ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শুকটা-আইজুদ্দিনরা মুক্তিযোদ্ধা হন না!

নূরুজ্জামান
🕐 ৮:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩১, ২০১৮

গ্রামের সব নারী-পুরুষ-শিশুকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। গুলির অপচয় করা যাবে না। এক গুলিতে সবাইকে শেষ করতে হবে। দেড় বছরের শিশু এমনকি কোলের ফুটফুটে বাচ্চারাও লাইনেই ছিল মায়ের কোলে। অপরাধ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে থেকে মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমণ করে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখার মহানায়ক ছিলেন শুকটা। শুকটা, নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার সামাজিক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য। অতি দুর্বল, অসুস্থ, শুকনা খড়ির মতো শীর্ণকায় বলে নাম তার শুকটা। মণ্ডল বংশের ছোট সন্তান।

তাই তার নামের পরে শুকটা মণ্ডল লেখা হলেও পরিচয় দিতে তার বংশের লেজুড় কোনো প্রয়োজনে আসে না। শারীরিক গঠনই তার নামের স্বার্থক পরিচায়ক! বাড়ি পদ্মার পাড়ে বিলমাড়িয়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে পাকহানাদার বাহিনী বিলমাড়িয়া হাটে ক্যাম্প করে। তারও আগের কথা। প্রথম যে দিন ক্যান্টনমেন্ট থেকে দলে দলে স্বশস্ত্র হানাদার মিলিটারি গ্রামের দিকে অগ্রসর হয় তখন গ্রামবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রতিরোধ করে। সেকি আর প্রতিরোধ করা বলে! আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি! রাইফেল, স্টেনগানের সামনে লাঠি কোন ছার? দু’একটা তীর এগিয়ে গেলেও মুহূর্তে মা-মাটির কোলে লুটিয়ে পড়েছে মহাতীরন্দাজ ও লাঠিয়াল। জানি না এ শহীদদের রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিয়েছে কি না।

মিলিটারি বিলমাড়িয়ায় আসতে থাকলে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানুষ যে যেদিকে পারে ছুটে পালাতে থাকে। আইজুদ্দিন প্রামাণিক দৌড়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। হানাদাররা তার পিছু নিয়েছিল। হানাদাররা আইজুদ্দিন প্রামাণিককে নদীর কোমর পানিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে তার দৌড়ের বাহাদুরির শিক্ষা দিয়েছে।

হানাদার মিলিটারির প্রথম তাড়া খেয়েই গ্রামের সব মানুষ ভয়ে পদ্মা নদী পার হয়ে চরের গর্তে আশ্রয় নেয়। হিন্দুরা ভারতে পাড়ি জমায়। হানাদার বাহিনী প্রথমেই গ্রামে ঢুকে রহিম মোল্লাকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তাকে বন্দুকের নলের সামনে শান্তি কমিটি গঠন করতে বাধ্য করে। গ্রামের যুবকদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করায়। মহানায়ক শুকটা একটি ছোট্ট নৌকায় মানুষ পারাপার করেন। চরে আশ্রয় নেওয়া মানুষ শুকটার নৌকায় চড়ে বিলমাড়িয়ার বাজারে কেনাকাটা করতে আসে। শুকটা মাঝি হয়ে রাজাকার, মিলিটারি ও গ্রামের মানুষদের পারাপার করেন। শুকটার চেহারা এতটাই ক্ষীণকায় যে, কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও মনে করে না সে যুদ্ধ করতে পারে। বাস্তবেও পারেন না। তার শরীরে তেমন শক্তিও নেই, যে শক্তি রাইফেলের গুলি ছুড়তে প্রয়োজন।

