ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

লাভ কি (?)

মাসুদ কামাল হিন্দোল
🕐 ৯:৪০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৩, ২০১৮

আমার বন্ধু মামুন রশীদ। সে আমার সাংবাদিকতা জীবনের বন্ধু। একসঙ্গে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেছি। যদিও আমরা দুজন দুজনকে আপনি বলে সম্বোধন করি। সাংবাদিকতার চেয়ে সে সাহিত্য চর্চা করতে বেশি ভালোবাসে আমার ধারণা। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের সহকারী সম্পাদক। তাকে অনেকেই বগুড়ার কবি মামুন রশীদ হিসেবে চেনে। মামুন মজার মজার কথা বলে সবসময়। তার কথার মধ্যে উইট থাকে। তাকে কোনো কাজের কথা বললে সে প্রথমেই নাসিরউদ্দিন হোজ্জার কৌতুকের মতো বলে লাভ কি? এটা তার একটা কমন কথা। কেউ হয়তো বলতে পারেন মুদ্রাদোষ। হবে হয়তো।

মামুনকে যদি বলি একটা লেখা পাঠালাম উপ-সম্পাদকীয় পাতার জন্য। লেখাটা পেয়েছেন কি না? কবে ছাপা হবে? সে উত্তরে বলে, লেখা ছেপে লাভ কি? যদি বলি বইমেলায় যাবেন কি না, সে বলে লাভ কি? পিকনিকে যাবেন কি না? সে আবারও বলবে লাভ কি? তাকে যদি বলি অমুক লেখক ভালো লেখে। তখনো সে বলে তাতে আমার কি লাভ? অমুক সাংবাদিকের ভালো চাকরি হয়েছে। তাতেও আমার কোনো লাভের সুযোগ  নেই? অমুক লেখাটা পড়েছেন কি না? মামুন সেই ভাঙা রেকর্ডই বাজিয়ে যাবে। আমার প্রশ্ন অনেক মামুনের উত্তর একটাই। লাভ কি? এভাবেই চলছে আমাদের অম্ল-মধুর সম্পর্ক।
আমি অনেক ভেবে দেখেছি মামুন সত্যি কথাই বলে। বাস্তব কথা বলে। তার কথার ভেতর ভাবনার খোরাক আছে। তার কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া বা কথার কথা বলার সুযোগ নেই। লেখা পত্রিকায় ছাপালে তার লাভ কি? না ছাপালেই বা ক্ষতি কি? প্রতিদিনই তো অসংখ্য উপ-সম্পাদকীয়, মতামত বা কলাম ছাপা হচ্ছে জাতীয় পত্রিকায়। তাতে কি লাভ হচ্ছে দেশ জাতি বা সমাজের? ক’জনেইবা পড়ে এখন। যারা লেখেন তারা ন্যূনতম সম্মানীটুকুও পান না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। বইমেলায় গেলে কি আর না গেলে কি? কয়টা মানসম্মত বই প্রকাশিত হয়। অনলাইনে তো বই দেখা যায়। আবার কেনাও যায়। তারা বাড়িতেও বই পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ভাড়া খরচ করে ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে বইমেলায় গিয়ে কোনো লাভ আছে? পিকনিকে গিয়ে রাস্তায় অর্ধেক সময় পার করে খাওয়ার চেয়ে সেই টাকায় বাসায় তো ভালোভাবে হাত ডুবিয়ে আয়েশ করে পেট পুরে খাওয়া যাবে।
অধিকাংশ মানুষই এখন সবকিছুতে লাভ খোঁজে আগে। সার্চ দ্য লাভ। আগে লাভ পরে কাজ। বেশি কাজ বেশি লাভ। লাভ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করতে চায় না। এক পা সামনে এগিয়ে এলেও লাভ নাই শুনলে দুই পা পিছিয়ে যায় তৈলাক্ত বাঁশের মতো। একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে লাভের গুড় পিঁপড়ে খায়। পিঁপড়েদের এত সাহস নেই যে লাভের গুড় খাবে। বরং লাভের গন্ধ পেলে আমরাই পিঁপড়ের মতো লাইন দিই। লাভের কথা শুনলেই আমাদের কারও কারও জিহ্বা যেন লক লক করে ওঠে। আর্তমানবতার সেবাও এখন আমাদের দেশের মানুষ করতে চায় না। সেটাও করেন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। যতক্ষণ টিভি ক্যামেরা আছে ততক্ষণ দান-খয়রাত সেবা মানবতা সচল। অসুস্থ রোগীকে দেখতে গেলে সেখানে কুশল বিনিময়ের আগেই সেলফি তুলে তা পাঠিয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। রোগীর দিকে তাকিয়ে আড় চোখে দেখে কত লাইক বা শেয়ার