ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভালো থাকুক মা

ইলা মুৎসুদ্দী
🕐 ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ, মে ১৮, ২০২২

ভালো থাকুক মা

প্রতিবছর মা দিবস পালিত হয়। আমার ইচ্ছে কওে মা, মা দিবসে তোমার সঙ্গে পুরোটা দিন কাটাতে। তোমাকে একটা শাড়ী কিনে দিতে। কিন্তু মা নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর। নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে আমরা বড় অসহায়। এই নিয়তির কাছে আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। তাইতো ধাবমান সময়ের গণ্ডিতে সবকিছু নিজেদের ইচ্ছেমতো করা যায় না। তোমার মৃত্যুর পর বুঝেছি, কে কখন, কীভাবে কোথায় চলে যাবে কেউ আগে থেকে বলতে পারে না।

মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই, মায়ের মতো অতি আপন, এই পৃথিবীতে নাই। যখন ছোট ছিলাম, তখন সবসময় মা নিয়ে ছড়াটি পড়তাম। কিন্তু সেটির অর্থ গভীরভাবে বুঝতাম না। যখন বড় হলাম শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোর কিংবা কৈশোরের গণ্ডি পেরিয়ে তারুণ্য তখনো এই মা শব্দটির অর্থ আমি বুঝিনি। অথবা বুঝতে চাইনি। কারণ চিরমমতাময়ী মা তো আছেই আমার পাশে সুখে, দুঃখে যে কোনো অবস্থাতেই। আমি মা ডাক দিলেই মাকে পাচ্ছি। তখনো মা হারানোর কষ্ট কিংবা যাদের মা নেই তাদের অনুভূতি আমার কাছে ছিল অস্পষ্ট। আমি মায়ের আদরে, স্নেহে, মায়া-মমতায় এমনভাবে ছিলাম যে, আমার বিয়ে হওয়ার পরও কোনোদিন মাকে না পাওয়ার কষ্ট অনুভব করতে হয়নি।

মা আমার সঙ্গে মনের সব ছোট ছোট সুখ, দুঃখগুলো শেয়ার করতেন। আমিও আমার সব কথা একমাত্র মায়ের কাছেই বলতাম। কারণ মা-ই ছিল আমার পরম বন্ধু, মিত্র এবং আমার সবকিছু। যদি ২ সপ্তাহ কিংবা ৩ সপ্তাহ পর কাজের চাপে মাকে দেখতে যেতে একটু দেরী হতো, দেখতাম, মা যেমন করে কষ্ট পাচ্ছেন, ঠিক একই ভাবে আমারও কষ্ট লাগছে। এই কষ্টগুলো কাউকে বোঝানো যায় না, শুধু অনুভবযোগ্য। মাকে একবার একজন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্বর্ণ কতগুলো আছে? মা বলতেন আমার চার ছেলেমেয়ে আমার কাছে স্বর্ণ।

আমার আলাদা করে স্বর্ণের দরকার নেই। মা যদি না থাকতো তাহলে সেই সময়ে গ্রামে থাকাকালীন যেখানে এসএসসি পাস করার আগে থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতেছে, সেখানে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করা অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। একমাত্র আমার মা শিক্ষার মর্ম বুঝতেন বলেই সবাইকে একবাক্যে না করে দিতেন আর বলতেন আমার মেয়েরা শিক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দিব না। মায়ের একাগ্রতার কারণে আজ আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি। এরকম মা যেন আমরা শত জনম লাভ করি।
সেদিন ছিল ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ সাল, বৃহষ্পতিবার। জানতাম না, সেদিন আমার পৃথিবীটা এভাবে দুলে উঠবে? সবুজ ঘাসের বুকে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলবে। তার আগের শুক্রবারে গিয়ে মাকে দেখে এসেছিলাম। আমার জন্য মা পিঠা বানিয়ে রেখেছিলেন। আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন।

একবারও বুঝতে পারিনি, সেই দেখা শেষ দেখা হবে। কত কথা বলেছিলেন মা। আমি শুধু অবাক নয়নে মায়ের মুখের কথা শুনছিলাম। আমার মা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গিয়েছিলেন। তখন মায়ের বয়স ৪৫-৫০ এর মধ্যে হবে। কাউকে কিছু বলার সুযোগই পাননি। আমরা চার ভাইবানের মধ্যে কেউ তখন মায়ের পাশে ছিলাম না। সবাই ছিল যার যার কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত। মা-বাবা বাড়িতেই থাকতেন। মায়ের মৃত্যুর পর বুঝেছি, মা শব্দটির অর্থ কী? মায়ের জন্য হৃদয়ের নীরব রক্তক্ষরণ কেউ থামাতে পারে না। আমার সবসময় মনে হয়, আহারে, আমার মা-টা যদি চোখের পলকে আবার চলে আসত। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কিংবা গাড়িতে বসলেও মনে হয়, আমার মাকে যদি আরেকবার দেখতাম। আমি সবসময় মাকে খুঁজি, ছোটবেলায় বাচ্চারা যেভাবে তাদের মাকে একপলক না দেখলে খুঁজে বেড়ায় ঠিক সেভাবে।

আমি মনে মনে মায়ের সঙ্গে কথা বলি, কোনো দুঃখ পেলে মাকে বলি এখনো। সেদিন বাসে একটি ছেলে মাকে মোবাইলে বলছে, মা আমার জন্য ভাত রান্না কর, আমি আসছি। আমার চোখে জল এসে পড়ল। আমি আর কোনো দিন মাকে সেই কথা বলতে পারব না। একটা সুন্দর শাড়ি দেখলে মনে হয়, এই শাড়িটা মাকে খুব ভালো লাগত। যদি মাকে কিনে দিতে পারতাম। এত কিছুর পরও মনকে বোঝাতে হয়, মাতো এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন, আমি শত মাথা কুটে মরলেও মা আর কোনো দিন আসবেন না। আসতে পারবেন না। পরিশেষে মাকে শুধাই, যে তুমি আমাদের না দেখলে অস্থির হয়ে যেতে, দিনরাত আমাদের চিন্তা করতে, আমরা কি খাচ্ছি, কিভাবে পথ চলছি, অসুখ-বিসুখ না হয়ে ভালোভাবে আছি কিনা, আমরা বাড়িতে গেলে কি খাব এতসব চিন্তা করতে সেই তুমি এখন কিভাবে এত নিশ্চিন্তে সেই অচিনপুরে থাকতে পারছ? একবারও তোমার মনে হয় না, তোমারি বিহনে তোমার সন্তানেরা কত কষ্ট পাচ্ছে। যেখানেই থাকো ভালো থেকো মা।

ইলা মুৎসুদ্দী : কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক

 
Electronic Paper