হানাদারদের প্রথম আক্রমণ পর্ব শেষ হলে মানুষ ভেতরে ভেতরে ঘুরে দাঁড়ায়। তারা দেশকে হানাদারমুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় গ্রামের সব রাজাকারও। রাজাকাররা সবাই অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। শুকটা মাঝি হওয়ার সুবাদে সব খবরই পান। কখন মিলিটারি কোথায় অপারেশনে যায় তাও যেমন জানেন, তেমনি মুক্তিযোদ্ধারা কখন কোথায় কীভাবে অপারেশন করবেন তাও আগাম জানতেন। মূলত তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর। কারণ সবাই তার নৌকায় পার হয়। সবাই যার কাছে যে খবর থাকে তা সব শুকটার কাছে বলে। শুকটা মিলিটারির সব খবর মুক্তিবাহিনীকে দেয়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের রাতে অপারেশনে নিয়ে যায়, দিনে চরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে। গ্রামের বাড়ি থেকে খাবার সংগ্রহ করে গোপনে মুক্তিদের কাছে দিয়ে আসেন। সত্য বেশি দিন গোপন থাকে না। হানাদারবাহিনী বুঝতে পারে চরের গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে থাকে। এ অভিযোগে তারা গ্রামে অপারেশন চালায়।

গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশু সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেয়। এক গুলিতে সবাইকে হত্যা করবে। শুকটা খবর পায় যে, হানাদাররা গ্রামের মানুষদের হত্যা করার জন্য লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নৌকা ঘাটে বেঁধে রেখে শুকটা দৌড় দেয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে। শুকটার কাছে খবর পেয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রহিম মোল্লা শুকটাকে নিয়ে মিলিটারি ক্যাম্পে যায়। হানাদার মেজর শুকটাকে জিজ্ঞাসা করে সে গ্রামে কি মুক্তিরা লুকিয়ে থাকে? শুকটা বলেন-না, সে গ্রামে কোনো মুক্তি থাকে না। শুকটার কথা শুনে হানাদার মেজর কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে। গুলির শব্দ শুনে চরের মানুষদের লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে হানাদার মিলিটারিরা ক্যাম্পের দিকে দৌড় দেয়। হানাদাররা ক্যাম্পে গুলির শব্দ শুনে মনে করেছিল মুক্তিরা ক্যাম্প আক্রমণ করেছে। তাই তারা ক্যাম্প রক্ষা করার জন্য দৌড় দিয়ে ক্যাম্পে চলে যায়। শুকটার অস্ত্র চালানোর মতো শারীরিক যোগ্যতা ছিল না। দেশকে ভালোবাসার শিক্ষা কোনো বিদ্যালয় বা কোনো শিক্ষক তাকে দেয়নি। শুকটা বাবুদের কাছে একেবারেই গো-মূর্খ! সেই শুকটার বুদ্ধিমত্তায় একটি গ্রামের হাজারো নিরীহ মানুষের প্রাণ বেঁচেছিল।

বিলমাড়িয়া বাজারের দুই পাশে ছিল দুটি হিন্দুপাড়া। পশ্চিম পাশে ছিল পালপাড়া মানে কুমারপাড়া। পূর্ব পাশে ছিল জেলে ও সুতারদের বসতি। যুদ্ধ শুরু হলে হিন্দুরা গ্রামে মান্যবর মজিবর রহমান মাস্টারের হাত ধরে মিনতি করে বলেছিল-কাকাবাবু! সব রেখে গেলাম আপনার হিল্লায়, দয়া করে দেখবেন! হিন্দুরা মজিবর রহমান মাস্টারের জিম্মায় তাদের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ সবকিছু রেখে ভারতে পালিয়ে যায়। মজিবর রহমান মাস্টার খুব পরহেজগার মানুষ। তাই মিলিটারিরা তাকে কিছু বলে না। ক্ষেত্র বিশেষে তার কথা ও অনুরোধ মিলিটারিরা সমীহ করে।

মিলিটারিরা খবর পেয়েছিল যে জেলেপাড়ার সবাই হিন্দু। এবং তারা ভারতে পালিয়ে গেছে। তাই এক দিন মিলিটারি জেলেপাড়ায় আগুন দেওয়ার জন্য ঘরের খড় টেনে বের করে দিয়াশলাইয়ের কাঠি ঠুকবে, এমন সময় মজিবর মাস্টার এসে তাদের সামনে জোড় হাত করে বলেন-দয়া করে পুড়াবেন না! এই গ্রাম আমাদের। এখানে কোনো হিন্দুর বাড়ি নাই। মিলিটারিরা তার কথায় বিশ্বাস করে জেলে পাড়ায় আগুন দেওয়া থেকে বিরত থাকে। জেলে পাড়া ও কুমারপাড়া রক্ষায় সাহায্য করেছিলেন আরেকজন মানুষ। তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রহিম মোল্লা।