হয়েছে। লাভ ছাড়া কুশল বিনিময় বা একজন আরেকজনের মঙ্গল কামনা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন। অবস্থা এমন হয়েছে লাভ ছাড়া কোনো কাজ করলে মানুষ তাকে সন্দেহের চোখেও দেখে কখনো কখনো। লাভের হিসাবটাই এখন আমাদের দেশে মুখ্য হয়ে উঠেছে। লাভ-লস হিসাব করতে করতে আমরা এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি অনেক। তারপরও আমরা লাভের আশপাশেই থাকতে চাই। নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতা শূন্য। এটাই যেন এখন আমাদের জীবনের মোটো। সব কাজ থেকে কিছু না কিছু ক্যাশ করতে চায়। জানি না এটাই হয়তো সময়ের চাহিদা। কোনো কাজের কথা বললেই আগে মোবাইলের ক্যালকুলেটর বের করে। হিসাব কষে দেখে তার কত লাভ হবে। তারপরই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। ই-জেনারেশনের মাঝে এই লাভ-লসের হিস্যা আরও বেশি জোরালো। প্রতিষ্ঠানেরও দায় আছে যে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি। তাই সিএসআর (করপোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি)-এর মাধ্যমে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সে দায় কিছুটা হলেও স্বীকার করে নিয়েছে। এবং পূরণ করার চেষ্টা করছে স্বল্প পরিসরে। কিন্তু সমাজের প্রতি  মানুষেরও দায় আছে। কর্তব্য আছে। মানুষের দায়ই সবচেয়ে বেশি।
সেটা তার নিজের প্রয়োজনেই। এ সত্য অনেক মানুষই মানতে চাচ্ছেন না। এই যে লাভ ছাড়া যে কাজগুলো। সেটাই সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে করতে হয় সমাজে বসবাসরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। যাতে সমাজ তার স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যেতে পারে সামনের দিকে আর দশজনকে সঙ্গে নিয়ে।
জীবনের সব কাজ লাভ-লোকসান হিসাব করে হয় না। একথা আমরা মুরুব্বিদের কাছেও শুনেছি। এভাবে জীবন চালানো যায় না। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো কয়দিন পর মানুষ লাভ ছাড়া প্রকৃতিও দেখতে চাইবে না। প্রকৃতি দেখেও কোনো লাভ নেই। প্রকৃতি তো এখন ইন্টারনেটে দেখা যায়। মানুষের চোখমুখেও লাভের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে অতিরিক্ত লাভের আড়ালে লোভ লুকিয়ে আছে বা থাকে। সে হয়তো দেখতে পায় না। আয়নাতে মানুষ নিজের সুন্দর চেহারাটাই দেখে। কুৎসিত রূপটা দেখতে পায় না। সে রূপ আড়ালে থাকে ঠিকই। কিন্তু সে লুকাতেও পারে না। ওই রূপ দেখে সমাজ। সমাজের মানুষ। লাভের কাছে আমাদের সবকিছু যেন পরাস্ত। লাভের হাল খাতায় বন্দি হচ্ছি আমরা।
মামুনকে এখনো আমি লাভের রাস্তা দেখাতে পারিনি। জানি না এ জীবনে কোনোদিন পারব কি না। লাভের রাস্তার পথ আমার জানা নেই। পুরো সমাজটাই যেন লাভের অঙ্কের ভারে তলিয়ে যাচ্ছে। যে যার মতো লাভের অঙ্কটা মিলিয়ে নিচ্ছে। মামুন যে কথাগুলো বলে এগুলো আসলে মামুনের কথা না। সমাজের রূপই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে অবচেতন মনে। এসব কথা বলে কি মামুন আমার ভেতরে ক্ষরণ ধরাতে চায়? সমাজ যে ভুল পথে হাঁটছে। সে বারবার আমাকে মনে করিয়ে দিতে চায়। যেসব মানুষ লাভের পেছনে গোল্লাছুট খেলছে। এমন ক্ষরণ তাদের ভেতরেও কি হয়? শুধু সময়-সুযোগ বা বলার মানুষ খুঁজে পান না তারা। আর এভাবেই কী দেশের মানুষ লাভের চোরাবালিতে পড়ে সমাজছাড়া জীবে পরিণত হতে চলেছে। এই লেখাটা লিখে কোনো লাভ হলো কি না জানি না? তবুও লিখলাম বিবেকের তাড়না থেকেই।

মাসুদ কামাল হিন্দোল : সাংবাদিক ও রম্যলেখক।
[email protected]

 
Electronic Paper