, কমার্শিয়াল গানের অপদার্থতার কথা বাদ দিলে এ সময়ের বাংলা গান অনেক বেশি লিরিক্যাল। লিরিকের ধরন যদিও বদলাচ্ছে। আগে কবিতা এবং গানের যে সুস্পষ্ট ব্যবধান ছিল। এখন সেই ব্যবধান কমছে। সমকালীন বাংলা কবিতার সরাসরি প্রভাব এখন বাংলা গানে দেখছি। এই নিরীক্ষা কারও ভালো লাগছে, কারও লাগছে না। তবে হচ্ছে। হওয়াটা জরুরিও। এ নিরীক্ষার ফলে আমরা হয়তো বাংলা গানে নতুন রাস্তা দেখতে পাব।
বাংলাদেশি মিউজিশিয়ানদের কেমন লাগে আপনার?
এখানে তো অসাধারণ কিছু মিউজিশিয়ান আছে। বাপ্পার গান ভালো লাগে। ওর গলাটাও ভালো। জলের গান ভালো। কিছু নাম হয়তো বলতে পারব না কিন্তু তারা ভালো কাজ করছে। তবে একটা কথা, এখানকার জল-বাতাসের গুনেই কি না জানি না, বাংলাদেশে অসামান্য কিছু লোক সংগীতের শিল্পী আছে। কিরণ দাকে (কিরণ চন্দ্র রায়) আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। উনি অসামান্য লোকশিল্পী।
খোলা কাগজ-এর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
আমারও আন্তরিক অভিনন্দন রইল।