রহিম মোল্লার অপ্রিয় কাজও কম ছিল না। তিনি মিলিটারির খাবারের ব্যবস্থা করতেন। গ্রামের বাইরে থেকে বাঙালিদের গরু, মহিষ, ছাগল ধরে এনে মিলিটারিদের দিতেন। মুক্তিযুদ্ধে তার কার্যক্রম তাই প্রশ্নবিদ্ধ। একদিকে নিজ গ্রামের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে বাঁচিয়েছেন, তাদের সম্পদ রক্ষা করেছেন, মুক্তিদের খবর গোপন রেখেছন। অন্যদিকে হানাদার মিলিটারির সহযোগী হয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। কাজ যেমনই করুক, রহিম মোল্লা কাগজে-কলমে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। তাই যুদ্ধ শেষে ভিনগ্রামের মুক্তিরা তাকে হত্যা করার জন্য তাড়া করেছিলেন। রহিম মোল্লা পালিয়ে বেঁচেছিলেন। কিন্তু শুকটার কোনো শত্রু ছিল না।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত হয়েছে। কেউ অস্ত্র জমা দিয়েছে, কেউ অস্ত্র জমা না দিয়ে বিপ্লব করার জন্য শ্রেণিশত্রু খতম করার জন্য সে অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তারপরের ইতিহাস অনেকেরই জানা। দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি হয়েছে। সরকার বদল হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বদল হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দেওয়া হয়েছে। সনদধারী মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় কিছু সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। তাদের মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। তাদের সন্তানদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। শুকটা কিন্তু এসবের কোনো খবরই রাখেন না। তিনি নিজেকে কখনোই মুক্তিযোদ্ধাও মনে করেননি। কখনো কোনো রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাওয়ার কথাও তার মাথায় আসেনি। তিনি জানতেনও না কোথায় থেকে, কাদের, কি যোগ্যতার ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেওয়া হয়।

এ সনদ কীভাবে নিতে হয়, সনদ দিয়ে কি করতে হয়, কি কি কাজে লাগে ইত্যাদি তার জানার ক্ষমতার বাইরেই থেকে গেছে। কোনো মহাপুরুষও তাদের কখনোই এসব ব্যাপারে কিছুই বলেননি। এসব ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ শুকটা লেখাপড়া জানা মহাজ্ঞানীদের কাছে কেবলই মূর্খ মানব! শুকটা কোন রাজনৈতিক দলের সভ্য কখনোই হননি, হওয়ার যোগ্যতাও রাখেন না! কোনো দলের নেতাদের সঙ্গে উঠাবসা করার তো প্রশ্নই উঠে না। সে যোগ্যতাই বা তার কোথায়। সবদিক থেকে অযোগ্য, অজ্ঞ শুকটাকে অজ্ঞতা-অবজ্ঞার গ্লানি নিয়ে রোগ-শোক আর দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে অসময়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে! শুকটা পাননি মৃত্যুর পরেও কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সম্মান! পারেননি দেশের পতাকা বুকে জড়িয়ে কবরে যেতে!

রাষ্ট্রের মহারথীদের কেউ যখন মুক্তিযোদ্ধা সনদের মহামূল্যায়ন করে জাল জালিয়াতি করতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তখন শুকটাদের স্ত্রী সন্তানরা সভ্য সমাজের আলোকে পদাঘাত করে এগিয়ে গেছেন অন্ধকার কুঠিরে অজ্ঞতার গ্লানি পরে দিনমজুরি করে জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হতে! তাতে তাদের কোনো আক্ষেপও নেই। কারণ তারা জানেই না যে তাদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা কিনা! এমনি কত শুকটাই না দেশের আনাচে-কানাচে সভ্যতার আলোকে পদাঘাত করে গর্বিত হয়েছেন! কত আইজুদ্দিনের প্রাণপ্রাতের সমন্বয়ে ৩০ লাখ হয়েছে, কে তার খবর রাখে? শুকটা, আইজুদ্দিনদের খবর রাখতে হয় না! আইজুদ্দিনদের রক্তে আর শুকটাদের বুদ্ধিতে দেশ স্বাধীন কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধা হন না!

নূরুজ্জামান : কলাম লেখক।
[email protected]

 
Electronic Paper